ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

এারুফ রায়হার

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৮:৫৭, ১৪ মে ২০১৯

 ঢাকার দিনরাত

দেখতে দেখতে রোজার প্রথম সপ্তাহ চলে গেল। আসলেই কি দেখতে দেখতে গেল? রোজাদাররা ভাল জানেন যে এত সহজে সাত-সাতটা দিন পার হয়নি। এই সাত দিন থেকেছে খটখটা রোদ। কাব্য করে বলতেই পারি- দারুণ অগ্নিবাণে রে। মাথার ওপর সূর্য যে কী পরাক্রমশালী হয়ে উঠেছিল সেটি তারাই ভাল জানেন যারা ছিলেন রোজা, অর্থাৎ ঘাম ঝরানো অসহনীয় রুদ্র বৈশাখের দিনগুলোয় এক ফোঁটা পানি পান করার সুযোগ ছিল না যাদের। সংযম কষ্টকর বটে, তবে এবার সেই কষ্ট যেন চূড়োয় উঠছে। তবু আশায় বসতি। চলতি সপ্তাহে বৃষ্টি হবে, তাপমাত্রা কমবে। অন্তত ইফতারের সময় ৩০ ডিগ্রীর নিচে চলে আসবে তাপমাত্রা, এমনটাই প্রত্যাশা। রোজার মাসে ঢাকার দিন ও রাতে কিছু বড় পরিবর্তন আমাদের নজরে আসে। অফিসের সময়সূচীতে পরিবর্তন আসে বলে নাগরিক জীবনধারা কিছুটা বদলে যায়। সরকারী, বেসরকারী চাকরিজীবী, অন্যান্য পেশাজীবী, ছাত্র-বেকার সবার মধ্যে একটা তাড়না থাকে পরিবারের লোকজনের সঙ্গে ইফতারি করার। ফলে সন্ধ্যার আগের তিনটে ঘণ্টা ঢাকার প্রধান প্রধান সড়কের ওপর চাপ বেড়ে যায়। (এবার দেখছি সকাল থেকেই জনচাপ, যানবাহনের চাপ) চলমান যানবাহনের ভেতর যত যাত্রী অবস্থান করে সে সময়টাতে, তার চেয়ে বরং বেশি মানুষ থাকে যানবাহনে ওঠার প্রতীক্ষায় রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে। রাস্তায় হেঁটে চলা মানুষের সংখ্যাও কম নয়। রাস্তা ভর্তি যানবাহন, রাস্তার দুই পাশে, ফুটপাথে এমনকি রাস্তার ভেতরে খালি জায়গায় মানুষ গিজগিজ করতে থাকে। বেশ কিছু পাবলিক বাস এই সময় নগরীর অতিভিড়াক্রান্ত কয়েকটি এলাকার বাস স্টপেজে রাখা হলে কিছু চাপ যে কমে, তাতে সন্দেহ নেই। একবার ফার্মগেটে কয়েকটি ডবল ডেকার রাখা হয়েছিল অফিস ছুটির পর যাত্রীদের চাপ সামাল দিতে। শুধু ফার্মগেটে নয়, আরও কয়েকটি জায়গায় যাত্রীসুবিধার কথা ভেবে বিশেষ পরিবহনের ব্যবস্থা নেয়া হবে- ঢাকার বাসযাত্রীরা এমনটা ভাবতেই পারেন। এখনও পর্যন্ত এমন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। তাহলে কর্তৃপক্ষ অতীত থেকে আর কী শিক্ষা নিলেন? আরেকটা বিষয় অস্বীকারের উপায় নেই যে রমজানে বাড়তি রোজগারের জন্য হোক, কিংবা কেনাকাটা ও বেড়ানোর জন্য হোক ঢাকার জনসংখ্যা বেড়ে যায়। এমনিতেই ঢাকা পরিণত হয়েছে জটিল জনারণ্যে। তার ওপর এই বড়তি চাপ কিছুতেই নিতে পারে না নগরটি। ফলে যা হওয়ার তাই হয়। রাজপথ বেহাল দশায় পতিত হয়। রমজানে পাগলা ঘোড়া কর্তৃপক্ষ যতই কঠোর হোক, কঠিন প্রচেষ্টা চালিয়ে যাক, তবু রমজানে দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়াকে লাগাম পরানো যায় না। রমজানে ভাজাপোড়া খাওয়ার চল বেড়ে যায় এটা ঠিক। একইসঙ্গে এটাও সত্য যে এই মাসে গরুর মাংসের চাহিদাও বেড়ে যায়। কর্তৃপক্ষ গরুর মাংসের দাম বেঁধে দেন। তাতে কাজ হয় না খুব একটা। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের বিরক্তি ও ক্ষোভের শেষ নেই। এখন এসব প্রকাশের একটা মাধ্যম হয়েছে ফেসবুক। একজন গরুর মাংসের ছবি পোস্ট করে শ্লেষাত্মক ভঙ্গিতে লিখলেন: ইহা গরুর মাংস! ইহার কুনু দোষ নাই। দোষ একটাই দুনিয়ার মুসলমানেরা ইহা খাইতে খুব পছন্দ করে। আমিও পছন্দ করি। কিন্তু আর খাইতে পারিবো কিনা, সন্দেহ জাগিতেছে। এই দেশে গত কয়েক বছর যাবৎ দেখিতেছি, রমজান মাস আসিলে মন্ত্রী, ব্যবসায়ী, টিভির ঠক শো কথক ব্যবসায়ী, ধর্মীয় লোকেরা বলিয়া থাকেন, পবিত্র রমজান মাসে জিনিসপত্রের দাম বাড়ানো উচিত নয়। দুনিয়ার নানান দেশে উৎসবের মাসে বা সময়ে ব্যবসায়ীরা দাম কমায়। আর বাংলাদেশের মুসলমান ব্যবসায়ীগণ ছুরি হাতে অপেক্ষা করে থাকে, এক টাকার জিনিস দশ টাকায় বিক্রি করে মুনাফা লোটার পবিত্র ইচ্ছায়। জামা কাপড় গয়না গাটি বাদ, গরুর মাংস তো এই দেশে আলহাজ মুসলমান ভাইরাই বিক্রি করে থাকেন। নিশ্চয়ই হিন্দু বা খ্রিস্টানরা এসে গরুর মাংসের ব্যবসা করেন না। তাহা হইলে প্রতিবছর রমজান মাসে ৮০ /৯০ টাকা কেজিতে বাড়িবে কেন? আরও মজার ঘটনা, গরুর মাংসের দাম বৃদ্ধির অনুষ্ঠানে সদাশয় মেয়র সাহেব উপস্থিত থেকে ঘোষণা করিয়া থাকেন। মেয়র সাহেবের তো গরুর মাংসের ব্যবসা নাই...। তিনি কেন প্রতিবছর দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়া থাকেন? মাত্র এক কেজি গরুর মাংসের দাম ছয় শত টাকা প্রায়! আমরা কোথায় যাইব? কাহাকে বলিবো বাংলাদেশের গরুর মাংসের মুসলমান ব্যবসায়ীদের এই নির্লজ লোভের ঘটনা? কে শুনিবে? আছে কোন প্রতিকার? প্রতিকার আছে আমাদের হাতে, আসুন আমরা গরুর মাংস কেনা বন্ধ না করতে পারলেও কমিয়ে দিই। এটাই হতে পারে আমাদের শ্রেষ্ঠ অস্ত্র। আপনারা প্রচার করুন এবং লোভী মাংশাসী এইসব দানবদের প্রতিরোধ করি... দেশী ফলের সমাহার ঢাকার পথে পথে এখন রীতিমতো ছোটখাটো ‘ফল বাগান’ চোখে পড়ছে। কোথাও দেখি তরমুজের পাহাড় উঠে গেছে, কোথাও কাঁঠালের সমাহার। বাজারে বোধহয় জায়গা পাচ্ছেন না এসব ফল ব্যবসায়ী। ফলে পথই এখন হাট। পথচলতি রাস্তার ধারে জড়ো করে রাখা নানা রসময় মৌসুমী ফলের বাহ্যিক সৌন্দর্য বহু ঢাকাবাসীর দৃষ্টি কাড়ছে। দেশে নতুন নতুন জাতের আম, মাল্টা, কমলা, ড্রাগন ফলসহ বিদেশী জাতের ফলের আবাদ হচ্ছে। একসময় সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত বিদেশী ফলের ওপর নির্ভরতা ছিল। এখন এই সময়ে দেশীয় ফলের সরবরাহ বাড়ছে। তাজা ও রাসায়নিকমুক্ত ফলে আগ্রহ বাড়ছে মানুষের। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসেবে, গত পাঁচ বছরের ব্যবধানে দেশে ফলের উৎপাদন বেড়েছে ২১ লাখ কেজি। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ফল উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৯৯ লাখ ৭২ হাজার কেজি। পাঁচ বছরের ব্যবধানে গত অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ কোটি ২১ লাখ কেজিতে। এই অর্থবছর শেষেও ফল উৎপাদন আরও বাড়বে বলে আশা করছে কৃষি বিভাগ। বিদেশী ফল বেচাকেনার ভরা মৌসুমেও এখন পাওয়া যাচ্ছে দেশী ফল। এর মধ্যে প্রধান ফল হলো নতুন নতুন জাতের পেয়ারা। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে মৌসুমী ফলের কল্যাণে ঢাকার রূপ যেন কিছুটা বদলে যায়। বিচিত্র রঙের ফলে ভরে ওঠা দোকানগুলো দেখতে ভারি ভাল লাগে, আর তা আমাদের গ্রামের কথাও মনে পড়িয়ে দেয়। গ্রীষ্মে রসাল ফল দেহের জন্য উপকারী তা বলাই বাহুল্য। অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে বেশি পুষ্টি পাওয়ার উপায় হলো মধুমাসে মৌসুমী ফল খাওয়া। বিশেষ করে তরমুজের দুটি ফালি কিংবা কাঁঠালের দশ-বারোটি কোয়া খেলে এক বেলার খাবার হয়ে যায়। ঢাকার শ্রমজীবী মানুষ বলতে সবার আগে যে কয়টি পেশার নাম চলে আসে তার ভেতর রয়েছে রিক্সাচালনা, পোশাক-শ্রমিক ও নির্মাণ-মজুর। এদের সীমাবদ্ধ আয়ের টাকা দিয়ে ক্রয় ক্ষমতা আর কতটুকুই বা অর্জিত হয়। তাই রাজধানীতে রাস্তার পাশে এদেরই এক ফালি তরমুজ কিংবা এক প্লেট কাটা আনারস কিনে খেতে বেশি দেখা যায়। বাজারে ঝুড়ির ভেতর থেকে এর মধ্যেই উঁকি দিতে শুরু করেছে লাল লিচুর গুচ্ছ। পাকা আমেরও দেখা পাওয়া যাচ্ছে কোথাও কোথাও। আর পাড়া-মহল্লার ফল বিক্রেতাদের ভ্যানগাড়িতে ডাবের পাশাপাশি মিলছে রসালো কচি তালশাঁস। তালশাঁসের অনেক গুণের কথা জানলাম সেদিন। সরকারের কৃষি তথ্য সার্ভিসের ওয়েবসাইটে তালকে দেশের গুরুত্বপূর্ণ অপ্রচলিত ফল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ওয়েবসাইটে তালের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে বলা হচ্ছে, সব ধরনের ফল দেহের জন্য উপযোগী বিভিন্ন ভিটামিন ও খনিজসমৃদ্ধ। তবে তালে এর বাইরে গুরুত্বপূর্ণ কিছু উপাদান আছে। অন্য ফলের তুলনায় এতে ক্যালসিয়াম, লৌহ, আঁশ ও ক্যালরির উপস্থিতি অনেক বেশি। আবার পুষ্টিবিদেরা বলছেন, তালশাঁসের বেশির ভাগ অংশ জলীয়। ফলে দ্রুত শরীর শীতল করার পাশাপাশি আবহাওয়ার তারতম্যের কারণে শরীর দ্রুত পানি হারালে তা পূরণ করতে পারে। এ ছাড়া তালশাঁস শরীরের কোষের ক্ষয় প্রতিরোধ করে। ত্বকের সৌন্দর্য বাড়ায়। হাড় গঠনে সহায়তার পাশাপাশি সুস্থ দাঁতের নিশ্চয়তাও দেয়। ফলে সারা দিন রোজার পর অনেককেই পথের পাশের তালশাঁস বিক্রেতার কাছে ভিড় জমাতে দেখা যাচ্ছে। চার কোয়ার তালশাঁসের দাম ৪০ টাকা। তার মানে প্রতি কোয়া ১০ টাকা। সাহস করে বড়সড় সাইজের লিচুর দামও করে ফেললাম সেদিন। এক শ’ লিচুর দাম চাইল ৭০০ টাকা। অর্ঘ্য নিয়ে বিবৃতি মানুষের আজ বিপুল ক্ষুধা; সব কিছু গলাধঃকরণের জন্য সে মরিয়া। এ যেন সেই দানব, যে চিবিয়ে খাচ্ছে লাল গোলাপ! মিরপুর রোড ও গ্রিন রোডের সংযোগস্থল সায়েন্স ল্যাবরেটরির কাছে একটি ছোট্ট সড়কদ্বীপ রয়েছে যার নাম অর্ঘ্য। সবুজ মনোহর গাছ ও অজ¯্র রং-বেরঙের ফুল ও ফাঁকে ফাঁকে ছোট বড় প্রাণী ও পাখির স্থাপত্যসমৃদ্ধ মনোরম একটি সড়কদ্বীপ। গত বছর এপ্রিল মাসে এই অর্ঘ্য সড়কদ্বীপটি ব্যবসায়িক স্বার্থে ভেঙে ফেলার প্রস্তুতির প্রতিবাদে নাগরিক সমাবেশ করেছিলেন নগর পরিকল্পনাবিদ, পরিবেশবিদ ও বিশিষ্টজনেরা। নগর পরিকল্পনাবিদ এক স্থপতি বলেছিলেন, ‘আমরা চাই এই সড়কদ্বীপটি ধ্বংস না করে নগরের সৌন্দর্য ও প্রকৃতির প্রয়োজনে এ ধরনের আরও পরিকল্পিত সড়কদ্বীপ তৈরি করা হোক।’ গত রবিবার আবার ‘অর্ঘ্য’ রক্ষায় জাতীয় অধ্যাপক, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, কলামিস্ট, নাট্যকার ও বুদ্ধিজীবীসহ দেশের ১৭ জন বিশিষ্ট নাগরিক প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানিয়েছেন। এদের মধ্যে ড. আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীও আছেন। তাই বিষয়টি উল্লেখ করার মতোই। চলতি পথে চলতি পথে আমাদের চোখ আটকে যায় অনেক কিছুতেই। চোখের সঙ্গে মনও। রোদ্দুর মাথায় নিয়ে একদল বিদ্যুৎকর্মীর তৎপরতা ছিল সেদিন দেখার মতো। একটি দশাসই বৈদ্যুতিক খুঁটি অপসারণের কাজে একদল কর্মী। তাতে বাঁশ ও দড়ির কৌশলী ব্যবহার। উন্নত বিশ্বে নিশ্চয়ই এই কাজ করে থাকে যন্ত্র। মানুষ বসে বসে শুধু তার সুইচ টেপে। আর এই রাজধানীতে অন্তত সাতজন গলদঘর্ম হচ্ছেন একটি কাজ সারতে ( ছবি দেখুন)। এক পর্যায়ে হেলানো খুঁটিটির ওপর চেপে বসলেন এক কর্মী। আমরা ঘরে বসে অনেকটা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পেয়ে, তার সুবিধা ভোগ করে, অনেক সময় মনেও রাখি না এই প্রচ- শ্রমের বিষয়টি। প্রতিটি নগরেরই এক ধরনের আভিজাত্য থাকে, আবার থাকে সেকেলে ভাবসাব। এর কোনোটিকেই আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না। শুধু মাঝে মাঝে চলতি পথে এমন কিছু দৃশ্য আমাদের খানিকটা থমকে যেতে বাধ্য করে, এইটুকু যা পার্থক্য। শেষ কথা সোমবার এ লেখা প্রেসে যাওয়ার সময় সংবাদপত্রে একটি ছবি দেখে বিমূঢ় হয়ে পড়ি। গণপরিবহনের কর্মীদের দ্বারা নার্স শহিনুরের ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদে দেশব্যাপী নানা আন্দোলন চলমান। ঢাকায় কল্যাণপুরে তারই সহকর্মী নার্সরা রাস্তায় নেমে মানববন্ধন করে। সে সময়ে তাদের পাশ দিয়ে যাওয়া একটি গণপরিবহনের কর্মী তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে! কর্মীটি অল্পবয়সী। তার ভেতরে কী মূল্যবোধ কাজ করছে? সচেতন মানুষ যে গণপরিবহনের কর্মীদের মানসিক ওরিয়েন্টেশনের তাগিদ দেন, তা যে ভিত্তিহীন নয় ওই ছবি তারই প্রমাণ। গণপরিবহনে এখন সিসি ক্যামেরা স্থাপনের সুপারিশও আসছে। চলন্ত বাসে আর একটিও গণধর্ষণ নয়। এই মহাঅপরাধ রোধ করতে হলে দ্রুত দোষীদের শাস্তি কার্যকর করা চাই। ১২ মে ২০১৯ [email protected]
×