ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

শিশুর ভাষা সমস্যা

প্রকাশিত: ১২:৪১, ১৪ মে ২০১৯

শিশুর ভাষা সমস্যা

রোগ শোকের কারণে একটি স্বাভাবিক শিশুর শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি যেমন হঠাৎ করে থেমে যেতে পারে। তেমনিভাবে বিভিন্ন স্নায়ুজাত ও শারীরিক প্রতিবন্ধকতার দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে একটি শিশুর ‘ভাষা বিকাশ’ পর্বটি পরিপূর্ণ নাও হতে পারে, অথবা তার বিকশিত ভাষা দক্ষতাটি হারিয়েও যেতে পারে। আজকের পৃথিবীতে ‘ভাষা সমস্যা’ এক অনিবার্য বাস্তবতা। পৃথিবীর সব ভাষা সমাজেই ভাষা সমস্যায় আক্রান্ত শিশু পাওয়া যায়। ভাষা সমস্যা শুধু বর্তমান সময়ের সমস্যা নয়, বরং সব যুগেই এর অস্তিত্ব ছিল। যেহেতু ‘ভাষা সমস্যা বিষয়টি সম্পর্কে মানুষ তখন তেমনভাবে সচেতন ছিল না, সেহেতু এ ধরনের সমস্যা নিয়ে তাদের ভাবনার তেমন একটা অবকাশও ছিল না। তার একটি অন্যতম কারন হচ্ছে, তখন ভাষা সমস্যা ছাড়াও আরও অনেক তীব্র ও দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক ও মানসিক সমস্যাদি বর্তমান ছিল, যার দরুন সে সময়কার মানুষ এ সমস্যা সম্পর্কে সচেতন থাকার তেমন কোন প্রয়োজনীয়তা বোধ করতেন না। প্রাথমিক পর্যায়ের উপসর্গ সাধারণভাবে ‘ভাষা সমস্যা’ অভিধাটি ইঙ্গিত করে এমন একটি ভাষিক অবস্থা যার ফলে তার স্বাভাবিক ভাষাগত উপাদানসমূহের বিকাশ বা বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। শিশুর ভাষাগত সমস্যা প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু উপসর্গের দ্বারা প্রকাশ ঘটে এর মধ্যে অন্যতম উপসর্গ হলো শিশুর মানসিক এবং আবেগগত বহিঃপ্রকাশের সমস্যা। এই ধরনের সমস্যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব তার নির্বাহী নিয়ন্ত্রণ সক্ষমতা থেকে শুরু করে সামাজিক দক্ষতা বা বুদ্ধিদীপ্ততার (Intelligence) সার্বিক বিচ্যুতি বা বিকার (Impairment) পর্যায় পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে। শিশুর ভাষা বিকাশের ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রতিবন্ধকতার দুটি মাত্রা আছে, একটি হচ্ছে ভাষা বিলম্ব এবং অন্যটি হচ্ছে ভাষা বৈকল্য। - (১) ভাষা বিলম্ব (Language delay) ভাষা বিলম্ব হচ্ছে ভাষা বিকাশের এমন একটি অবস্থা যাতে শিশুর ভাষাগত উপাদানসমূহ যেমন- ধ্বনি, অক্ষর, শব্দ, বাক্য ইত্যাদি উপাদানসমূহের দেরিতে বিকাশ ঘটে। এ ধরনের ভাষা বিলম্ব যদিও গুরুতর ভাষা সমস্যা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় না, তথাপি কোন শিশুর মধ্যে যদি ভাষা বিলম্বের উপসর্গ পরিলক্ষিত হয় তাহলে দেরি না করে যে কোন মানসিক এবং ভাষা বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাওয়া বাঞ্ছনীয়। ২) ভাষা বৈকল্য (Language disorder):- ভাষা বৈকল্য হচ্ছে ভাষা অনুধাবন এবং ব্যবহার। বিশেষ করে বাচনিক এবং অবাচনিক এ সংক্রান্ত প্রতীকী চিহ্নসমূহের ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিকারগ্রস্ত একটি বিশেষ অবস্থা। শিশুর ভাষা বৈকল্য সাধারণত তার মস্তিষ্কের কোন না কোন অসম্পূর্ণতা বা ক্ষতির কারণে হয়ে থাকে। তবে শিশুর মস্তিষ্কের ক্ষতি বা প্রদাহ যদি তার স্বাভাবিক ভাষা বিকাশের পরে হয় এবং এ কারণে ভাষা সমস্যা দেখা দেয়, তখন এ ধরনের ভাষা বৈকল্যকে অর্জিত ভাষা বৈকল্য (Acquired language disorder) বলা হয়। আর মস্তিষ্কের অসম্পূর্ণতা বা অদৃশ্য ক্ষতি যদি শিশু তার জন্মের সময় নিয়ে আসে এবং তার ফলে শিশুর ভাষা সমস্যা দেখা যায়, তখন তাকে বর্ধনমূলক ভাষা বৈকল্য (Developmental language disorder) বলা হয়। ভাষা সমস্যার কারণ উপরে উল্লিখিত মাত্রা দুটি ‘ভাষা সমস্যার’ সম্ভাব্য কারণ হিসেবে ধরে নেয়া হয়। নিম্নে কিছু কারনের বিষয়ভিত্তিক আকারে সাজিয়ে প্রকাশ করা হলো- (১) বংশগত বা জন্মকালীন কারণ- বংশগত ভাষা বৈকল্য অপরিপক্ব জন্ম। (২) চিকিৎসা বিজ্ঞানগত কারণ- শ্রবণ সমস্যা ক্লেপ্ট পেলেট অটিজম বর্ণালী বৈকল্য দীর্ঘকালীন শারীরিক সমস্যা (৩) পারিবারিক/পরিবেশগত কারণ ভাষা সমস্যার পারিবারিক ইতিহাস। পিতা মাতার জ্ঞানমূলক সীমাবদ্ধতা। পালক পিতা মাতা কর্তৃক অবহেলিত শিশু। প্রধান উপসর্গ উপরিউক্ত কোন কারণে যদি শিশু ‘ভাষা সমস্যায়’ আক্রান্ত হয়, তাহলে আক্রান্ত শিশু এমন কিছু উপসর্গ প্রদর্শন করে যা দেখে শিশুটি যে ভাষা সমস্যাগ্রস্ত, তা সহজেই শনাক্ত করা যায়। আপনার শিশুটি ভাষা সমস্যায় আক্রান্ত কি না, তা প্রধান কিছু উপসর্গ দিয়ে সহজেই শনাক্ত করতে পারবেন। নিম্নে উপসর্গগুলো লিপিবদ্ধ করা হলো- (১) মানসিক এবং আবেগগত বহিঃপ্রকাশের সমস্যা। (Behavioral problem) (২) সরাসরি বক্তার দিকে মুখ তুলে চোখে চোখে (Eye contact) না তাকানো। (৩) ভাষা অনুধাবনের ক্ষেত্রে (Reception of language/conceptual domain) তাৎপর্যপূর্ণ ঘাটতি। (৪) শিশুর আয়ত্তকৃত শব্দের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক কম। বিশেষ করে, ‘যাই’, ‘করি’, ‘খাই’ ইত্যাদি পরিচিত ক্রিয়াপদ ব্যতীত বৈচিত্র্যময় ক্রিয়াপদের সংখ্যা নেই বললেই চলে। (৫) সংলাপ (Conversation) চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা। (৬) সমবয়সীদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ (Peer relationship) হতে সমস্যা। (৭) কিছু স্বরের পুনঃপুন অনুকরন ((Imitative Babble)। (৮) প্রতীকী খেলা (Symbolic play) খেলতে অসামর্থ্য। একটি স্বাভাবিক শিশুর ৪-৫ বছরের মধ্যে মৌলিক ভাষা সমন্বয় ভিত্তি (Basic language development) গঠিত হয়ে যায়, তবে আয়ত্তকরণ শব্দাবলীর প্রক্রিয়াটি পূর্ণবয়স্ক হওয়ার পরও চলতে থাকে। কেননা আমরা ঐ সময়কালে বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানগত ধারণা ও বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত হই যেগুলো ক্রমাগত আমাদের শব্দ সম্ভারকে (Mental lexicon) সমৃদ্ধ করতে থাকে। তবে মনে রাখতে হবে, যদি কোন শিশু ৪-৫ বছরের মধ্যে দৈনিক ৫-১০টি শব্দ দিয়ে পরিবেশ (Situation) এবং প্রতিবেশ (Context) অনুযায়ী মনের ভাব প্রকাশ করতে না পারে তাহলে তা আশঙ্কাজনক বা উদ্বেগজনক লক্ষণ হিসেবে ধরে নেয়া হয়। লেখক : মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসা ভাষাবিদ, সহকারী অধ্যাপক (মনোরোগ বিদ্যা বিভাগ) জেড. এইচ. সিকদার ওমেন্স মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল, ঢাকা
×