ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তোফায়েল আহমেদ

শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন

প্রকাশিত: ০৯:০৫, ১৭ মে ২০১৯

শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন

গত বছর ‘বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট’ উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ৫৭তম দেশ হিসেবে স্যাটেলাইট ক্লাবের গর্বিত সদস্য হয়েছে। এই একটি কারণে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে আমাদের সুনাম অনন্য উচ্চতায় উঠেছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট বাণিজ্যিকভাবে সফল। মাত্র ৭ বছরের মধ্যে এর বিনিয়োগকৃত অর্থ উঠে আসবে ও বাকি ৮ বছর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখবে। প্রতিবছর ১৭ মে যখন আমাদের জীবনে ফিরে আসে তখন স্মৃতির পাতায় অনেক কথাই ভেসে ওঠে। তবে ৪টি কারণে এবারের ১৭ মে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমত. অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে টানা তৃতীয় এবং সর্বমোট চতুর্থবারের রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়ে প্রধানমন্ত্রী পদে সমাসীন হয়েছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। তার দূরদর্শী নেতৃত্বে সফলভাবে ‘বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট’ মহাকাশ প্রদক্ষিণ করছে। এর আগে আমরা পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের লাইসেন্স প্রাপ্তির মাধ্যমে ‘নিউক্লিয়ার নেশন’ হিসেবে বিশ্ব পরমাণু ক্লাবের সদস্য হয়েছি। স্বল্পন্নোত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের গৌরবময় সুনাম এবং মহত্তর অর্জনের এই বীজ রোপিত হয়েছিল সেদিন, যেদিন বঙ্গবন্ধু কন্যা- ১৯৮১-এর ১৭ মে ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে- স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। এ বছর তার ৩৮-তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বার্ষিকী। শেখ হাসিনা যেদিন স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন, সেদিন শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগই ছিল না, ছিল সর্বব্যাপী সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দুর্যোগ। সামরিক স্বৈরশাসনের অন্ধকারে নিমজ্জিত স্বদেশে তিনি হয়ে ওঠেন আলোকবর্তিকা। ’৮১-এর ১৩ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল অধিবেশন। কাউন্সিলে অনেক আলাপ-আলোচনার পর জাতীয় ও দলীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাঁকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। আমরা সাব্যস্ত করি মহান জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের নেতৃত্ব প্রদানকারী দল আওয়ামী লীগের পতাকা তাঁরই হাতে তুলে দেব। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হন তিনি। একই বছরের ১৭ মে এক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ বৃষ্টিমুখর দিনে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে ফিরে আসেন। ওইদিন ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের ৭৩৭ বোয়িং বিমানে ভারতের রাজধানী দিল্লী থেকে কলকাতা হয়ে সে সময়ের ঢাকা কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে বিকেল সাড়ে ৪টায় এসে পৌঁছেন। সারাদেশ থেকে লাখ লাখ মানুষ তাঁকে সম্বর্ধনা জানাতে সেদিন বিমানবন্দরে সমবেত হয়। ওই সময় লাখো জনতা ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানিয়ে বলেছি-‘শেখ হাসিনার আগমন শুভেচ্ছা-স্বাগতম’; ‘শেখ হাসিনা তোমায় কথা দিলাম, মুজিব হত্যার বদলা নেব’; ‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সঙ্গে’; ‘বঙ্গবন্ধুর রক্ত বৃথা যেতে দেব না’; ‘আদর্শের মৃত্যু নেই, হত্যাকারীর রেহাই নেই।’ ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট ও ৩ নবেম্বরের নির্মম হত্যাকা-ের পর আওয়ামী লীগের জন্য রাজনীতি কঠিন করে তুলেছিল স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়া। সংবিধান স্থগিত করে রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল। রাজনীতিকদের বেচা-কেনার সামগ্রীতে পরিণত করে রাষ্ট্রীয় মদদে দলভাঙ্গার নীতি অবলম্বন করা হয়েছিল। জেনারেল জিয়া সদম্ভে ঘোষণা করেছিল, ‘মানি ইজ নো প্রোবলেম’ এবং ‘আই উইল মেক পলিটিক্স ডিফিকাল্ট ফর পলিটিশিয়ানস।’ জেল, জুলুম, হুলিয়া, গুম-খুন ইত্যাদি ছিল নিত্যকার ঘটনা। প্রতিদিন সান্ধ্য আইন জারি ছিল। চারদিকে গড়ে তোলা হয়েছিল এক সর্বব্যাপী ভয়ের সংস্কৃতি। ’৭৬-এর ১ আগস্ট সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া সীমিত পরিসরে ‘ঘরোয়া রাজনীতি’ করার অনুমতি দেয়। আমরা যারা জেলে ছিলাম এবং যারা জেলের বাইরে ছিলেন তারা দলকে সংগঠিত করেছিলেন। শ্রদ্ধেয় নেতা মহিউদ্দীন আহমদকে সভাপতি ও সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করে আওয়ামী লীগ পরিচালিত হয়। রাজনৈতিক নিপীড়নের মধ্যে ’৭৭-এর ৩ ও ৪ এপ্রিল মতিঝিলের হোটেল ইডেন প্রাঙ্গণে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে কয়েক হাজার নেতাকর্মী সমবেত হয়। নেতৃবৃন্দ মতবিরোধ নিরসন এবং দলীয় ঐক্য ও সংহতি রক্ষার্থে সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনকে আহ্বায়ক করে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেন। এক বছর পর ’৭৮-এর ৩ থেকে ৫ মার্চ ঢাকায় আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। শ্রদ্ধাভাজন নেতা আবদুল মালেক উকিল সভাপতি, শ্রদ্ধেয় নেতা আবদুর রাজ্জাক সাধারণ সম্পাদক ও কারান্তরালে থাকা অবস্থায়ই আমাকে সাংগঠনিক সম্পাদক পদে নির্বাচিত করা হয়। ’৮১-এর সম্মেলনে সবাই ধরে নিয়েছিল আওয়ামী লীগ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যাবে। কিন্তু আমরা জীবনপণ চেষ্টা করে সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে আওয়ামী লীগের ঐক্য ধরে রেখে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার ওপর দলের নেতৃত্বভার অর্পণ করেছিলাম। দলের শীর্ষ পদে তাকে নির্বাচিত করে আমরা ভারতের রাজধানী দিল্লী গিয়েছিলাম এবং তার সঙ্গে পরামর্শ করে আগমন দিনটি নির্ধারণ করেছিলাম। যেদিন তিনি ফিরে এলেন সেদিন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মনে করেছিল শেখ হাসিনার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকেই তারা ফিরে পেয়েছে। সম্মেলনের সমাপ্তি দিবসে সকলের সিদ্ধান্ত অনুসারে আমি যখন দলীয় প্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু কন্যার নাম প্রস্তাব করি, তখন তা সর্বসম্মতিতে গৃহীত হয়। সেকি আনন্দ-উচ্ছ্বাস, সেকি দৃশ্য! চোখের সামনে সেই ছবি ভেসে ওঠে। আজ যা ভাষায় ব্যক্ত করতে পারব না। মনে হয়েছে, আমরা আবার বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার শেখ হাসিনার হাতে দলীয় পতাকা তুলে দিয়ে ঋণের বোঝা কিছুটা হয়ত হাল্কা করতে পেরেছি। সভানেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার নাম শুনে নেতাকর্মীরা উল্লাসে ফেটে পড়ে এবং বিপুল করতালির মাধ্যমে দলের সিদ্ধান্তকে অভিনন্দিত করে। শেখ হাসিনা সভানেত্রী, সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক পদে আবদুর রাজ্জাক এবং আমি পুনর্নির্বাচিত হই। কাউন্সিল অধিবেশনের সার্বিক সাফল্য কামনা করে শেখ হাসিনা একটি বার্তা প্রেরণ করে বলেছিলেন ‘আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে এগিয়ে যান।’ বার্তাটি সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক সম্মেলনে পাঠ করে শুনিয়েছিলেন। দলের শীর্ষ পদ গ্রহণে শেখ হাসিনার সম্মতিসূচক মনোভাব সম্পর্কে কাউন্সিলরদের উদ্দেশে আমি বলেছিলাম, ‘আমরা সকলেই একটি সুসংবাদের অপেক্ষায় আছি।’ শেখ হাসিনা তার বার্তায় সর্বপ্রকার দ্বন্দ্ব-বিভেদ ভুলে ‘আত্মসমালোচনা ও আত্মশুদ্ধির’ মাধ্যমে কাউন্সিলর ও নেতাদের বঙ্গবন্ধুর কর্মসূচি সোনার বাংলা বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছিলেন। শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে গণবিরোধী স্বৈরশাসকের ভিত কেঁপে উঠেছিল। ’৮১-এর ১৭ মে দেশে ফিরে আসার আগে জেনারেল জিয়ার নির্দেশে ‘শেখ হাসিনা আগমন প্রতিরোধ কমিটি’ গঠন করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীকে এ ব্যাপারে সতর্ক ও সজাগ থাকার নির্দেশ দিয়েছিলাম আমরা। বিমান বন্দরে অবতরণের পর লাখ লাখ লোক তাঁকে প্রাণঢালা অভিনন্দন জানিয়েছিল। সেদিন মনে হয়েছে বঙ্গবন্ধুই যেন শেখ হাসিনার বেশে আবার আমাদের মাঝে ফিরে এসেছেন। আমরা যখন মানিক মিয়া এ্যাভিনিউতে যাই রাস্তার দু’পাশে লাখ লাখ লোক। এমন এক দৃশ্য যা বর্ণনাতীত। মঞ্চে উঠে তিনি শুধু ক্রন্দন করলেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে হৃদয়ের আবেগ ঢেলে সেদিন বলেছিলেন ‘আজকের জনসভায় লাখো চেনামুখ আমি দেখছি। শুধু নেই প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু, মা আর ভাই, আরও অনেক প্রিয়জন। ভাই রাসেল আর কোনদিন ফিরে আসবে না। আপা বলে ডাকবে না। সব হারিয়ে আজ আপনারাই আমার আপনজন। স্বামী-সংসার-ছেলে রেখে আপনাদের কাছে এসেছি। বাংলার মানুষের পাশে থেকে মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য আমি এসেছি। আওয়ামী লীগের নেতা হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই। ... বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য বঙ্গবন্ধু সংগ্রাম করেছিলেন। আজ যদি বাংলার মানুষের মুক্তি না আসে তবে আমার কাছে মৃত্যুই শ্রেয়। আমি আপনাদের পাশে থেকে সংগ্রাম করে মরতে চাই। স্বাধীন-সার্বভৌম জাতি হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য স্বাধীনতা যুদ্ধে বাঙালী জাতি রক্ত দিয়েছে। কিন্তু আজ স্বাধীনতা-বিরোধীদের হাতে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হতে চলেছে। ওদের রুখে দাঁড়াতে হবে। ... বঙ্গবন্ধু ঘোষিত রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি বাস্তবায়ন ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা না পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলবে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচারের ভার সরকারের কাছে নয়, আমি আপনাদের কাছে এই হত্যাকান্ডের বিচার চাই।’ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটানা ১৪ বছর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক (তখন ১ জন সাংগঠনিক সম্পাদক ছিল) হিসেবে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছি। সভাপতিমন্ডলীর সদস্য হিসেবে দলের জন্য ১৮ বছর কাছে থেকে কাজ করেছি। মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবেও তাঁকে কাছ থেকে দেখেছি। আমার বার বার মনে হয়েছে যখন তার কাছে বসেছি, ক্যাবিনেট মিটিং বা সভা-সফর করেছি, তখন স্মৃতির পাতায় বঙ্গবন্ধুর কথা বার বার ভেসে উঠেছে। প্রিয় নেত্রী আওয়ামী লীগের দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর নিষ্ঠার সঙ্গে সততার সঙ্গে দলকে সংগঠিত করেছেন। দীর্ঘ ২১ বছর পর ’৯৬-এ তিনি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করেন। আমি সেই মন্ত্রিসভার শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রী ছিলাম। কাছে থেকে দেখেছি দৃঢ়তা ও সক্ষমতা নিয়ে তিনি রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। ‘ইনডেমনিটি বিল’ বাতিল করে সংবিধানকে কলঙ্কমুক্ত করে জাতির জনকের হত্যাকান্ডের বিচারের কাজ শুরু করেছিলেন। ২০০১-এ বিএনপি ক্ষমতায় এসে সেই বিচার বন্ধ করে দেয়। আবার ২০০৮-এর নির্বাচনে বিজয় অর্জন করে তিনি শুধু বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের কাজই সম্পন্ন করেননি, মানবতাবিরোধী-যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ করে চলেছেন এবং ইতোমধ্যে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ শেষ করে তাদের দন্ড কার্যকর হয়েছে। ২০০৯ থেকে আজ পর্যন্ত ১০ বছরের বেশি আমরা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত। এই ১০টি বছরে শেখ হাসিনা দেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। বিশ্বে মর্যাদার আসনে আসীন করেছেন। সেদিন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যার হাতে শহীদের রক্তে গড়া আওয়ামী লীগের পতাকা তুলে দিয়ে আমরা সঠিক কাজটিই করেছিলাম। ইতিহাস সৃষ্টি করে তিনি তা প্রমাণ করেছেন। রক্তেভেজা সেই পতাকা হাতে তুলে নিয়ে দল ও দেশকে তিনি প্রগতির পথে এগিয়ে নেয়ার নেতৃত্ব দিচ্ছেন। অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর ভাষায়, বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতি চমৎকার। এটা আন্তর্জাতিক বিশ্বের জন্য অনুসরণীয়-অনুকরণীয়। নোবেল লরিয়েট অমর্ত্য সেনের ভাষায়, সামাজিক-অর্থনৈতিক সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আজ পাকিস্তান থেকে এগিয়ে। এমনকি সামাজিক সূচকের কোন কোন ক্ষেত্রে ভারত থেকে এগিয়ে। অনেক বড় বড় প্রকল্প প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সমাপ্তির পথে এগিয়ে চলেছে। পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন বন্ধ করার পরেও দৃঢ়তার সঙ্গে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করে আজ তা সমাপ্তির পথে। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট, পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পদ্মা সেতু ও পদ্মা সেতুতে রেলপথ, বঙ্গবন্ধু সেতুতে পৃথক রেলপথ নির্মাণের উদ্যোগ, মেট্রো রেল, এলিভেটরি এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেল, রামপাল ও মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনসহ সর্বমোট ১১৯টি নতুন বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন, বিদ্যুত উৎপাদন ৩ হাজার ২০০ থেকে ২০ হাজার ১৩৩ মেগাওয়াট, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩.৫ থেকে ৩৩.০০ বিলিয়ন ডলার, রফতানি আয় ১০.৫২ থেকে সেবাখাতসহ ৪১.৫০ বিলিয়ন ডলার (যার মধ্যে তৈরি পোশাক খাতের অংশ ৩৫ বিলিয়ন ডলার)। আশা করি, এ বছর তা ৪৫ বিলিয়নে উন্নীত হবে; আমি বাণিজ্য মন্ত্রী থাকা অবস্থায় ২০২১-এর মধ্যে রফতানি ৬০ বিলিয়ন ডলারে উন্নতির লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছিলাম; আশা করি কাক্সিক্ষত সময়ের মধ্যে তা পূরণ হবে। পায়রা বন্দর, গভীর সমুদ্র বন্দর স্থাপনসহ অসংখ্য উন্নয়নমূলক কাজ হাতে নিয়ে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৮.১৩ শতাংশ করে জনগণের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৯০০ ডলারে উন্নীত হয়েছে। সবল-সমর্থ আর্থ-সামাজিক বিকাশ নিশ্চিত করার ফলে অর্থনৈতিক অগ্রগতির সূচকে বাংলাদেশ আজ বিশে^র শীর্ষ ৫টি দেশের একটি। আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রাইস ওয়াটার হাউস কুপার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘বাংলাদেশ ২০১৩ নাগাদ বিশে^র ২৯তম ও ২০৫০ নাগাদ ২৩তম অর্থনীতির দেশে উন্নীত হয়ে উন্নত দেশের তালিকায় স্থান করে নেবে।’ সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক উন্নতি ও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনের এসব কৃতিত্বের জন্য জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এ পর্যন্ত অসংখ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত করেছে। ২০০৮-এর নির্বাচনে রূপকল্প তথা ভিশন-২০২১ ঘোষণা করেছিলেন তিনি। যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ হবে ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং মধ্যম আয়ের দেশ। ডিজিটাল বাংলাদেশ আজ স্বপ্ন নয় বাস্তব। ইতোমধ্যে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্তরিত হয়েছি এবং উন্নয়নশীল দেশে প্রবেশ করেছি। ২০২০-এর ১৭ মার্চ জাতির জনকের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে রাষ্ট্রীয়ভাবে যথাযথ মর্যাদায় আমরা ‘মুজিববর্ষ’ পালন করব। ২০২১-এ যখন স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি হবে, তখন আমরা পরিপূর্ণভাবে মধ্যম আয়ের দেশে প্রবেশ করবো। এগুলো সম্ভব হয়েছে শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বের কারণে। শেখ হাসিনা যা বিশ্বাস করেন, জাতির জনকের মতো তাই তিনি বলেন এবং বাস্তবায়নের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। জাতির পিতা দুটি লক্ষ্য নিয়ে রাজনীতি করেছেন। একটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা, আরেকটি অর্থনৈতিক মুক্তি। তিনি আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছেন কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তি দিয়ে যেতে পারেননি। সেই কাজটি দক্ষতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা করে চলেছেন। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন অনেক দূর এগিয়ে গেছে; সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন স্বাধীন বাংলাদেশ হবে মর্যাদাশালী ক্ষুধামুক্ত দারিদ্র্যমুক্ত বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা। আমরা সেই পথেই বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে চলেছি। ইনশাআল্লাহ্ বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন পূরণ হবে। এটাই শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনে আমাদের প্রত্যাশা। লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য, সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি [email protected]
×