ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান

বাংলা নববর্ষ- অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও হাজী মহসিন

প্রকাশিত: ০৮:১২, ১৫ মে ২০১৯

বাংলা নববর্ষ- অসাম্প্রদায়িক  চেতনা ও হাজী মহসিন

দিনটি ছিল ১৪২৬ এর ১ বৈশাখ। কেমন যেন সারাটা দিন অলস সময় কাটল। সন্ধ্যেয় সারাদিনের অলসতা শেষে এ লেখাটি লিখতে বসি। আমাদের দেশে বিশেষত রাজধানী ঢাকায় ১ বৈশাখ অনিবার্য এক আনন্দ উল্লাসের দিন। নতুনকে বরণ করার উল্লাসে আপ্লুত হওয়ার দিন। বাংলা নববর্ষের শুরুর এ দিনটিতে ধর্ম-বর্ণ বয়স নির্বিশেষে প্রায় সকলেই মেতে ওঠে, নেচে ওঠে ঢাকের তালে, নানান সাজে, অনন্য উচ্ছ্বাসে। রমনার বটমূল থেকে বর্ষবরণের সম্মিলিত গীতধ্বনির সঙ্গে শুরু হয় ১ বৈশাখের দিনটি। জরাজীর্ণ গ্লানি ভুলে গিয়ে, পেছনে ফেলে নতুনের আহবানে অনিন্দ্য আনন্দে সবাই ভেসে চলে। এ যেন প্রতিটি বাঙালীর নিজস্ব একটি দিন। নিজের মতো করে সাজিয়েই সে মিশে যায় এই দিনটির মাঝে। অসাম্প্রদায়িকতার আবীরে রাঙানো এই দিনটি। আমাদের সবার ভাবনার জগতটা যদি এমন আবীরে মোড়ানো থাকত। তবে কেবল এই ১ বৈশাখ নয়, বছরের সারাটি সময়ই আমাদের চারপাশে সুখ, মঙ্গল ও কল্যাণ সঙ্গী হয়ে থাকত। মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রধান দুটি উৎসব হলো ঈদ-উল-ফিতর ও ঈদ-উল-আজহা। একই ভূ-খণ্ডে বাঙালী হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব হলো শারদীয় দুর্গোৎসব। এর বাইরেও জন্মাষ্টমীসহ কিছু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেশের হিন্দু সম্প্রদায় আনন্দ উল্লাসে সিক্ত ও মুখর হয়। খ্রীস্টান সম্প্রদায় পালন করে বড়দিন- অনেক আনন্দ ও যিশুখ্রিস্টের প্রতি অপার ভক্তিতে। বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী আনন্দ উৎসবে পালন করে বুদ্ধপূর্ণিমা। পাহাড়ী নৃগোষ্ঠীও আনন্দে হারিয়ে যায় তাদের নিজ নিজ ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনে। বাংলাদেশে এসব বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের এই বিশেষ দিনগুলোতে থাকে সরকারী ছুটি। রাষ্ট্রীয়ভাবেও এসব দিবসে অকুণ্ঠ আনন্দ ও শুভেচ্ছায় পাশে থাকা হয়। নিজ নিজ ধর্মে বিশ্বাসী গোষ্ঠী এসব দিনে স্বজন ও প্রিয়জন নিয়ে ধর্মীয় আাচার-অনুষ্ঠানের পাশাপাশি নির্মল আনন্দে মগ্ন হয়। পারস্পরিক শুভেচ্ছা বিনিময়ের সঙ্গে আগামীদিনের কল্যাণ কামনায়। এসবই হলো বাঙালী সমাজের চিরন্তন ও শাশ্বত চিত্র। এসব আনন্দ মুখর ধর্মীয় উৎসব ছাড়াও রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হয় স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস, জাতীয় শোক দিবস, জাতির পিতার জন্মদিবস। এসব দিবসে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বলতে গেলে দেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ থাকে। কিন্তু ১ বৈশাখ এমন একটি দিন যেদিন সমগ্র বাঙালী সমাজ ধর্মবর্ণ এবং বয়স নির্বিশেষে সূর্যোদয়ের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নতুন বাংলা বছরকে বরণ করে নিতে নানা আঙ্গিকের আনন্দ উল্লাসে মেতে ওঠে। এটি এমন একটি দিন যেদিন প্রত্যেক বাঙালী একে অপরকে নব প্রত্যাশায় আলিঙ্গন করে, শুভ কামনা করে। এ দিনটিতে সরকারী ছুটি থাকে যেন সবাই প্রাণভরে এ দিনটি উদযাপনে মুখর হতে পারে। একই সঙ্গে সরকার বৈশাখী ভাতার প্রচলনও করেছে। ধর্ম নির্বিশেষে সব শ্রেণী-পেশার সকলেই পেয়ে থাকেন এই ভাতা। এ যেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক অসাধারণ প্রতিফলন। কিন্তু বাঙালী সমাজের এই অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে বার বার আঘাত করা হয়েছে। কিন্তু কেন? কেন বাঙালীর এই শাশ্বত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি ক্রোধ ও আঘাত? মুসলিম ধর্মের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সঙ্গে বাংলা নববর্ষের ঐতিহ্য ও তা লালনের বিষয়টি মানানসই নয় বলে কেউ কেউ মনে করেন এবং বর্ষবরণের অনুষ্ঠান থেকে নিজেকে দূরে রাখেন। রাখতেই পারেন। এটি তার একান্ত নিজস্ব ভাবনা প্রসূত একটি বিষয়। কিন্তু তিনি কি এটি বলতে পারবেন যে, বোমা মেরে মানুষ হত্যা করে এমনতর বর্ষবরণের নির্মল আনন্দানুষ্ঠান প্রতিরোধের অপচেষ্টা ইসলাম ধর্ম অনুমোদন দেয়? আমি কোন ত্রিকালজ্ঞ নই, তারপরও এটি দ্বিধাহীনভাবে বলতে পারি যে, না, প্রশ্নই ওঠে না এটি ভাবার যে, শান্তির ধর্ম ইসলাম ঐরূপ বিধ্বংসী কোন কাজে অনুমোদন দেয়। প্রিয় নবী মোহাম্মদ (সাঃ) এবং পবিত্র ধর্ম ইসলাম কর্তৃক এ ধরনের কার্যকলাপ অনুমোদিত এমন কোন প্রমাণ নেই। আজকাল স্যাটেলাইটের যুগে আমরা সারা বিশ্বের খবর পেয়ে থাকি মুহূর্তের মধ্যেই। ধর্মান্ধতায় যারা বিভোর তারা এখন মানুষের খাদ্যাভ্যাসও নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। কে গো মাংস খাবে আর কে পাঁঠার মাংস খাবে বা কুমিরের মাংস খাবে এটা তার নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার। কোন খাবারের ব্যাপারে ধর্মীয় বিধিনিষেধ থাকলে এটা সেই ধর্মাবল¤¦ীর ওপরই বর্তায় অন্য ধর্মাবল¤¦ীর ওপর নয়। পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রে কিছু উগ্রবাদী হিন্দু কিছুদিন পূর্বে কি কা-ই না ঘটাল। সম্প্রতি নিউজিল্যান্ডের মসজিদের ভেতর নৃশংস হত্যাকা-ের ঘটনা কি খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের মুখ উজ্জ্বল করেছে? আমাদের আরেক পার্শ¦বর্তী রাষ্ট্র মিয়ানমারে কি ঘটতে দেখলাম। বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধের অমোঘ বাণী ‘জীবে প্রেম করে যে সেজন সেবিছে ঈশ্বর’, ‘জীব হত্যা মহাপাপ’ এর আদর্শ ভুলে গিয়ে উগ্রবাদী বৌদ্ধরা রাখাইন রাজ্যের মুসলিমদেরকে নির্বিচারে হত্যা করেছে। পুড়িয়ে মেরেছে তাদের অনেককে। তাদের এ আচরণ কি বিশ্বের বৌদ্ধ ধর্মাবল¤¦ীদেরকে একটি লজ্জাকর পরিস্থিতিতে ফেলেনি? অন্যদিকে বাংলাদেশ তার চির লালিত অসাম্প্রদায়িক চেতনা থেকে দশ লক্ষাধিক মিয়ানমারের নাগরিককে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে বিশ্বে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বাংলাদেশ সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী নিঃসন্দেহে একটি অনন্য মানবিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। আরও একটি সুখবর হলো, মিয়ানমারের মুসলিমদের প্রতি উগ্রবাদী বৌদ্ধদের আচরণের বদলা হিসেবে এ দেশের মুসলিমরা কোনরূপ খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেনি। যা হোক, উগ্রবাদী ধর্মবিশ্বাসীরা কেন এ রকম আচরণ করে? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা যায় বিভিন্ন ধর্ম বিশ্বাসে বিশ্বাসীগণ নিজস্ব ধর্ম পালনের সময় অনেক ক্ষেত্রে ভুলে যান যে প্রত্যেকের ধর্ম ও এর আচার তার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রত্যেক মানুষেরই নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা আমাদের সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত (অনুচ্ছেদ-৪১)। মানুষ যখন হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে ভাল-মন্দের বিচার করতে অপারগ হয়ে পড়ে তখনই সে অন্য ধর্মাবলম্বীর ওপর চড়াও হয়। কেননা তার নিজ ধর্মের অনুশাসন ও নিষেধগুলোও তখন তার মাথায় আর কাজ করে না। ইসলামসহ পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য ধর্মগুলোর কোথাও অপরের ধর্মকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার কোন কথা বলা হয়নি। তাহলে কতিপয় মানুষ কেন একে অপরের ধর্মের প্রতি বিষোদগার করে? কেনই বা হানাহানিতে লিপ্ত হয়? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা গেছে যে মানুষ তার ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য এবং রাজনৈতিক ফায়দা লাভের জন্য ধর্মকে ব্যবহার করেছে যথেচ্ছভাবে। আমরা দেখেছি, যখন কোন গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় তাদের তথাকথিত শক্তিমত্তা প্রদর্শন করতে চেয়েছে তখনই তারা ধর্মকে ব্যবহার করেছে। ধর্মকে ব্যবহার করে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টির এই প্রবণতা তথাকথিত শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যেও যথেষ্ট পরিমাণে পরিলক্ষিত হয়। এর একটি কারণ হলো যারা শিক্ষার্থীদের ছোটবেলায় শ্রেণীকক্ষে পাঠদান করে শিক্ষিত করে তুলেছেন তাদের অধিকাংশই অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন না। যদি কোন শিক্ষক অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী না হন তাহলে শিক্ষার্থীদেরকে তিনি অসাম্প্রদায়িক হওয়ার কথা বা অপসাম্প্রদায়িক আচরণ করতে শেখাবেন না এটাই স্বাভাবিক। ছোটবেলা থেকে যদি কোন শিক্ষার্থী অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বেড়ে না ওঠে তাহলে তার পক্ষে প্রাপ্ত বয়সকালে অসাম্প্রদায়িকতার আদর্শ লালন করা কঠিন হয়ে পড়ে। শিক্ষা জীবনের শুরুতে তাকে যে শিক্ষা দেয়া হয়েছে তার থেকে বেরিয়ে আসা তার পক্ষে সাধারণত সম্ভব হয় না। তবে ব্যতিক্রম সর্বত্রই আছে। যারা চোখ-কান খোলা রেখে নিজের চেষ্টায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতির পাশাপাশি ধর্মীয় বক্তব্যের অন্তর্নিহিত অর্থ অনুধাবন করতে পারেন তারাই হলেন ব্যতিক্রম। তাই একটি সমাজকে বিশেষত আমাদের সমাজকে একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সমৃদ্ধ সমাজে পরিণত করতে হলে পাঠশালা, মক্তবে বা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা শিক্ষা প্রদান করেন তারা অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ কিনা তা দেখতে হবে সবার আগে। এক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের এই উপমহাদেশে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার পিঠস্থান বলা চলে কলকাতাকে। বঙ্গভঙ্গের পূর্ব পর্যন্ত একটি দীর্ঘ সময় কলকাতা ছিল ভারতবর্ষের রাজধানী। বর্তমানে আমাদের দেশে যে ইংরেজী কারিক্যুলামে লেখা-পড়া চলছে তার গোড়াপত্তন ইংরেজদের হাত ধরেই হয়েছিল এই অবিভক্ত বাংলায় বা ভারতবর্ষে। ইংরেজরা তাদের স্বার্থেই এ ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিল। তাদের শাসন পরিচালনায় সহায়তার জন্য একটি ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত সমাজ তাদের প্রয়োজন ছিল। তখন সমস্ত প্রশাসনিক জনবল বিলেত থেকে আনা সম্ভব ছিল না। ইংরেজরা এটা অনুধাবন করে তাদের অফিসের কার্যবলীতে সাহায্য করতে এ রকম একটি সাপোর্ট টিম তৈরির মানসে সর্বজনীন ইংরেজী শিক্ষার প্রবর্তন করে। ধীরে ধীরে এই শিক্ষা ব্যবস্থাটির বিস্তৃতি ঘটে এবং উপমহাদেশের সর্বত্রই ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি ইংরেজী কারিক্যুলামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে থাকে। কিন্তু দেখা যায়, কলকাতায় বা তার আশপাশে যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে সেগুলোর মধ্যে অধিকাংশই ছিল হয় উচ্চবর্ণ হিন্দুদের জন্য বা খ্রীস্টানদের জন্য। এক্ষেত্রে একটি ব্যতিক্রম ধর্মী উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায় ‘হুগলী হাজী মহসিন কলেজ’ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে। হাজী মহম্মদ মহসিন জন্মেছিলেন ১৭৩০ বা ১৭৩২ খ্রিস্টাব্দে আর মৃত্যুবরণ করেন ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে। তার মৃত্যুর ৬ বছর পূর্বে তিনি একটি ওয়াক্ফ দলিল সৃষ্টি করে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত তার প্রায় সমস্ত ভূসম্পত্তি কয়েকটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং দান খয়রাতমূলক কাজের জন্য উৎসর্গ করে যান। তিনি তার এই দলিলে ‘মুরাসিম’ (প্রচলিত প্রথা) ও ‘মুশারিফ্-এ-হাস্নাহ্’ (পরোপকারমূলক কাজের জন্য ব্যয়) এই শব্দগুলো ব্যবহার করেছেন। সুস্পষ্টতই তার ওয়াকফ বা উৎসর্গীকৃত সম্পদের ব্যবহারের জন্য দু’ধরনের কাজের নির্দেশ করেছেন। কিছু প্রথাগত ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জন্য ব্যয় এবং বাকি অংশ জনহিতকর কাজের জন্য ব্যয়। হাজী মহম্মদ মহসিনের পক্ষে এই ধরনের নির্দেশ প্রদান ছিল খুবই স্বাভাবিক। কারণ, তার ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী তিনি দুনিয়া ও আখেরাত এই উভয় জগতের প্রতি কর্তব্যকেই গুরুত্ব দিয়ে একটি সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেছেন। হাজী মহসিন তার বিপুল সম্পদের বার্ষিক আয়ের ৩৩.৩% শতাংশ রেখেছেন ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির জন্য আর বাকি ৬৬.৭% শতাংশ আয় নির্ধারিত রেখে গেছেন ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্কহীন জনহিতকর স্যাকুলার কাজের জন্য। তার মৃত্যুর পর ওয়াক্ফ দলিলে প্রদত্ত তারই নির্দেশনা অনুযায়ী ১৮৩৬ সালে হুগলির চুচুরায় প্রতিষ্ঠিত হয় হুগলি মহসিন কলেজ। হাজী মহসিনের ওয়াকফ সম্পত্তির আয় থেকে এক পর্যায়ে ‘মহসিন এনডাওমেন্ট ফান্ড’ নামের একটি তহবিল গঠিত হয়। এই ফান্ডের টাকা দিয়েই মহসিন কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। কলেজটির নাম প্রথমে ছিল ‘কলেজ অব মহম্মদ মহসিন’ পরে হুগলি কলেজ এবং তারপর হুগলি মহসিন কলেজ। এই কলেজটি প্রতিষ্ঠার আগের ও পরের কালপর্বে বাংলা তথা ভারতবর্ষের উচ্চশিক্ষার প্রেক্ষিতে কলেজ অব মহম্মদ মহসিন বা ‘হুগলি মহসিন কলেজ’ এর এক অনন্য সাধারণ ভূমিকা রয়েছে। ১৮৩৬ সালের পূর্বে সারা বাংলায় তথা ভারতবর্ষে যেসব কলেজ প্রতিষ্ঠা লাভ করে তার কোনটিতেই সকল ধর্মের মানুষের শিক্ষা গ্রহণের অধিকার ছিল না। ১৮১৭ সালে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার পূর্বে ১৮১৬ সালের ২৭ আগস্ট একটি সাধারণ সভায় কলেজের জন্য যে নিয়মাবলী তৈরি হয় তার প্রথমটি হলো The primary object of this institution is, the tuition of the sons of respectable Hindoos.... ১৮১৮ সালে ও ১৮২০ সালে প্রতিষ্ঠিত যথাক্রমে শ্রীরামপুর কলেজ ও বিশপস কলেজ শুধু খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের শিক্ষা লাভের জন্যই সীমিত ছিল। ১৮২৪ সালে প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃত কলেজে শুধু উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ ছাত্রদের ভর্তির অনুমতি দেয়া হতো। ১৮৩৬ সালে লা মার্টিনিয়ার স্কুল শুরু করা হয়েছিল কলকাতার খ্রীস্টান অধিবাসীর সন্তানদের শিক্ষালাভের জন্য। কিন্তু হাজী মহম্মদ মহসিন এনডাওমেন্ট ফান্ডের অর্থে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত কলেজ অব মহম্মদ মহসিন হিন্দু, মুসলমান, খ্রীস্টান সকল ধর্ম ও শ্রেণীর ছাত্রদের শিক্ষালাভের জন্য উন্মুক্ত ছিল। তবে তখনকার সামাজিক অবস্থায় ছাত্রদের অধিকাংশই ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের, কিছু মুসলিম ও কিছু খ্রীস্টান ছাত্রও এই কলেজে অধ্যয়ন করত। পরবর্তীকালেও এই চিত্রের তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি। যাহোক, ১৮৪১ সালে ঢাকা কলেজ, ১৮৪৬ সালে কৃষ্ণনগর কলেজ, ১৮৫৮ সালে কটকের র‌্যাডেনশ কলেজ, ১৮৬৯ সালে চিটাগং কলেজ এবং ১৮৭৩ সালে রাজশাহী কলেজ স্থাপিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত পূর্বভারতে সকল ধর্ম ও শ্রেণীর ছাত্রদের ইংরেজী ও জ্ঞান বিজ্ঞানের পঠন পাঠনের জন্য ‘কলেজ অব মহসিনই’ ছিল একমাত্র অসাম্প্রদায়িক একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যদি ছাত্রদেরকে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণের পাঠদান না করে তবে কোমলমতি ছাত্রদের ভবিষ্যত জীবনাচার ও দর্শন অসাম্প্রদায়িক না হওয়ারই কথা। হাজী মহম্মদ মহসিন আজ থেকে প্রায় সোয়া দুইশত বছর পূর্বে যে অসাম্প্রদায়িক সমাজের চিন্তা করে গেছেন আজ আমরা কেন তা করতে পারছি না। হাজী মহম্মদ মহসিন একদিকে যেমন ধর্মপ্রাণ মুসলিম ছিলেন ঠিক তেমনই ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার একজন মানুষ। ওয়াকফ দলিলে তার সম্পদ বণ্টনের আনুুুুপাতিক হার দেখলেই বোঝা যায় তিনি কি রকম অসাম্প্রদায়িক মানসিকতা পোষণ করতেন। আমাদের দেশে যে নববর্ষ উদযাপনের আয়োজন হয় তা এক অসাম্প্রদায়িক চেতনা থেকেই করা হয়। এ দেশের সকল ধর্ম-বর্ণ ও শ্রেণীর মানুষ তাদের নিজ নিজ ধর্ম পালনের পাশাপাশি একে অপরের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে এটাই আজকের সভ্য সমাজের প্রত্যাশা। আর এ প্রত্যাশা পূরণে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারেন দেশের শিক্ষিত সমাজ। বিশেষত সম্মানিত শিক্ষক শ্রেণী যারা বিভিন্ন স্কুল, কলেজ-মাদ্রাসা বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান করে থাকেন। কারণ, তাদের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনার মধ্য দিয়ে। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে বাঙালীরা একত্রিত হয়ে সেøাগান তুলেছিল তুমি কে, আমি কে বাঙালী বাঙালী। তোমার আমার ঠিকানা পদ¥া, মেঘনা, যমুনা। বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার হিন্দু, বাংলার খ্রীস্টান, বাংলার মুসলমান আমরা সবাই বাঙালী, এই এক মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েই বাংলার দামাল ছেলেরা যে রক্ত ঢেলে দিয়ে দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করেছে সে রক্ত হিন্দুর না মুসলমান না খ্রীস্টানের এ প্রশ্ন তখন ওঠেনি। সমস্ত বাঙালীর রক্ত একাকার হয়ে লাল হয়ে উঠেছিল পদ্মা, মেঘনা আর যমুনার প্রবাহ। এই চেতনার ওপর ভিত্তি করেই বঙ্গবন্ধু নির্মাণ করেছিলেন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। ধর্মের বিকৃত ব্যাখা, ভিন্ন ধর্মাবল¤¦ীদের প্রতি অনুদার ও অনাকাক্সিক্ষত ভাবনা থেকেই সাম্প্রদায়িকতার বিকাশ ঘটে, মানবতার মূল্যবোধে সৃষ্টি করে ক্ষতের। সমাজকে করে অস্থির, সাম্প্রদায়িকতার অবস্থান মানবতা ও মানব সম্প্রীতির বিপরীতে। বাঙালী জাতির কাছে এটি কাক্সিক্ষত নয়। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে এবং স্বাধীনতা অর্জনে যে ত্যাগ তা কোন নির্দিষ্ট ধর্মের জনগোষ্ঠীর ছিল না। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে স্বাধীনতাকামী বাঙালী জনগোষ্ঠীর স্বপ্ন ও সীমাহীন ত্যাগের ফসল আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। আর এ বাংলার মানুষ আজ নববর্ষ উদযাপন করছে সেই চেতনা থেকে। এ চেতনাকে আজীবন লালন করতে হবে। দেশকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত করতে হলে শিক্ষাবিদ ও শিক্ষিত সমাজকে আরও বেশি করে এগিয়ে আসতে হবে অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে সর্বজনীন করে তোলার জন্য। শুধু তাহলেই কখনও লক্ষ্যভ্রষ্ট হবে না বাংলাদেশ।
×