ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিএনপির শুভবুদ্ধির উদয় হলো কি?

প্রকাশিত: ০৯:০২, ১৪ মে ২০১৯

বিএনপির শুভবুদ্ধির উদয় হলো কি?

বিএনপির সংসদে যাওয়ার নাটকদৃষ্টে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটি কবিতার চরণ মনে পড়ে গেল : কবি লিখেছিলেন, ‘ঢের দেখালি ঢাক ঢাক আর গূঢ় গূঢ় এই মিথ্যা ছল।’ সংসদে না যাওয়ার ব্যাপারে এতকাল বিএনপি হাইকমান্ড আর ড. কামাল হোসেনের ঐক্যফ্রন্ট নেতৃবৃন্দ কত কথার ফুলঝুরিই না শোনালেন! অবশেষে, সুড় সুড় করে সংসদে চলে এলেন বলতে গেলে সবাই শুধু বিএনপির ডাক-সাইটে ও করিৎকর্মা মহাসচিব বাহাদুর মির্জা ফখরুল ইসলাম বাদে। তিনি সংসদে নিজের যোগ না দেয়ার এবং অন্যান্যের যোগদানের ব্যাপারে যে বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন, তা এতই হেঁয়ালিপূর্ণ যা বলার নয়! জানা যায়, দলের সেকেন্ড ইন কমান্ড তারেক জিয়ার নির্দেশেই নাকি বিএনপি এমপিরা সংসদে যোগ দিয়েছেন! আর তাই যদি সত্যি হবে তাহলে মির্জা সাহেবের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হওয়ার কারণ কি? বহুদিন পর বিএনপির সার্বিক ভঙ্গুর দশা। দেখে ভানুমতির খেল আবার দেখা গেল! এই সময়ের মধ্যে বিএনপির একমাত্র উপায় হবে মুক্তিযুদ্ধের মূল ধারায় নিজেকে সমর্পণ করা। বিএনপি যদি তার জন্মকালীন সেই বস্তাপচা পাকিস্তানী প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারে, তাহলে বিএনপিওয়ালারা নিজেদের যতই এক বিরাট দলের নেতাকর্মী বলে ভাবুনা না কেন এর পরিণতি যে অচিরেই মুসলিম লীগের মতো হবে তা বলাই বাহুল্য! একটি রাজনৈতিক দল এত ছলাকলা করে টিকে থাকতে পারে না নিশ্চয়ই! জন্মের পর থেকেই কেবল একটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বেপরোয়া মিথ্যাচার, ছল-চাতুরী, চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র আর প্রতারণামূলক রাজনীতির চর্চা করে এসেছে দলটি। আর তা হচ্ছে পাকিস্তানী কায়দায় বাংলাদেশকে তথাকথিত মুসলিম লেবাস পরিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল ও ‘মুসলিম-ধর্মাশ্রয়ী’ এক সন্ত্রাসী রাষ্ট্রে পরিণত করা। আর জনগণের ওপর শোষণ-বঞ্চনার সেই পাকিস্তানী কৌশলটিকে বজায় রাখা। তাই বিএনপির পালের গোদা জিয়াউর রহমানকে দেখা যায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর গণতন্ত্রের নাম ভাঙিয়ে সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতারোহন, একটি অভিনব দল গঠন (বিএনপি) এবং ভারতের প্রতি তীব্র বিদ্বেষ ছড়িয়ে পাকিস্তানের প্রতি পুনরায় প্রেম জাগিয়ে তোলার এক হীন পন্থা অবলম্বন করতে। তার নির্মম মৃত্যুর পর অপর এক সেনা কর্মকর্তা তো পাকিস্তানের ঢাকের কাঠি হয়েই আত্মপ্রকাশ করলেন। ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের সংবিধানের কাঁধের ওপর রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে চাপিয়ে দিয়ে এমনই ইসলাম-প্রীতি দেখালেন যে, যার কবলে পড়ে দেশের আম- ছালা দুই-ই রসাতলে যাওয়ার উপক্রম হলো! অথচ ব্যক্তি জীবনে এই জে. এরশাদ ইসলাম ধর্মকে নিয়ে যে ধরনের হুজ্জতি করে গেছেন, তা যে কোন ন্যায়পরায়ণ মানুষের মনে তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি না করে পারে না। আর দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ প্রদান, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিকিকিনি, মুক্তিযোদ্ধাদের হেয় প্রতিপন্ন এমনকি নির্বিচার হত্যা জিয়া- এরশাদ অত্যন্ত পারঙ্গমতার সঙ্গেই করে গেছেন মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের অস্তিত্বটিকেই ধ্বংস করে দিতে। আর এক্ষেত্রে পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর হাতের পুতুলরূপে কাজ করে গেছেন তারা। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির সত্যিকারের দুঃসময়ের সূত্রপাত আসলে ঘটেছিল ওই দুই জেনারেলের হাত ধরে। মিথ্যার বেসাতি আর প্রশাসন যন্ত্রের অপব্যবহারের মাধ্যমে আজ এক শ্রেণীর মানুষের কাছে তারা ‘দুধে ধোয়া তুলসীপাতা’ বনে গেছেন বটে; কিন্তু কথায় বলে, ‘পাপ বাপকেও ছাড়ে না’। বর্তমানে বোধকরি তাদের উভয়েরই সেই নিদানকাল উপস্থিত! বিএনপির জন্মবৃত্তান্ত বা জন্ম রহস্যের দিকে আজ দৃষ্টিপাত করলে পুরো ব্যাপারটাই পরিষ্কার হবে যে , এর উদ্দেশ্য-বিধেয় কি ছিল। জিয়াউর রাহমান তো ‘আমি রাজনীতিকদের জন্য রাজনীতিকে দুরূহতম বিষয়ে পরিণত করব’ বলে প্রকাশ্যেই ঘোষণা দিয়েছিলেন’- সে কথা নিশ্চয়ই কেউ এখনও ভুলে যাননি। আর এ জন্য টাকার যে কোন অভাব হবে না তা জানাতেও কিন্তু ভোলেননি তিনি। অতঃপর আমরা রাজনীতির হাটে বিকিকিনির মেলা বসতে দেখলাম। ‘আমারে কে নিবি ভাই সপিতে চাই আপনারে’ এই গানের কলি ভাঁজতে ভাঁজতে একাত্তরে পরাজিত অপশক্তির এক বিরাট বহর জিয়ার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে এলো। মৌলবাদী জামায়াত, নেজামে ইসলামী ও অন্যরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল! পাকিস্তানের তস্য দালাল গোলাম আযম- যে কিনা সে সময় ‘পূর্ব পাকিস্তানকে পুনরায় পাকিস্তানের হয়ে উদ্ধারে’র জন্য প্রকাশ্য তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছিল এবং বাহাত্তর সালে বঙ্গবন্ধুর সরকার যার নাগরিকত্ব বাতিল করে দিয়েছিল, তাকে জিয়া ভিসা দিয়ে বাংলাদেশে আসার ও এখানে তার পুনর্বাসনের পথ করে দিয়েছিলেন। অন্যদিকে, বিশবিদ্যালয়ে পেশীশক্তির ব্যবহার করে আর ছাত্রদের জন্য মালয়েশিয়ার ‘হিজবুল বাহার’ জাহাজে বিলাস ভ্রমণের ব্যবস্থা আর তাদের বিপুল অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহের মধ্য দিয়ে হাত করে প্রকাশ্যে ক্যাম্পাস দখলের যে আয়োজন করেছিলেন জিয়া, তা যে কত ন্যক্কারজনক ছিল তা ভাবতেও আজ গা শিউরে ওঠে! প্রধান সামরিক প্রশাসক বিচারপতি সায়েমকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে অপসারণ করে নিজেই প্রধান সামরিক প্রশাসক বনে গিয়েছিলেন, তা তো সায়েম সাহেব নিজেই পুস্তকাকারে লিখে জানিয়ে দিয়ে গেছেন। এ ছাড়া, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডে জিয়ার পরোক্ষ সমর্থনের কথা হত্যাকারীদের বয়ান থেকেই জানতে পারা যায়। একাত্তরে তাকে কালুরঘাট বেতারকেন্দ্রে ডেকে এনে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করতে বলা হলে কি আশ্চর্য উচ্চাভিলাষের মোহে সেদিন তিনি বঙ্গবন্ধুর নামটিই প্রথমে বাদ দিয়ে নিজেই দেশের ‘সর্বময় কর্তা’ বনার দাম্ভিকতা প্রদর্শন করেছিলেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে এই দেশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে, মসজিদে উলুধ্বনি হবে, আওয়ামী লীগ আগামী চল্লিশ বছরেও আর ক্ষমতায় আসতে পারবে না, গোপালগঞ্জ নামটি আর এদেশে থাকবে না এমনি ধারার আরও কত বয়ান বেগম জিয়া ও তার স্যাঙাতদের মুখে নিত্যদিন উচ্চারিত হয়েছে তখন। এসব উক্তি আজ ধরার ধুলায় হারিয়ে গেছে। ২০১৪ আর ২০১৯ এর নির্বাচন নিয়ে যে ধরনের জালিয়াতিপূর্ণ ও হিংসাত্মক কা--কীর্তি ঐক্যফ্রন্ট আর বিএনপি জোট মিলে করেছে, তার নজির হিটলারের ক্ষমতারোহন পদ্ধতির মধ্যে খানিক খুঁজে পাওয়া যায়। আমাদের প্রধানমন্ত্রী এবং এ সময়ের দেশে-বিদেশে বিশেষভাবে সমাদৃত রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনাকে এবং গোটা আওয়ামী লীগ সংগঠনটিকে সম্পূর্ণভাবে নির্মূলের জন্য তারেক গং গ্রেনেড হামলাসহ যে জঘন্য সব হামলা-আক্রমণ ও অপচেষ্টা একের পর এক চালিয়ে গেছে, তা ওদের সীমাহীন ক্ষমতার লোভ-লালসা আর প্রতিহিংসা পরায়ণতাকেই মেলে ধরে মাত্র! তাই এই দলটি এ সব কারণেই কোন রাজনৈতিক দলের মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে না। যাহোক, বিএনপি অবশেষে সংসদে গেছে। যদিও এই তেলেসমাতি খেলা খেলতে গিয়ে দলটিকে অনেক খেসারত দিয়ে হয়েছে। এখন দেখা যাক, দলের অভ্যন্তরে যে ধরনের ক্ষোভ-রোষ-সন্দেহ- অবিশ্বাস দানা বেঁধেছে তার পরিণতি শেষতক কি দাঁড়ায়! নেতারা বিএনপিকে এখনো ভীষণ জনপ্রিয় দল বলে যতই বড়াই করুন না কেন বাস্তবে বিষয়টা যে কি তা দেখার জন্য আমাদের আরও কিছুকাল অপেক্ষা করতে হবে! বিএনপির আসলে একমাত্র বেঁচে থাকার পথ হচ্ছে জামায়াত ছেড়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অবলম্বন করে রাজনীতি করা। নচেত, সেদিন হয়ত সুদূর নয় যখন দলটির আম-ছালা দুই-ই খোয়ানোর অবস্থা হতে পারে! লেখক : সাংবাদিক
×