ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ভুল চিকিৎসায় স্মৃতিহারানো ফারজানার দায়ভার নেবে কে -মা বাবার প্রশ্ন

প্রকাশিত: ০৮:৪২, ১৪ মে ২০১৯

 ভুল চিকিৎসায় স্মৃতিহারানো  ফারজানার দায়ভার  নেবে কে -মা বাবার প্রশ্ন

স্টাফ রিপোর্টার, সাতক্ষীরা ॥ ৬ বছরের চঞ্চল শিশু ফারজানা এখন নির্বাক। গত ৭ দিন ধরে শহরের একটি বেসরকারী হাসপাতালের সিসিইউতে তার দিন কাটছে। মৃত্যু মুখ থেকে ফিরে এলেও সে এখন তার বাবা, মাকে চিনতে পারছে না। কানের পাতায় একটি ছোট টিউমার অপারেশনের জন্য সাতক্ষীরা মেডিক্যাল কলেজ হয়ে শহরের বেসরকারী বুশরা হাসপাতালে ভর্তি করা হয় শিশু ফারজানাকে। অপারেশনের আগেই ভুল ইনজেকশনের প্রতিক্রিয়ায় জ্ঞান হরায় ফারজানা। চিকিৎসকদের মতে ভুল ইনজেকশনের কারণে তার ব্রেন এ্যাসাল্ট হয়েছে। তার ‘হায়ার সাইটিক ফাংশন’ কাজ করছে না। তার ব্রেন কোন রিলেশন করতে পারছে না। সে এখন নির্বাক। কথা বলতে পারে না । মুখে খেতেও পারে না। জিহ্বা অনেকটা বেরিয়ে আছে। নলের মাধ্যমে নাক দিয়ে শুধু তরল দুধ খাওয়ানো হচ্ছে ফারজানাকে। এই অবস্থা থেকে কবে ফারজানা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে এর কোন নির্দিষ্ট সময় কোন চিকিৎসক বলতে পারছেন না। স্মৃতিশক্তি ফিরে পেতে কত বছর সময় লাগতে পারে তারও কোন সুনির্দিষ্ট সময় নেই চিকিৎসা শাস্ত্রে এমনটি মনে করছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। এখন অসহায় বাবা মায়ের প্রশ্ন ভুল চিকিৎসায় তাদের মেয়ের এই পরিণতির দায়ভার কে নেবে । ফারজানার বাড়ি জেলার দেবহাটা উপজেলার নোয়াপাড়ার খানজিয়া গ্রামে। বাবা রফিকুল ইসলাম গত সপ্তাহের প্রথম দিকে মেয়েকে নিয়ে আসেন সাতক্ষীরা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মেয়ের কানের পেছনে বেড়ে ওঠা মারবেলের মতো একটি টিউমার অপারেশনের জন্য। হাসপাতালের নাক কান গলা বিভাগের বিশেষজ্ঞ হেড নেক সার্জন ডাঃ মোঃ জাহিদুল ইসলামকে দেখানোর পর ডাক্তার মেয়ের রক্ত, এক্সরেসহ হার্ট পরীক্ষা করতে বলেন। রিপোর্ট করাতে বিকেল হওয়ায় ঐদিন পারীক্ষা রিপোর্ট সংশ্লিষ্ট ডাক্তারকে দেখাতে পারেনি ফারজানার বাবা। পরদিন আবার হাসপাতালে এলে ডাঃ জাহিদুলকে না পেয়ে ডাঃ জাহিদুলের কম্পাউন্ডার শরিফুলের শরণাপন্ন হন ফারজানার বাবা রফিকুল। হাসাপাতালে অপারেশন করতে হলে আগামী ২৮ জুলাই এর আগে সম্ভব নয় বলে জানানো হয় ফারজানার বাবাকে। দ্রুত জরুরীভাবে অপারেশনের জন্য ডাঃ জাহিদুলের কম্পাউন্ডার শরিফুল ফারজানার বাবাকে ৫ হাজার টাকার চুক্তিতে শহরের বুশরা হাসপাতালে ভর্তি করার ব্যবস্থা করেন। এ খানেই ফারজানাকে অপারেশন করার কথা ছিল ডাঃ জাহিদুল ইসলামের। ৬ মে বুশরা হাসপাতালে ভর্তি ফরজানাকে রাত ১০টায় অপারেশনের সময় জানিয়ে দেয়া হয়। ফারজানার বাবা সাংবাদিকদের বলেন, রাত ৯টায় ডাঃ জাহিদুল বুশরা হাসপাতালে এসে ফারজানাকে দেখে প্রেসক্রিপশন করে রাত ১০টায় আসার কথা বলে চলে যান। ডাক্তার চলে যাওয়ার পরেই হাসপাতালের নার্স বাবা মায়ের সামনেই ফারজানার শরীরে একটি ইনজেকশন পুশ করেন। ইনজেকশন অর্ধেকটা পুশ করার মধ্যেই ফারজানা চিৎকার দিয়ে উঠে বলে আমার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এর পরই ফারজানা জ্ঞান হারায়। তার জিহ্বা বেরিয়ে পড়ে। তার শরীর নীলাভ হয়ে উঠে। এর পরই ওটি থেকে একজন অজ্ঞান চিকিৎসক এসে তার বুকে পাঞ্চ করে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করেন। রাত ২টা পর্যন্ত চেষ্টা করেও ফারজানার অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় তাকে জরুরীভাবে অপর একটি বেসরকারী হাসপাতালের সিসিইউতে ভর্তি করা হয়। প্রায় দুইদিন পর ফারজানর জ্ঞান ফেরে। শিশু ফারজানার এমন করুণ পরিণতির পর এখন প্রশ্ন উঠেছে সাতক্ষীরার বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিকের স্বাস্থ্য সেবা ও ব্যবস্থাপনার উপর। অপারেশন থিয়েটার খালি না থাকা সত্ত্বেও শিশু ফারজানাকে অজ্ঞান চিকিৎসকবাদে একজন নার্স নিয়ে এনেসথেশিয়া ড্রাগ পুশ করার দায় ভার কার? এমন ব্যবস্থাপনার মধ্যেই এসব বেসরকারী হাসপাতালগুলোতে হরহামেশাই সরকারী নামী দামী চিকিৎসকরা গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন করছেন। ব্যক্তি সহকারী ও দালালদের মাধ্যমে সরকারী হাসপাতাল থেকে রোগীদের বিভিন্ন প্রলোভনে নিয়ে আসা হয় এসব বেসরকারী হাসপাতলগুলোতে। ডাক্তারের প্রতিবাদ এই ফারজানাকে নিয়ে গত ৯ মে জনকণ্ঠে ‘ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে শিশু ফারজানা’ শীর্ষক একটি খবর প্রকাশিত হয়। এই খবরের প্রতিবাদ জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ডাক্তার মোঃ জাহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ফারজানা নামীয় রোগীটি ৫ মে রবিবার প্রথম ভর্তি হয়। তিনি সাতক্ষীরাতে না থাকায় তারা ভর্তি বাতিল করে ৬ মে সোমবার পুনরায় ভর্তি করেন। রাত ১০টায় তার অপারেশন করার কথা ছিল। ওটিতে অপর একটি অর্থপেডিক্স এর অপারেশন চলার কারণে এই অপারেশনটি বিলম্বিত হয়। তিনি অপারেশন করতে বুশরা হাসপাতালে যাওয়ার আগেই ডিউটি ডাক্তারের পরামর্শে ডিউটি নার্স একটি এন্টিবায়োটিক পুশ করার সময়ে ড্রাগ রিএ্যাকশনে ফারজানা কেবিনেই অচেতন হয়ে পড়ে। তাকে ওটিতে থাকা অজ্ঞান ডাক্তার দেখানো হয়। তার আপ্রাণ চেষ্টায় ফারজানা সুস্থ হয়ে উঠে বলে উল্লেখ করেছেন। পরবর্তীতে তিনি জানতে পেরে ফারজানাকে দেখতে যান এবং আইসিইউতে রেখে চিকিৎসার পরামর্শ দেন, বর্তমানে সে অনেকটা সুস্থ এবং ধীরে ধীরে আরও উন্নতির দিকে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। প্রতিবাদে তাকে জড়িয়ে এবং তার কোন সাক্ষাতকার গ্রহণ না করে এই রিপোর্ট প্রকাশ করায় তার পেশাগত সুনাম ক্ষুণ্ণ করার অসৎ উদ্দেশ্যে অসত্য ভিত্তিহীন ও বিভ্রান্তিকর খবর প্রকাশ করা হয়েছে বলে তিনি জানান। প্রতিবেদকের বক্তব্য ॥ প্রকাশিত খবরে কোথাও তিনি অপারেশন করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়নি। তার কম্পাউন্ডার শরিফুলের মাধ্যমে ফাজানাকে বুশরা হাসপাতালে ভর্তি করা হয় বলে রিপোর্ট উল্লেখ ছিল। ফারজানার বাবা সাংবাদিকদের কাছে এমনটি অভিযোগই করেছেন। বুশরা হাসপাতালে তিনি ফারজানার অপরেশন করবেন বলে তার পাঠানো প্রতিবাদে তিনি নিজেই উল্লেখ করেছেন। এই খবরটি স্থানীয় কয়েকটি দৈনিকে ছাপা হয়েছে। এমনকি কয়েকটি অনলাইন পত্রিকায় এটি ফলাও করে প্রচার হয়। রিপোর্ট লেখার সময় সংশ্লিষ্ট ডাক্তার জাহিদুল ইমলামের বক্তব্য নেয়ার চেষ্টা করেও তাকে মোবাইলে পাওয়া না যাওয়ায় তার বক্তব্য দেয়া সম্ভব হয়নি। তবে বুশরা হাসপাতালের ম্যানেজার আনিসুর রহমানের সঙ্গে কথা বললে তিনি ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন এবং দুঃখ প্রকাশ করেন।
×