ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অতীত দেখার বোতাম

প্রকাশিত: ১০:৩৯, ১৭ মে ২০১৯

অতীত দেখার বোতাম

এক রাতের গল্প। আমি তখন ঘুমে ছিলাম। চোখ বন্ধ, তবুও দেখছিলাম, স্বপ্ন। আকাশ কালো হয়ে আসছে। দস্যুর মতো ধেয়ে আসছে বাতাস। সরু মতো একটা নদী। কাদার ওপর এক চিলতে পানি। অতটুকু পানি ঢেউটিনের মতো ঢেউ তুলছে। নদীর একপাশে আমি। অন্যপাশে কয়েকটা মাত্র গাছ বাতাসে দুলছে। পাতা ঝরছে, আকাশে উড়ছে, নদীতে ভাসছে। আর বাতাসের ঘূর্ণিতে কয়েকটা পাতা ঘুরছে। আমি দেখলাম, ওই পাতাগুলো ঘুরতে ঘুরতেই দৌড়াচ্ছে। পেছনে এক কিশোরী। পাতার ঘূর্ণি দৌড়ায়, কিশোরীও দৌড়ায়। কিশোরীর বিনুনি করা চুল, দুলকিচালে লাফায়। ওই বিনুনির সঙ্গে আমিও লাফাতে শুরু করলাম, স্বপ্নের ভেতর। একসময় মনে হলো ঘোড়ার পিঠে আছি। টগবগ ছুটছি। কখনও রাজা, সেনাপতি। দৃশ্যের পরিবর্তন। এবার কেন জানি শরীরের শক্তি নিঃশেষ হয়ে এলো। আবার খুঁজে পেলাম সেই নদী, সেই গাছ। তবে সেই কিশোরীটি আর নেই। গাছে ছায়া নেই। আকাশে মেঘ নেই। আছে শুধু দাবদাহ। গলা শুকিয়ে কাঠ। কিন্তু নদীতে পানি নেই। আশপাশে কোন লোকও নেই। একটু পর হইহই করে একদল লোক এলো। কিন্তু ওটা দস্যুদল। এক রাতের গল্পটা এখানেই শেষ নয়। তারপর আরও দূর এগিয়েছে। স্বপ্নে যা হয়, যেমন হয় তেমন করেই এগিয়েছে। দস্যুরা তাড়া করছে, আমি আকুল হয়ে ছুটছি। ছুঁইছুঁই করেও ছুঁতে পারছে না আমাকে। তারপর ইত্যাদি ইত্যাদি। রাতের গল্পগুলো এমনই হয়, আকাশ-কুসুম। কিন্তু কখনও কখনও চমকে দেয়ার মতোও হয়। যেমন আমার ওই রাতের গল্পটা ছিল চমকে দেয়ার মতোই। রাত যখন শেষ হলো, আলো ফুটল। দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামল। সন্ধ্যা তখনও হয়নি। ওইদিন সত্যি সত্যি আকাশ কালো হয়ে এসেছিল। আর ওই কিশোরীটাও এসেছিল। সত্যি, সত্যি। তার মানে, আমার কাছে টাইম মেশিন আছে! আগেই ভবিষ্যত দেখার ক্ষমতা আছে আমার! তাহলে তো, চেষ্টা করলে অতীতও দেখা যাবে। টাইম মেশিনে অতীত দেখার বোতাম খুঁজতে শুরু করলাম। খুঁজে হয়রান। এর কাছে যাই, ওর কাছে যাই। কোথায় পাওয়া যাবে? কিছু বোতামের খোঁজ পেয়েছি। ওগুলো চেপে অতীত থেকে ঘুরেও এসেছি। কিন্তু সবকিছু কেমন ঝাপসা। অতীত সরাসরি এসে চোখের সামনে ধরা দেয়নি। আমার চোখ আর অতীতের মাঝখানে কেউ না কেউ বাগড়া বসান। তর্ক জুড়ে দেন। একজন এসে বলেন, ‘এটা আসল অতীত’। অন্যজন তাকে পেছনে ঠেলে ভিন্ন চিত্র দেখান। তারপর শুরু হয় তুলকালাম। এতে অতীতের চিত্রটাই ঘোলা পানিতে গুলিয়ে যায়। তবে একটা বোতামের খোঁজ আমার কাছে আছে। ওখানকার পানি অনেকটাই স্বচ্ছ। কেউ ঘোলা করতে চাইলেও নিজ দায়িত্বে করতে হবে। বাগড়া বসানোর মতো কেউ দাঁড়িয়েও নেই। শুধু অতীতের একটা চিত্র তুলে ধরা আছে। সবটাই কল্পনা নয়, বাস্তবও নয়। ওই চিত্রের ভেতর বিশাল এক অতীতের মাঠ। যেমন ইচ্ছে তেমন ভ্রমণ করা যাবে। অতীত দেখার এই বোতামের নাম ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’। বোতামটা বানিয়েছেন শওকত আলী। তিনি এখন আর বেঁচে নেই। বেঁচে থাকতে অতীতের প্রতি তার খুব আগ্রহ ছিল। বিশেষ করে বাংলার ঝাপসা অতীতকে ঘষে-মেজে চকচকে করার চেষ্টা করেছেন তিনি। ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ তার এমন একটি ইতিহাস নির্ভর বই। আর যারা ইতিহাস কপচাতে পছন্দ করেন না তাদের জন্য বার্তা হচ্ছে, এটি গল্পে টইটম্বুর এক উপন্যাস। হ্যাঁ, নামটা একটু কঠিন- ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’। প্রদোষ অর্থ হলো সন্ধ্যা। ঠিক অন্ধকার নামার আগের সময়টাকে বলা হয় প্রদোষকাল। আর প্রাকৃতজন বলতে লেখক বুঝিয়েছেন সেই সময়ের নিচু সমাজের কথা। তখন যারা ডোম, হডডি, জমির কাজ করতেন, কুমোর ইত্যাদি পেশার লোকজন। এই ‘প্রাকৃতজন’ শব্দটার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আমি বললাম ‘কুমোর’। কিন্তু ওই বইটাতে লেখক লিখেছেন, ‘কুম্ভকার’। আমি যাদের পরিচয় দিয়েছি জমির কাজ করতেন, লেখক তাদের বলেছেন ‘ক্ষেত্রকর’। শুধু তাই নয়, আরও আছে। ‘ঘর’কে তিনি লিখেছেন ‘গৃহ’। ‘কুকুরি’কে লিখেছেন ‘কুক্কুরি’। ‘পোড়ামুখি’কে লিখেছেন ‘দগ্ধমুখি’। যারা বইটি পড়েননি, তারা এবার ধরেই নিয়েছেন বইটি সাধু ভাষায় লেখা। কিন্তু না। একটা বাক্য তুলে ধরা যাক- ‘চুপ চুপ দগ্ধমুখি, তোর লজ্জা ভয় বলতে কি কিছুই নেই একেবারে?’ এখানে কয়টা সাধু শব্দ পাওয়া গেল? সুতরাং বইটা চলিত ভাষাতেই লেখা। তবে তখনকার সময়ে ব্যবহৃত কিছু শব্দ এখানে ব্যবহার করা হয়েছে। কোন সময়ের? যখন তুর্কী আক্রমণে সেনরাজার শাসন থেকে দেশ চলে গেল মুসলমানদের কাছে, সেই সময়ের কথা। তবে আতঙ্কের কিছু নেই। রাজপুরুষ আর রাজনীতির কপচা-কপচির ব্যাপার এখানে নেই। কোন সিদ্ধান্তও চাপিয়ে দেয়া হয়নি। প্রদোষকালে প্রাকৃতজনের জীবনের অস্থির সময়টা কেবল তুলে আনা হয়েছে। চিত্রগুলো একেবারে সাধারণ মানুষের। বেঁচে থাকার সংগ্রাম। রাজপুরুষদের ভেতরের কোন গল্প নেই। সাধারণদের জীবনের দশটা দরকার-অদরকারের খাতিরে রাজপুরুষরা কিছুটা এসেছেন। তবে এই কিছুটার মধ্যদিয়েই কিন্তু গোটা সময় চোখের সামনে উঠে এসেছে। কিছু দুর্বোধ্য ভাষা ব্যবহার হয়েছে বলে পড়া শুরু করতে ভয় হতে পারে। শুরুর কয়েকটা প্যারা ওই ভয় নিয়েই কেটে যেতে পারে। কিন্তু একটুমাত্র দূর এগোলেই তরতর করে পড়ে যেতে ইচ্ছে করবে। প্রথমে যে শব্দগুলো দুর্বোধ্য মনে হয়েছিল, দেখবেন সেই শব্দগুলো আপনাকে সামনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এ এক আশ্বর্য টান। একবার মনে হতে পারে আপনি কোন রোমাঞ্চ উপন্যাস পড়ছেন। অবার বইটাকে মনে হতে পারে একটা কবিতার বই। শুরুটা কঠিন মনে হলেও কঠিন নয়। আমার সেই রাতের গল্পের মতো, স্বপ্নের মতো। দৃশ্য প্রায় কাছাকাছি। নদী আছে, গাছ আছে। শরীর অবশ হওয়ার মতো ক্লান্তি আছে। তবে আমার স্বপ্নে ছিল এক কিশোরীর বিনুনি। আর এই বইয়ের নায়ক শ্যামাঙ্গর মুখোমুখি হয়েছিল ‘দুটি শ্যামবর্ণা যুবতী’ লীলাবতী ও মায়াবতী। শ্যামাঙ্গ আর লীলাবতী ও মায়াবতীদের মতো আরও কয়েকটি চরিত্র দিয়েই শওকত আলী তার টাইম মেশিনের বোতাম ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ তৈরি করেছেন। এই বোতাম চাপলে চলে আসে বাংলায় মুসলিম আক্রমণের সময়। আমি ওই সময়টা ঘুরে এসেছি বোতাম চেপে। সময়টা কি সত্যিই ছিল ‘প্রদোষকাল’? জবাব দুইরকম। আছে ইতিহাসবিদদের বিতর্ক। আর আছে রাজনীতির রং। আমাদের মতো ‘স্বপ্নবিলাসি’দের গল্পই অবলম্বন। ইতিহাস বাদ দিয়ে যদি গল্পতেই থাকি, তাহলে শ্যামাঙ্গ চরিত্রটা প্রদোষকালের। এক শিল্পী, মাটি দিয়ে মূর্তি বানায়। জীবিকার জন্য মন্দিরের ফলক বানায়। শিল্পীর হাতে শিল্প তৈরি হয়। কিন্তু বাস্তবতা ততটা শিল্পীত ছিল না। অবিন্যস্ত ‘বাস্তব’ এসে তার কাজে বাধ সাধে। শুরু হয় শিল্পের সঙ্গে লড়াই। গুরুর সঙ্গে কলহ বেঁধে যায়। কাজ ছেড়ে নিজের গ্রামে ফিরে যেতে চায় শ্যামাঙ্গ। কিন্তু পারে না। আবারও ‘বাস্তব’ এসে দাঁড়ায়। পথে পথে বাধা দেয়। সেই নিষ্ঠুর বাস্তবতাটুকু ছিল তখনকার রাজনৈতিক অস্থিরতা। সেনরাজার শাসন। অত্যাচার, পীড়ন। রাজা, মন্ত্রী, সামন্ত, মহাসামন্তদের একমাত্র কাজ ছিল প্রজাপীড়ন। নিষ্ঠুর বাস্তবের মুখোমুখি হয় শ্যামাঙ্গরা। তাদের করার কিছু থাকে না। বেঁচে থাকার সংগ্রাম, প্রেম, বিরহ আর রাজনীতি। এসব কিছুর মুখোমুখি হয়, কিন্তু লড়াই করার সাহস থাকে না। কেবল পালিয়ে বাঁচতেই পুরো উপন্যাসটা শেষ হয়ে যায়। তবে সাধারণের ভেতর কিছু অসাধারণও থাকে। প্রজাপীড়নে বিক্ষুব্ধ হয় বৌদ্ধ ভিক্ষুরা। কিন্তু বিদ্রোহের সাহস নেই। অন্যদিকে তুর্কী মুসলিম আক্রমণ হবে বলে খবর ভাসতে থাকে। যাকে তখন বলা হতো ‘যবন আক্রমণ’। কেউ যবনদের ভালভাবে নিত না। কিন্তু রাজা ও সামন্তদের অত্যাচারে তুর্কী মুসলিমদের মধ্যেই আশা দেখেছিল বৌদ্ধ ভিক্ষুরা। তারাই ডেকে আনল ওই ‘দস্যু’দের। ‘দস্যু’রা এলো, আর জয় করল। ভিক্ষুরা হাসতে হাসতে হাত বাড়াল। কিন্তু সেই হাত-ই কাটা পড়ল তরবারির কোপে। দস্যুদের চরিত্র এমন হওয়ারই কথা। তাদের হাতেই মৃত্যু হয় শ্যামাঙ্গের। তার নায়িকা লীলাবতী মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। ‘যবন শিবির’-এর আশ্রয়ে ছিল। শ্যামাঙ্গকেও অনুরোধ করেছিল কালেমা পড়ে নিতে। কিন্তু সে ধর্মবিসর্জন দিতে চায়নি। ‘যবন শিবির’-এও আশ্রয় নেয়নি। তার পরিণতি তো ‘মৃত্যু’ই হওয়ার কথা। ‘তার মতো মৃৎশিল্পীকে জীবিত থাকার অধিকার দেয়নি ঐ সময়ের সমাজ-ইতিহাস।’ আর হ্যাঁ, ইতিহাস কি সবসময় নিরপেক্ষ? না, কোন সময়-ই নয়। তবে শওকত আলী এক যুগেরও বেশি সময় নিয়ে লেখাটি লিখেছেন। এর জন্য তাকে অনেক অনেকবার টাইমমেশিনে চড়তে হয়েছে। ঝাপসা-ঝাপসা অনেক কিছুকে চকচকে করার কাজ করতে হয়েছে। যতটুকু পেরেছেন, করেছেন। স্বপ্নের মতো একটা বাস্তবতা নির্ভর গল্প দিতে পেরেছেন। ইতিহাস নিয়ে একটা প্লট তৈরি করে দিয়েছেন। এবার ভাবুন নিজের মতো করে। তবে গল্প থেকে ইতিহাস শেখার চেষ্টা না করাই ভাল।
×