ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

প্রকাশিত: ১০:৪০, ১৭ মে ২০১৯

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

পর্ব-৩২ লবিতে ফিরতে আমাদের আধ ঘণ্টার মতো লাগল। তারপর লবির পাশেই কফিশপে গিয়ে বসলাম। ঘন কালো জার্মান কফি খেয়ে কিছুটা উজ্জীবিত বোধ করছিলাম। কারেন বলল, কাল তোমাদের লম্বা দিন। প্রথমেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, তারপর সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে তোমাদের বৈঠক। কারেনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে প্রায় রাত ১০টা বেজে গিয়েছিল। খিদেও পেয়েছিল প্রচুর। কারেনকে জিজ্ঞেস করলাম, খাব কোথায়? ও বলল, তোমরা এই রেস্টুরেন্টেই খেয়ে নিতে পার। বিলগুলো সাইন করে দিও। পূর্ব জার্মান সরকার পেমেন্টের দায়িত্ব নেবে। কারেন চলে গেলে আমি আর স্যার মেনু কার্ড দেখে বের করার চেষ্টা করলাম কী খাওয়া যেতে পারে। অনেক খুঁজেও পছন্দসই কোন খাবার পাওয়া গেল না। শেষ পর্যন্ত জার্মানির রিন্ডা ফ্লাইশ গোলাশ অর্ডার করলাম। পরিচারিকাকে জিজ্ঞেস করে জানলাম এটা হচ্ছে গরুর মাংসের গোলাশ। এই খাবারটি অত্যন্ত উপাদেয় ছিল। সঙ্গে দেয়া হয়েছিল প্রচুর আলুর ভর্তা। কিন্তু তাতে আমাদের দেশের মতো তেল-মরিচ-পেঁয়াজ ছিল না। তাই একটু পানসে লাগছিল। সেই আলু মাংসের ঝোলের সঙ্গে মিশিয়ে পেট ভরে খেলাম। খেতে খেতেই ঘুমিয়ে পড়ছিলাম প্রায়। অতএব, অতঃপর যার যার রুমে ফিরে এলাম। বার্লিনে প্রথম রাতে হোটেলের কক্ষে শুয়ে নানা কথা মনে আসতে লাগল। ভারত উপমহাদেশের বাইরে আমার এই প্রথম আসা। একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া কাজ করছিলো মনে। তখনও আমি ব্যাচেলর। দিনের কাজকর্ম সেরে নাটকের মহড়া, অতঃপর বন্ধুদের সঙ্গে মাঝ রাত অবধি আড্ডা, ইত্যাদি মিলেমিশে ঢাকায় আমার জীবন ছিল সরব। বেশ কয়েক রাত আমাকে এখানে একা একা থাকতে হবে সেটা ভাল লাগছিল না। মানসচক্ষে ভেসে উঠছিল বেশ কিছু মুখ। এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লাম। বিছানার পাশের টেলিফোনের কর্কশ শব্দে ঘুম ভাঙল। তখন বার্লিনের সময় সকাল ৭টা। মুস্তাফা নূর-উল ইসলাম স্যারের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। স্যার বললেন, ‘এত বেলা হলো, এখনও পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছো? নাশতা খেতে হবে না? তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিচে এসো। আমি লবিতে থাকব।’ সকাল ৭টার সময় নাশতা খাওয়ার কথা জীবনেও কোন দিন ভাবিনি। আর যাত্রার ধকল এবং গত রাতে মাঝরাতে ঘুমাতে যাওয়ার পর এত তাড়াতাড়ি উঠতে হবে সে কথাও মনে আসেনি। স্যারের ওপর একটু রাগও হলো। পরে জেনেছি যে, স্যার অত্যন্ত ভোরে ঘুম থেকে ওঠেন প্রতিদিন। তারপর তাঁর বাড়ির কাছে শেরেবাংলা নগরে হাঁটতে যান। অর্থাৎ সকাল ৭টা তাঁর জন্য বিস্তর বেলা। যা হোক প্রাতঃকৃত্য শেষ করে কাপড়জামা পরে নিচে এসে দেখি স্যার অস্থিরভাবে লবিতে পাঁয়চারি করছেন। তখন সাড়ে সাতটা। তিনি আমাকে মনে করিয়ে দিলেন যে ওই দিন সকাল নয়টায় কারেন আমাদের গাড়ি করে নিয়ে যাবে পূর্ব জার্মানির বিদেশ মন্ত্রণালয়ে। সেখান থেকে আমরা যাব ওই দেশের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে। তারপর বললেন এই রেস্তরাঁয় না খেয়ে একটু ঘুরেফিরে দেখি-না আশপাশে ছোট কোন রেস্তরাঁ অছে কী না, যেখানে নাশতা খাওয়া যায়। আমি সানন্দে রাজি হলাম। তারপর আমরা দু’জন হোটেল থেকে বেরিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। বেশ কিছুক্ষণ বড় রাস্তার ওপর দিয়ে হাঁটলাম। কোন রেস্তরাঁর হদিস পেলাম না। অতঃপর বড় রাস্তা ছেড়ে একটা গলির ভেতরে ঢুকলাম। সেই গলি থেকে আরেকটি। দু’পাশে কোন দোকানপাটই নজরে আসছে না। কতদূর এসেছি এ নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলাম। স্যার অস্থির হয়ে বললেন, চলো হোটেলেই ফিরে যাওয়া যাক। ভাবলাম, হোটেলে যে ফিরব, সেই রাস্তাও তো ভুলে গেছি। হঠাৎ নজরে পড়ল এক বৃদ্ধা মহিলা আমাদের দিকে হেঁটে আসছেন। বয়সের পক্ষে বেশ দ্রুতই হাঁটছেন তিনি। আমি একবারে তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তিনি বোধহয় এই অদ্ভুত দর্শন এক কালো মানুষকে দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। তাকে আশ্বস্ত করে আমি নানাভাবে জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করলাম এখানে কোন রেস্তরাঁ আছে কী না। আমি ইংরেজীতে জিজ্ঞেস করি, তিনি জার্মান এ উত্তর দেন। অবশেষে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে হাত তুলে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে , আমি খেতে চাই। তিনি বুঝলেন। আমার হাত ধরে জার্মান ভাষায় বললেন, আমার সঙ্গে এসো। ততক্ষণে প্রায় আটটা বাজে। তাঁর সঙ্গে বেশিক্ষণ হাঁটতে হলো না। অল্প কিছু পরেই তিনি বড় রাস্তার মাথায় আমাদের একটি বহুতল ভবনের দিকেনির্দেশ করে বললেন, ওই খানে খাবার পাবে। আমি তাকে অশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে স্যারকে বললাম, ‘চলেন, শেষ পর্যন্ত রেস্তরাঁ পাওয়া গেল।’ নির্দেশিত সেই ভবনের দরজা দিয়ে ঢুকে দেখি আমাদের হোটেলেই ঢুকেছি আবার। সেই রিসেপশন, সেই রেস্তরাঁ, সেই জনাকীর্ণ লবি দেখা যাচ্ছে। আমরা এবার হোটেলের সদর দরজা দিয়ে না ঢুকে পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকেছি। ততক্ষণে পেটে প্রচ- ক্ষিদে। সরাসরি ঢুকে গেলাম রেস্তরাঁয়। এই রেস্তরাঁয় বুফেতে খাবার বন্দোবস্ত। শোকেসে নানা ধরনের খাবার সাজানো রয়েছে। চাইলেই তুলে নেয়া যায়। একটা নির্ধারিত মূল্যের বিনিময়ে পেট চুক্তি খাওয়া। কিন্তু মুশকিল হলো আমরা কোন খাবারই চিনি না, নেবো কী? ওই শোকেসের এক প্রান্ত পার হওয়ার পর দেখি একটি টেবিলের ওপরে রাখা একগুচ্ছ সেদ্ধ ডিম আর তার পাশে রুটি আর মাখন। অবশেষে চেনা খাদ্যের দেখা পাওয়া গেল। আমি আর স্যার বেশ কিছু সেদ্ধ ডিম তুলে নিলাম। সঙ্গে রুটি আর মাখন। খাবার নিয়ে টেবিলে যখন বসতে গেলাম, তখন স্যার মৃদু স্বরে বললেন, শোকেসে দেখেছ, পেয়ালায় মনে হয় কিমা রেখে দিয়েছে? আমার চোখ উজ্জ্বল হয়ে গেল। আমি লোভী মানুষ। অতএব, দেরি না করে শোকেসের কাছে ফিরে এলাম। হ্যাঁ, কিমাই বটে। তবে, কোন্ মাংসের কিমা তা একটু দ্বিধা। স্যার বললেন, চিন্তার কিছু নেই, এটা দেখে মনে হচ্ছে যেন ঘোড়ার মাংস। দু’জন দুই পেয়ালা কিমা নিয়ে সেদিনের ব্রেকফাস্ট শেষ করা গেল। আমি পরে স্যারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি ঘোড়ার মাংস চিনলেন কী করে? তিনি বললেন, ‘যখন তুমি কোন মাংস চিনতে পারবে না, তখন সেটা ঘোড়ার মাংসই হবে।’ প্রসঙ্গত বলে রাখি, মুস্তাফা নূর-উল ইসলাম স্যারের সঙ্গে এই সফরে প্রতিটি মুহূর্ত টানটান আনন্দে কেটেছে আমার। স্যার সত্যিই রসিক মানুষ। তাঁর আরও একটি কথা মনে পড়ছে লিখতে বসে। আমাকে প্রথম দিনই দুপুর বেলা স্যার হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, জার্মান ভাষা শেখার কোন আগ্রহ আছে তোমার? আমি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন স্যার? স্যার বললেন, না, দু-একটি প্রয়োজনীয় বাক্য শিখে রাখা ভাল। তারপর বললেন, কারেনের কাছে শিখে নিও ‘টয়লেট কোথায়’ এই শব্দ দুটোর জার্মান কি? তখন বার্লিনে শীত পড়তে শুরু করেছে। আমাদেরও ঘন ঘন টয়লেটে যেতে হয়। অতএব, ওই শব্দ দুটোর জার্মান আমাদের অনেক কাজে এসেছিল।
×