পঞ্চাশের দশকে মুক্তিপ্রাপ্ত উত্তম কুমার এবং সুচিত্রা সেন অভিনীত ‘সবার উপরে’ সিনেমাটি দেখার মাধ্যমে আমার সিনেমা দেখা শুরু। এখনও মনে আছে, মার সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে কিশোরগঞ্জ শহরে রংমহল সিনেমা হলের উপরতলায় মহিলাদের সঙ্গে বসে সিনেমাটি দেখেছিলাম। সেই শুরু এবং প্রায় ছয় দশক ধরে সিনেমা দেখা চলছেই। কলেজে পড়াকালে সদরঘাট থেকে নটর ডেম কলেজে যাতায়াত করতাম। তখন মধুমিতা সিনেমা হলে প্রায়ই ইংরেজী মুভি চলত। দু’একবার ক্লাস ফাঁকি দিয়ে সিনেমাও দেখেছি। ক্লিওপেট্রা ছবিটি হয়ত দু’তিনবার দেখেছিলাম। বলার অপেক্ষা রাখে না, এখনও সিনেমা দেখি। তবে বেছে বেছে।
কানাডায় পিএইচডি করাকালে ডেভিট এটেনবরোর গান্ধী ছবিটি দু’বার দেখেছিলাম। দ্বিতীয়বার সুপারভাইজার ও তার স্ত্রীকে নিয়ে। ছবিটি এতই ভালভাবে নির্মিত, পরবর্তীকালে ক্যাসেট কিনে রেখে দিয়েছিলাম বন্ধুদের দেখানোর জন্য।
প্রবাসী বাঙালী কিন্তু শেকড় তো আর ভুলা যায় না। আর আমাকে যাদের জীবন অনুপ্রেরণা দেয় তাঁরা হলেন- গান্ধী, নেতাজী, ম্যান্ডেলা, মার্টিন লুথার কিং, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ এবং বঙ্গবন্ধু। এখন তো সিনেমা দেখতে হলে সিনেমা হলেও যেতে হয় না। নেটফ্লিক্স, হুলু, আমাজন, ইউটিউব বা অন্য কোন মিডিয়াতে সিনেমা ঘরে বসেই দেখা যায়। এই আমি মানুষটা এই করে করেই জীবন সমুদ্রটা পাড়ি দিয়ে যাচ্ছি। তীরে ভিড়লেই সিনেমার শেষ স্ক্রিনটি এসে পড়বে। তা এখনই চাই না। ৭৫ বছর হতে এখনও বাকি আরও কয়েকটি বসন্ত।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সিনেমা করার কথাটা অনেক বছর ধরেই হচ্ছিল। বেশ কয়েকবার লিখেছি বৈকি। রুচিশীল সিনেমা এমন একটা মাধ্যম যা থেকে অনেক কিছুই শেখা, জানা ও মনে রাখা যায়। ভাবতে ভাললাগছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অবশেষে ছবিটা হবেই। ৪০ কোটি টাকার বাজেট। পরিচালক শ্যাম বেনেগাল।
নেতাজী সুভাস চন্দ্র বোস, সিনেমাটি যারা দেখেছেন, তারা এক কথায় পরিচালক নির্বাচনটাকে সমর্থন করতে বাধ্য। দারুণ একটা ছবি শ্যাম বেনেগাল বানিয়েছেন।
তবে বঙ্গবন্ধুর জীবনভিত্তিক ছবিটিতে আমরা কি দেখতে চাই?
প্রথমত. সিনেমাটি সর্বস্তরের মানুষের জন্য তৈরি হতে হবে। স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা দেখে আনন্দ পায় সে উপাদান থাকতে হবে। ছোট বেলাকার কিছু অজানা তথ্য উদ্ধার করে-হাসা যায় তেমন কিছু, কিছুটা ইিউমার জুড়ে দিতে হবে। চুঙ্গা ফুকিয়ে রাজনীতিও তিনি করেছেন। সাধারণ জনগণের দৃষ্টিতে, দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের দৃষ্টিতে, তখনকার অন্যান্য রাষ্ট্রনায়কদের দৃষ্টিতে, যৌবনে বঙ্গমাতার সঙ্গে কিছুটা রোমাঞ্চ কিংবা খুনসুঁটি- দর্শক যেন অজানা কিছু দেখতে পায়।
গান্ধী এবং নেতাজীর আদলে যেমন দেখতে চাই, তেমনি তারও কিছু বেশি। আগরতলা ষড়যন্ত্র থেকে, নির্বাচন, গোলটেবিল বৈঠক, ৭ মার্চ, মৃত্যুর কাছাকাছি থেকে ফিরে আসা, অবশেষে ১০ জানুয়ারি আবার বাংলার মাটিতে ফিরে আসা, ইত্যাদি তো থাকবেই। তবে সিনেমাটা যেন শুধুই রাজনীতি নির্ভর না হয়।
গান্ধী সিনেমাটিতে গান্ধী ও তাঁর স্ত্রীর সম্পর্কটা দারুণ মর্মস্পর্শী করে দেখানো হয়েছে। তেমনি নেতাজী সিনেমাটিতে মাকে ফাঁকি দিয়ে গৃহে অন্তরীণ থেকে পালিয়ে যাওয়া, আফগান সেজে আফগানিস্তান যাওয়া ইত্যাদি দর্শকদের জন্য দারুণ রোমাঞ্চকর লেগেছে।
আমরা বঙ্গবন্ধু সিনেমাটিতে সাধারণ মানুষদের জন্য তেমনি রোমাঞ্চকর অজানা তথ্য আমরা দেখতে চাই। দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু কেন নিজের আত্মরক্ষার জন্য কোন ব্যবস্থা কখোনই নেয়নি। কেন? সেই দৃঢ়চেতা চরিত্রটি তুলে ধরতে হবে। আবার কেমন করে সাধারণ মানুষের জন্য তিনি মাটির সঙ্গে মিশে যান। কি করে তিনি একবার দেখার পর নাম মনে রাখেন। বুকে জড়িয়ে ধরেন। কেঁদে ফেলেন এবং মানুষের চোখেও জল এনে দেন।
বলার অপেক্ষা রাখে না, অনেক চরিত্রই আসবে সিনেমাটিতে। মনে আছে, গান্ধীতে হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীকে এক মিনিটের জন্য দেখানো হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু সিনেমাটিতে এই রকম অনেক এক মিনিট আসবে। আবার বেশি মিনিটও থাকবে অনেকের জন্য।
অবশ্যই চমক আসবে, কে হবে বঙ্গবন্ধু? যেই হোক না কেন ভাল হবেই। গান্ধী চরিত্রে বেন কিংসলি কী দারুণ অভিনয় করেছে। তাছাড়া আর্কাইভে সব ভিডিও চিত্র রয়েছে। তবে চমৎকার হবে যদি অভিনেতার অভিনয় এবং প্রকৃত ফুটেজ মিলে যায়। যেমন সাদা কালোতে ৭ মার্চের ভাষণ শুরু হলো অভিনেতাকে দিয়ে, এক মিনিট পরেই আসল বঙ্গবন্ধু চলে আসল সাদা-কালোতে, দর্শক বুঝতেই পারল না। সিনেমাটির সফলতা তখনই আসবে। প্রকৃত ফুটেজ অনেক ক্ষেত্রেই আসবে, যেহেতু সবই হাতের নাগালে।
তবে পরিচালকের কৃতিত্ব হবে যেসব চরিত্র এখনও বেঁচে আছেন তাদের দিয়ে যদি অভিনয়টা করানো যায় তাহলে দারুণ হবে। তবে বয়সটা কিভাবে কমানো যায়, দেখতে হবে।
পরিচালকের জন্য বড় সুবিধা হবে শেখ হাসিনার কাছ থেকে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে সব অজানা তথ্য বের করে আনা। বঙ্গবন্ধু নিশ্চয় ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তাভাত খেতে ভালবাসতেন। অথবা শুঁটকি মাছ? এ সম্পর্কে ৩০ সেকেন্ড দেয়া যেতেই পারে। তবে কিছু কিছু চরিত্র অবশ্য আসতে হবে এক মিনিটের জন্য হলেও। যেমন তখনকার ছাত্রলীগের চার নেতা, এমন কি সিরাজুল আলম খান এবং নূরে আলম সিদ্দিকী। তেমনি আসবে কাদের সিদ্দিকী। অবশ্যই আসা উচিত শহীদ জননী জাহানারা ইমাম এবং সেই সব গেরিলা ফাইটারদের আত্মত্যাগ। নিশ্চয় আসবে মেজর জিয়ার ভয়েস। এই সিনেমাটি একটা ঐতিহাসিক মাইলফলক হবে। এক কোটি শরণার্থী পশ্চিমবঙ্গে গিয়েছিল আমি ভাবছি ইন্দিরা গান্ধীর অভিনয়টা কে করবে? কিংবা টিক্কা খান বা ইয়াহিয়া খান কিংবা মোনায়েম খান?
যা হোক, এটা একটা সিনেমা যা অবশ্যই হওয়া উচিত, বিশেষ করে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য।
১২ মে ২০১৯
[email protected]