ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

উত্তরখানে মা মেয়ে ও ছেলে হত্যা নিয়ে নানা প্রশ্ন

প্রকাশিত: ১০:২৩, ১৪ মে ২০১৯

   উত্তরখানে মা মেয়ে ও ছেলে হত্যা নিয়ে  নানা প্রশ্ন

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ রাজধানীর উত্তরখানের ময়নারটেক এলাকায় মা-মেয়ে ও ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে বলে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ সোহেল মাহমুদ জানিয়েছেন। তবে পুলিশ বলেছেন, হতাশ হয়ে তারা আত্মহত্যা করেছে। এ নিয়ে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে তিন মৃতদেহ সুরতহাল প্রতিবেদনকারী কর্মকর্তা উত্তরখান থানার এসআই রহমতউল্লাহ জনকণ্ঠকে জানান, ঘটনার পর থেকে সিআইডির ক্রাইম সিন ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করেছেন। তিন মৃতদেহে পাশে দুটি চিরকুট জব্দ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সিআইডি ফরেনসিক বিভাগে পাঠানো হয়েছে। আলামত দেখা ধারণা করা হচ্ছে, মা-মেয়ে ও ছেলে এক সঙ্গে আত্মহত্যা করে থাকতে পারেন। তবে এই তিনজনের মৃত্যুর ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলে এখনও পর্যন্ত থানায় মামলা হয়নি বলে উত্তরখান থানার ডিউটি অফিসার এসআই তানিয়া আক্তার জনকণ্ঠকে জানান। উল্লেখ্য, রবিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে পুলিশ রাজধানীর উত্তরখানের ময়নারটেকের ৩৪/বি বাসার তালা ভেঙ্গে জাহানারা খাতুন মুক্তা (৪৭) তার ছেলের নাম মুহিম হাসান রশ্মি (২৮) ও শারীরিক প্রতিবন্ধী মেয়ের আফিয়া সুলতানা মিম (২০) মৃতদেহ উদ্ধার করে। ঘটনার খবর পেয়ে পুলিশেরে উর্ধতন কর্মকর্তারাও ঘটনাস্থলে ছুটে যান। আলামত সংগ্রহের জন্য সিআইডির ক্রাইম সিন বিভাগের সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এছাড়া র‌্যাব, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিআইবি), মহানগর গোয়েন্দা পুলিশসহ পুলিশের অন্যান্য ইউনিটের সদস্যরা ঘটনাস্থলেও ছুটে যান। লাশ উদ্ধারের পর উত্তরা জোনের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার হাফিজুর রহমান রিয়েল জানান, ২/৩ দিন আগে তাদের মৃত্যু হয়েছে। ভেতর থেকে দরজার সিটকিনি লাগানো ছিল। পুলিশ গিয়ে দরজা ভেঙ্গে পচন ধরা মা ও দুই সন্তানের মৃতদেহ উদ্ধার করে। মা ও মেয়ের মৃতদেহ ছিল বিছানায় আর ফ্লোরে পড়েছিল ছেলের মৃতদেহ। তিনি জানান, ঘরের মেঝেতে প্রচুর রক্ত দেখা গেছে। রক্ত কালো রং ধারণ করেছে। ছিল প্রচ- দুর্গন্ধ। পাশে ড্রইং রুমের টেবিলে একটি চিরকুট পাওয়া গেছে। চিরকুটটি মোবাইল ফোন দিয়ে চাপা দেয়া ছিল। চিরকুটে লেখা ছিল, আমাদের মৃত্যুর জন্য ভাগ্য ও আমাদের আত্মীয়-স্বজনের অবহেলাই দায়ী। আমাদের মৃত্যুর পর আমাদের সম্পদ গরিবদের মাঝে বিলিয়ে দেয়া হোক। ইতি জাহানারা বেগম। এডিসি হাফিজুর রহমান রিয়েল জানান, উত্তরখানের ওই বাসাটি মা-মেয়ে ও ছেলে দেড় মাস আগে ভাড়া নিয়েছিলেন। ছেলে মুহিম হাসান বেকার ছিলেন। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ৪০তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষাতেও অংশ নেন তিনি। পুলিশ প্রাথমিকভাবে ধারণা করে, ওই তিনজন আত্মহত্যা করেছেন। এদিকে সোমবার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে মা-মেয়ে ও ছেলের মৃতদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। ময়নাতদন্ত শেষে দুপুরে ঢামেক ফরেনসিক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ সোহেল মাহমুদ জানিয়েছেন, ওই তিনজনকে হত্যা করা হয়েছে। অন্তত ৭২ ঘণ্টা আগে তাদের মৃত্যু হয়। তিনি জানান, মা জাহানারা বেগমের গলায় ও পেটে ছুরিকাঘাতের হালকা দাগ রয়েছে। তবে তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া মেয়ে তাসফিয়া সুলতানা মিমকে গলায় গামছা পেঁচিয়ে হত্যা করা হয়েছে। জাহানারা বেগমের ছেলে মুহিম হাসানকে হত্যা করা হয়েছে গলা কেটে। পুলিশ যখন লাশ উদ্ধার করে তখন কক্ষটি তালাবদ্ধ অবস্থায় ছিল? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে সোহেল মাহমুদ জানান, ওই বাসার লকটি কোন অবস্থায় ছিল সেটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে জানতে পারব। এছাড়া মৃতদেহ তিনটির ভিসেরা আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। ভিসেরা প্রতিবেদন এলে হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাবে। তিনি জানান, ধারণা করা হচ্ছে ৭২ ঘণ্টা আগে তাদের হত্যা করা হয়েছে। সুতরাং হত্যার অনেক আলামতই এই সময়ের মধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে। তারপরও আমরা নিশ্চিত হতে পেরেছি ওই তিনজনকে হত্যা করা হয়েছে। তিন মৃতদেহ সুরতহাল প্রতিবেদনকারী কর্মকর্তা এসআই রহমত উল্লাহ জনকণ্ঠকে জানান, ওই দুটি চিরকুটের লেখা নিহত ব্যক্তিরাই লিখেছেন নাকি। অন্য কেউ তাদের হত্যার পর মোটিভ অন্যদিকে নেয়ার জন্য লিখেছে। তা নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। খুব শীঘ্রই এই মৃত্যুর রহস্য উদঘাটন করা হবে। অন্যদিকে ঢামেক মর্গে সামনের নিহতের স্বজনদের ধারণা, মা-মেয়ে ও ছেলে আত্মহত্যা করতে পারেন। কেউ তাদের খুন করতে পারে বিষয়টি ভাবতে পারছেন না তারা। নিহত মুহিমের চাচা মোহাম্মদ হাসান উল্লাহ জানান, আমার ভাবি গৃহিণী ছিলেন। ছেলেও ছিল বেকার। আর মেয়েটা ছিল শারীরিক ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। আমার ভাই সরকারী কর্মচারী ছিলেন। ভাইয়ের মৃত্যুর পর পেনশনের টাকায় তাদের খরচ চলছিল। এছাড়া আত্মীয়-স্বজনরাও সাধ্যমতো পাশে দাঁড়াতেন। তাদের তেমন কোন আর্থিক সঙ্কট ছিল না। হাসান উল্লাহ আরও জানান, মিমের বয়স ২০ বছর। তার ভবিষ্যত নিয়ে পরিবারটি হতাশাগ্রস্ত ছিল। হতাশা থেকে তিনজনই আত্মহত্যা করতে পারে বলে আমাদের ধারণা। নিহতের স্বজনরা জানান, কারও সঙ্গে তাদের কোন বিরোধও ছিল না। অতিরিক্ত হতাশা থেকে ওই তিনজন আত্মহত্যা করতে পারেন। তারা জানান, মৃত জাহানারার বাড়ি কুমিল্লার তিতাস উপজেলার বাড়িকান্দি গ্রামে। আর তার স্বামী ইকবাল হোসেনের বাড়ি কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার জগন্নাথপুর গ্রামে। ইকবাল হোসেন বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ডে চাকরি করতেন। তিন বছর আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি। এরপরে ওই দুই সন্তান এবং তাদের মা ঢাকার কাফরুলে তার বোনের বাসার পাশে থাকতেন। আড়াই মাস আগে তারা তিনজনই ভৈরব চলে যান। সেখান থেকে ঢাকায় এসে উত্তরখানে বাসা ভাড়া নেন।
×