ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

গ্রুপ বিশে বাংলাদেশ ॥ নতুন মর্যাদায় অভিষিক্ত হচ্ছে দেশ

প্রকাশিত: ১১:০৩, ১৫ মে ২০১৯

গ্রুপ বিশে বাংলাদেশ ॥ নতুন মর্যাদায় অভিষিক্ত হচ্ছে দেশ

এম শাহজাহান ॥ বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে প্রভাবশালী ‘গ্রুপ-টোয়েন্টি’র নতুন অংশীদার হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। জি-২০’র সদস্য পদ লাভের পর অর্থনৈতিক দুনিয়ায় নতুন মর্যাদায় উচ্চারিত হবে স্বাধীন বাংলাদেশের নাম। সমষ্টিগতভাবে জি-২০’র অন্তর্ভুক্ত দেশসমূহ বিশ্বের মোট জাতীয় উৎপাদনের ৮৫ শতাংশ এবং বিশ্ব বাণিজ্যের ৮০ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করছে। আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরের মধ্যে বড় এই অর্জন দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে। এর ফলে বিশ্ব বাণিজ্যে বড় অংশীদার হওয়ার সুযোগ পাবে বাংলাদেশ। কাক্সিক্ষত রফতানি ও বিনিয়োগ হবে এদেশে। কমবে দারিদ্র্য, বাড়বে কর্মসংস্থান। সর্বশেষ গত এপ্রিল মাসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ২০২৪ সাল পর্যন্ত বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার প্রক্ষেপণ করেছে। সেই আলোকে ব্লুমবার্গের করা বিশ্লেষণে বাংলাদেশ সম্পর্কে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়। জানা গেছে, মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) অবদান রাখার দিক থেকে মাথাপিছু প্রবৃদ্ধিতে সব দেশকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এই সূচকে প্রথম তিন দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে মাথাপিছু প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪৫ শতাংশ। একই হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে ভারত ও চীন। জনগণের ক্রয়ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে এই হিসাব করা হয়েছে। তবে প্রবৃদ্ধির যে ধারাবাহিকতা, তা বজায় রাখা সম্ভব হলে অদূর ভবিষ্যতে এই দুই দেশকেও টপকিয়ে যাবে বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্টদের মতে, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অগ্রযাত্রা এখন সারা বিশ্বের রোল মডেল। আইএমএফের পরিসংখ্যান মতে, নামিক জিডিপির ভিত্তিতে বর্তমানে বাংলাদেশ পৃথিবীর ৪৩তম বৃহৎ অর্থনীতি আর ক্রয় ক্ষমতা সমতার ভিত্তিতে দেশের অবস্থান ৩২তম। শুধু তাই নয়, ২০১৭ সালে দ্রুততর প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী শীর্ষ দশটি দেশের তালিকায় বাংলাদেশও রয়েছে। প্রাইস ওয়াটারহাউস কুপারসের তথ্যমতে, ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৮তম বৃহত্তম অর্থনীতি এবং ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের অবস্থান হবে ২৩তম। এদিকে বিশ্লেষণে দেখা যায়, আগামী অর্থবছর বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধিতে দশমিক ৯ শতাংশ অবদান রাখবে বাংলাদেশের অর্থনীতি। একই পরিমাণ অবদান রাখবে কানাডা। আর এর পরই অবদান রাখবে ফিলিপিন্স, থাইল্যান্ড ও সৌদি আরব। আগামী ২০২৪ সাল পর্যন্ত বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশের এই অবদান অব্যাহত থাকবে। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আগামী অর্থবছরের মধ্যে বাংলাদেশ জি-২০ দেশগুলোর অন্তর্ভুক্ত হবে। অনেক সাফল্যের পথ বেয়ে আসছে এই অর্জন। এর ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বাড়বে। শীর্ষ ধনীদেশগুলোর কাতারে থাকবে এদেশের নাম। তিনি বলেন, আমাদের সরকারের লক্ষ্য, ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশে পরিণত করা। তবে দেশের অগ্রযাত্রার যে গতি পরিলক্ষিত হচ্ছে, তাতে আশা করা যায় এর পূর্বেই আমরা সে আশা পূর্ণ করতে পারব। গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের মতো ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারেনি কোন দেশ। প্রসঙ্গত, জি-২০’র সদস্য রাষ্ট্রগুলো হচ্ছেÑ অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, রাশিয়া, সাউথ আফ্রিকা, তুরস্ক, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, মেক্সিকো, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, যুক্তরাজ্য, চীন, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, সাউথ কোরিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো। এই ২০ দেশের অর্থমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবর্নরের সমন্বয়ে গঠিত একটি জোট বা গ্রুপ। এই গ্রুপের সদস্য ১৯টি দেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট এবং ইউরোপীয়ান কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিত্ব করেন। জি-২০ দেশসমূহের রাষ্ট্রপ্রধান এবং সরকার প্রধান গ্রুপের সম্মেলনে তাদের নিজ নিজ দেশের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেন। বিশ্বের প্রধান ও উদীয়মান অর্থনৈতিক পরাশক্তি সম্পন্ন দেশসমূহের মধ্যে পারস্পারিক সহযোগিতা, আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা ছিল জি-২০ গঠনের উদ্দেশ্য। ২০০৯ এর ২৫ সেপ্টেম্বরে জি-২০’র নেতারা ঘোষণা দেন যে, জি-৮ কে জি-২০ অদূর ভবিষ্যতে প্রতিস্থাপন করবে। কোন সদস্যকে নির্দিষ্ট বছরের জন্য জি-২০ নেতাদের বৈঠকে সভাপতিত্ব দায়িত্ব দেয়া হবে তা নির্ধারণ করতে, ১৯টি সার্বভৌম দেশকে সর্বোচ্চ চার জনের পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত করা হয়। জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে রেকর্ড বাংলাদেশের ॥ গত কয়েক বছর ধরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনে রেকর্ড অর্জন করেছে বাংলাদেশ। ৬ অঙ্কের বৃত্ত ভেঙ্গে জিডিপি প্রবৃদ্ধি এখন ৮ এর ঘরে অবস্থান করছে। রূপকল্প-২১ সামনে রেখে এই জিডিপি দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছানোর লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে বাংলাদেশের সামনে। এলক্ষ্যে রফতানি বাড়াতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এছাড়া উৎপাদন বাড়াতে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আসছে দেশে। ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের জন্য মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। শুধু তাই নয়, চলতি অর্থবছর (২০১৮-১৯) শেষে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনে দক্ষিণ এশিয়ায় দেশগুলোর যৌথভাবে শীর্ষে থাকবে বাংলাদেশ ও ভারত। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে যাচ্ছে। চলতি বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। কিন্তু বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্যমতে, অর্থবছর শেষে এই প্রবৃদ্ধি হবে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। এছাড়া আগামী অর্থবছরের জন্য জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৮ দশমিক ২ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। গত অর্থবছরে ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ জনকণ্ঠকে বলেন, গত কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। প্রবৃদ্ধির এই সুফল দেশের সাধারণ মানুষ পাচ্ছে কি না সেটা কিন্তু একটি বড় বিষয়। তিনি বলেন, উন্নয়ন আগে না অধিকার আগেÑ অর্থনীতিতে এটা গুরুত্বপূর্ণ। আয় বৈষম্য কমিয়ে এনে সুষম বণ্টন ব্যবস্থায় দেশের দারিদ্র্য হ্রাস পাবে। প্রবৃদ্ধির সুফল নিশ্চিত করতে হলে আগে দারিদ্র্য দূর করা প্রয়োজন। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধ, পুরো অঞ্চলে ব্যবসায়িক আস্থার ঘাটতি, জাপানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জার্মানিতে পরিবেশ ইস্যুতে গাড়ি উৎপাদন কমে যাওয়া, এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে চাহিদা কমে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে ধীরগতি থাকবে বলে মনে করছে আইএমএফ। এছাড়া সমস্যা বাড়াতে পারে বাণিজ্য যুদ্ধ ও বেক্সিট প্রভৃতি। কিন্তু এতসবের পরও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ঠিক থাকবে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিক এই অর্জনে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী জি-২০’র সদস্য রাষ্ট্র হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) চেয়ারম্যান কাজী এম আমিনুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, গত কয়েক বছর ধরে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ছে। মোট দেশজ উৎপাদন বাড়াতে সরকারের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। প্রতিশ্রুত অনুযায়ী বিদেশী বিনিয়োগ আনার লক্ষ্যে কাজ করছে বিডা। অবকাঠামো উন্নয়ন, ওয়ান স্টপ সার্ভিস নিশ্চিত করা, বিনিয়োগকারীদের জন্য অর্থনৈতিক অঞ্চল করে দেয়া, কর অবকাশ সুবিধা ঘোষণা করা হয়েছে। এসব কারণে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ ইতিবাচক ধারায় রয়েছে।
×