ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সংসার রক্ষার চাইতে বড় হতে পারে না আইনের বিধান

প্রকাশিত: ১১:০৫, ১৫ মে ২০১৯

সংসার রক্ষার চাইতে বড় হতে পারে না  আইনের বিধান

স্টাফ রিপোর্টার ॥ আইনের বিধান যত কঠোরই হোক না কেন তা একটি সংসার রক্ষার চাইতে বড় হতে পারে না। একটি সংসার ভেঙ্গে গেলে তার পারিবারিক ও সামাজিক নেতিবাচক দিক সুদূরপ্রসারী। এতে শুধু সামাজিক, পারিবারিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ই ঘটে না তাদের সন্তান এমনকি নিকট আত্মীয়-স্বজনের ওপরও এর গভীর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যা পূরণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। আইনের প্রয়োগ এবং এর ব্যাখ্যা যান্ত্রিক হতে পারে না। আইনের শাসনের মূল লক্ষ্যই হলো অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা সুনিশ্চিত করা। নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ১১(গ) ধারা সংশোধনের নির্দেশ দিয়ে হাইকোর্টের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মোঃ মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চের দেয়া পূর্ণাঙ্গ রায়ে এমন পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়েছে। নয় পৃষ্ঠার বাংলায় দেয়া এই রায়টি সুপ্রীমকোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। হাইকোর্টের রায়ে আরও বলা হয়েছে, এটা বাস্তবতা ও সত্য যে আইনের ১১ (গ) ধারার আওতায় সংঘটিত অপরাধ আপোসযোগ্য নয় এবং তিন বছরের সশ্রম কারাদ-ের বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু যৌতুক নিরোধ আইনে ৩ ও ৪ ধারার অপরাধ সংঘটনের জন্য সর্বোচ্চ ৫ বছরের শাস্তির বিধান থাকলেও তা আপোসযোগ্য করা হয়েছে। এছাড়া দ-বিধির ৩২৩, ৩২৪ ও ৩২৫ ধারায় সংঘটিত অপরাধের জন্য যথাক্রমে এক বছর, তিন বছর ও সাত বছরের শাস্তির বিধান রয়েছে। এই তিনটি ধারাই আপোসযোগ্য। এ জন্য এসব ধারার অপরাধসমূহের প্রকৃতি ও গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে পারিবারিক ও সামাজিক শৃঙ্খলা ও শাস্তি সুনিশ্চিতের পাশাপাশি মামলা জট নিরসনের স্বার্থে ১১(২) ধারার অপরাধটি অনতিবিলম্বে আপোসযোগ্য করার জন্য সংশ্লিষ্ট আইনটি সংশোধন করা প্রয়োজন। রায়ে বলা হয়, আইনের প্রয়োগ এবং এর ব্যাখ্যা যান্ত্রিক হতে পারে না। আইনের শাসনের মূল লক্ষ্যই হলো অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি সমাজে শৃঙ্খলা এবং শান্তি সুনিশ্চিত করা। পারিবারিক ও দাম্পত্য জীবনে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি ও মনোমালিন্য অস্বাভাবিক কোন ঘটনা নয়। যৌতুকের দাবিসহ যে কোন অজুহাতে স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর ওপর শারীরিক নির্যাতন নিঃসন্দেহে নিন্দনীয় ও গর্হিত অপরাধ। এ অপরাধের পরেও যদি স্বামী-স্ত্রী নিজেদের ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে দাম্পত্য জীবন অব্যাহত রাখার সংকল্প করে সেক্ষেত্রে আইনের বিধান যত কঠোর হোক তা বাধা হতে পারে না। উল্লেখ্য, চার লাখ টাকা যৌতুকের দাবিতে স্ত্রী লাভলী আক্তার স্বামী মোঃ শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে ২০১২ সালে মামলা করেন। ওই মামলায় ২০১৪ সালের ১০ জুলাই চট্টগ্রামের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল শফিকুল ইসলামকে ৩ বছরের কারাদ-সহ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছিলেন। দ-িত স্বামী ওই রায় বাতিলে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬১ (ক) ধারার আওতায় হাইকোর্টে মামলা করেন। ২০১২ সালের মামলায় লাভলী আক্তার উল্লেখ করেন, নৌবাহিনীর ঈসা খাঁ ঘাঁটিতে কর্মরত স্বামী তিনি গর্ভবতী থাকতে চার লাখ টাকার যৌতুক দাবিতে তলপেটে লাথি মারেন। এতে তিনি গুরুতর জখম হন। তার অকাল গর্ভপাত ঘটে। এরপরও নির্যাতন অব্যাহত রাখেন। এই মামলায় স্বামী দোষী সাব্যস্ত হন। দ-িত শফিকুল ২০১৬ সালে প্রথমে ট্রাইব্যুনালে আত্মপক্ষ সমর্থন করেন এবং পরে হাইকোর্টে আসেন। হাইকোর্টের রুল জারির পর স্বামী-স্ত্রী যৌথভাবে হলফনামা দেন যে, ‘তাদের মধ্যে সকল ভুল- বোঝাবুঝির অবসান’ হয়েছে। এখন তারা সুখে জীবনযাপন করতে চান। আড়াই বছর বয়সী এক পুত্রসন্তান আছে তাদের। হাইকোর্ট চট্টগ্রামের ট্রাইব্যুনালের ওই রায় বাতিল করে বলেছে, আইনের প্রয়োগ ও এর ব্যাখ্যা যান্ত্রিক হতে পারে না। পারিবারিক বা দাম্পত্য জীবনে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য ও ভুল-বোঝাবুঝি অস্বাভাবিক কোন ঘটনা নয়। ওই সাজা বাতিল চেয়ে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬১ (ক) ধারায় হাইকোর্টে আবেদন করেন শফিকুল। ওই আবেদন নিষ্পত্তি করে গত ১০ এপ্রিল হাইকোর্ট সাজা বাতিলের রায় ঘোষণা করেন। ১২ মে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ এই রায় প্রকাশ করা হয়। রায়ে ওই আইন সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত এই নির্দেশনার আলোকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১ (গ) ধারার অপরাধ আপোসমূলে নিষ্পত্তিতে ট্রাইব্যুনাল সম্পূর্ণরুপে এখতিয়ারবান হবে বলে হাইকোর্ট উল্লেখ করেন। হাইকোর্টের রায়ে সার্বিক অবস্থা বিবেচনাক্রমে নারী ও শিশু নির্যাতন দম ট্রাইব্যুনাল-১ চট্টগ্রাম কর্তৃক দরখাস্তকারীকে প্রদত্ত তর্কিত দ- ও সাজা বাতিল করে অপরাধের দায় থেকে অব্যাহতি দেয়া হল এবং তাকে জামিননাম থেকে অব্যাহতি দেয়া হলো। এই রায়ের ফলে ২০০০ সালের নারী নির্যাতন দমন আইনের ১১ (গ) ধারাটি আপোসযোগ্য হওয়ার পথ খুলল। ১১ (গ) ধারায় বলা আছে, যৌতুকের কারণে ‘সাধারণ জখম করার জন্য অনধিক তিন বছর কিন্তু অন্যূন এক বছর সশ্রম কারাদ-ে দ-নীয় হবেন এবং ওই দ-ের অতিরিক্ত অর্থদ-েও দ-নীয় হবেন। এই বিধানের ফলে স্বামী-স্ত্রী মিলে গেলেও তারা আপোস করে বর্তমানে মামলা তুলে নিতে পারেন না। তাই ৬ মাসের মধ্যে সংসদকে আইন সংশোধন করে সংশ্লিষ্ট অপরাধকে অনাপোসযোগ্য থেকে আপোসযোগ্য করতে বলেছে হাইকোর্ট।
×