ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সামনে ইলিশের মৌসুম উপকূলে ঠুকঠাক শব্দ, নৌকা তৈরির ধুম

প্রকাশিত: ১১:৩২, ১৩ মে ২০১৯

সামনে ইলিশের মৌসুম উপকূলে ঠুকঠাক শব্দ, নৌকা তৈরির ধুম

শংকর লাল দাশ ॥ পটুয়াখালীসহ দক্ষিণ উপকূলে নৌকা তৈরির ধুম পড়েছে। ইলিশ মৌসুম সামনে রেখে উপকূলের বিভিন্ন জায়গায় গড়ে উঠেছে নৌকা তৈরির অসংখ্য ছোট বড় কারখানা। কাঠমিস্ত্রি আর কারিগরদের ব্যস্ততায় কারখানাগুলোতে নেই দম ফেলার সময়। রাতদিন তাদের হাতুড়ি-বাটলে উঠছে ঠুক ঠুক আওয়াজ। আর ক’দিনের মধ্যেই আসছে ইলিশের মৌসুম। চকচকে রুপালি ইলিশে ছড়িয়ে পড়বে রূপের ঝিলিক। শুরু হবে নদী-সাগরে ইলিশ ধরা। চাঙ্গা হয়ে উঠবে ইলিশনির্ভর অর্থনীতি। তাইতো উপকূলের পথে পথে কেবলই নৌকা তৈরির ব্যস্ততার ছবি। সর্বত্র যেন এক অলিখিত প্রতিযোগিতা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সাগরপারের জেলা পটুয়াখালীসহ দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চল ইলিশে ব্যাপক খ্যাতি এনে দিয়েছে। এ অঞ্চলে মিলছে প্রচুর ইলিশ। আর ক’দিন পরই শুরু হবে বর্ষাকালীন ইলিশ মৌসুম। যা অব্যাহত থাকবে অন্তত পাঁচ-ছ’ মাস। তাই ইলিশ মৌসুম সামনে রেখে গত কয়েক বছরের মতো এবারেও দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চলে নৌকা তৈরির ধুম পড়ে গেছে। এজন্য উপকূলের ঘাটে ঘাটে তৈরি হয়েছে নৌকা তৈরির অস্থায়ী কারখানা। যা স্থানীয়ভাবে ডক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীর খালগোড়া, চরমোন্তাজ, চরআ-া, বাহেরচর, মৌডুবী, চালিতাবুনিয়া, বিবিরহাওলা, কোড়ালিয়া, গলাচিপার চরকাজল, চরবিশ্বাস বাঁধঘাট, আমখোলা, পানপট্টি, বদনতলী, হরিদেবপুর, গোলখালীসহ বেশ কয়েকটি ঘাট ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি ঘাটে এ মুহূর্তে এক থেকে দশটি পর্যন্ত নৌকা তৈরির কাজ চলছে। এসব ঘাটে আরও দুই থেকে তিন মাস আগে নৌকা তৈরি শুরু হয়েছে। বহু নৌকা ইতোমধ্যে গাঙে নেমে পড়েছে। নৌকা তৈরির এ ব্যস্ততা আরও অন্তত মাসখানেক অব্যাহত থাকবে। বর্তমানে এত বেশি সংখ্যক নৌকা তৈরি হচ্ছে, যে কারণে এ অঞ্চলের কাঠমিস্ত্রি কিংবা কারিগররা নৌকা তৈরি করে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। তাই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লাখ লাখ টাকা অগ্রিম বায়না করে দক্ষ কাঠমিস্ত্রিদের এ অঞ্চলে নিয়ে আসা হয়েছে। অন্য অঞ্চল থেকে আসা এমনই এক কাঠমিস্ত্রির সঙ্গে দেখা হলো পটুয়াখালীর উপকূলীয় উপজেলা রাঙ্গাবালীর কোড়ালিয়া লঞ্চঘাট সংলগ্ন আগুনমুখা নদীর পাড়ে। নৌকা তৈরির দক্ষ কারিগর হিসেবে পরিচিতি পাওয়া বছর পঁয়তাল্লিশ বয়সী গোপাল মিস্ত্রি এসেছেন পাশের জেলা ভোলার দৌলতখান উপজেলার চরপাতা ইউনিয়নের নলগোড়া গ্রাম থেকে। সঙ্গে নিয়ে এসেছেন আরও ১২ জন সহযোগী। গোপাল মিস্ত্রি জানালেন, গত বছরের আশ্বিন মাসের শেষ দিকে তারা এ অঞ্চলে এসে নৌকা তৈরির কাজ শুরু করেছেন। যা আরও এক-দেড় মাস ধরে চলবে। এরইমধ্যে তিনি ১১টি ছোট ও একটি বড় নৌকা নির্মাণ কাজ শেষ করেছেন। হাতে আরও কয়েকটি নৌকা তৈরির বায়না রয়েছে। গোপাল মিস্ত্রির মতো আরও কয়েকজন কাঠমিস্ত্রির সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বর্তমানে পটুয়াখালীর দক্ষিণের সাগরপারের এলাকাগুলোতে বড় নৌকা তৈরির হিড়িক পড়েছে। যা এ অঞ্চলে ট্রলার হিসেবে পরিচিত। নৌকাগুলোতে ইঞ্জিন ব্যবহারের কারণে এ পরিচিতি। আগে এ অঞ্চলের জেলেরা ইলিশ শিকারে ছোট নৌকা ব্যবহার করত। বড় নৌকা তৈরিতে প্রচুর বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়। দেদার ইলিশ ধরা পড়া এবং ব্যাপক লাভের কারণে জেলেরা বিনিয়োগে কার্পণ্য করছে না। একটি ৩৮ ফুটের নৌকা বা ট্রলার তৈরিসহ অন্য সরঞ্জাম নিয়ে নদী-সাগরে নামতে অন্তত ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা ব্যয় হয় এবং সাড়ে ৪২ ফুটের সমুদ্রগামী বড় ট্রলার নির্মাণে ব্যয় হয় ২০ থেকে ২২ লাখ টাকা। কাঠমিস্ত্রিরা ছোট নৌকা বা ট্রলারে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা এবং বড় ট্রলারে আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা মজুরি পান। গোপাল মিস্ত্রি বলেন, কয়েক বছর ধরে এ অঞ্চলে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে। তাই এ বছর জেলেরা নতুন ট্রলার নির্মাণে বেশি আগ্রহী হয়েছে। গোপাল মিস্ত্রির কাছে সাড়ে ৪২ ফুট দৈর্ঘ্যরে বড় একটি নৌকা তৈরি কাজ দিয়েছেন এলাকার জাহাঙ্গীর মাঝি। তিনি তার ট্রলারটির নির্মাণ কাজ তদারকি করছিলেন। এরই ফাঁকে জাহাঙ্গীর মাঝি বলেন, গত বছর গভীর সাগরে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়েছিল। তাই আসছে মৌসুমে গভীর সাগরে ইলিশ ধরতে বড় নৌকা তৈরি করছেন। চরবিশ্বাস ইউনিয়নের নোমোর স্লুইস এলাকার মোজাম্মেল মাঝি বলেন, আমার আগে থেকে দুটো নৌকা ছিল। এবার আরও একটি বড় নৌকা তৈরি করাচ্ছি। যা নিয়ে যেন সাগরে যেতে পারি। চরমোন্তাজের আবাসিক হোটেল ব্যবসায়ী আজাদ সাথী জানান, ওই এলাকায় এবার কম করে হলেও শ’ খানেক নৌকা বা ট্রলার ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে। বর্তমানে নির্মাণাধীন আছে অন্তত গোটা ত্রিশেক নৌকা। পটুয়াখালীসহ দক্ষিণ উপকূলের প্রতিটি ঘাটেই এখন নৌকা তৈরির এমন ব্যস্ততার চিত্র। প্রতিটি ঘাটে তৈরি হয়েছে এবং হচ্ছে গন্ডায় গন্ডায় নৌকা। যার প্রায় প্রত্যেকটি বিশাল আকারের। কাঠমিস্ত্রিদের ব্যস্ততা তাই এখন তুঙ্গে। নৌকা ও ট্রলার তৈরির হিড়িক প্রসঙ্গে পটুয়াখালীর মৎস্যবন্দর আলীপুর-কুয়াকাটা মৎস্য ব্যবসায়ী ও ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি মোঃ আনছার মোল্লা জানান, ইলিশ সম্পদ রক্ষায় সরকারের পদক্ষেপের সুফল জেলে ও ব্যবসায়ীরা পেতে শুরু করেছে। ইলিশের উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় জেলেরাও ইলিশ শিকারের জন্য বড় ট্রলার নির্মাণের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। সমিতির হিসেব অনুয়ায়ী জেলায় ইলিশ শিকারে ছোট-বড় মিলিয়ে মোট তিন হাজার ট্রলার ছিল। গত দুই বছরে এ সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এ বছর আরও বাড়বে। এ প্রসঙ্গে মৎস্য কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক জানান, বর্ষাকালীন মৌসুম সামনে রেখে নৌকা ও ট্রলার নির্মাণে দক্ষিণ উপকূলে অন্তত হাজার কোটি টাকারও বেশি বিনিয়োগ হচ্ছে। ইলিশ খাত যে ক্রমে লাভজনক ও বিনিয়োগযোগ্য হয়ে উঠেছে, এটি তার একটি প্রমাণ।
×