ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ইসলামপুরে জমজমাট পাইকারি কাপড়ের বাজার

প্রকাশিত: ১১:১০, ১৩ মে ২০১৯

 ইসলামপুরে জমজমাট পাইকারি কাপড়ের বাজার

রহিম শেখ ॥ পুরান ঢাকার ইসলামপুর দেশের বৃহত্তম পাইকারি কাপড়ের বাজার। সালোয়ার-কামিজ, শার্ট-প্যান্ট-পাঞ্জাবি, শাড়ি-লুঙ্গি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের থান ও গজ কাপড়ের বৃহৎ সম্ভার রয়েছে এখানে। মিলছে বিদেশী বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কাপড়। তাই ঈদ-উল ফিতর সামনে রেখে ইসলামপুর এখন পুরোপুরি জমজমাট। কাপড়ের গজ মাপা, খাতায় পরিমাণ তোলা, টাকা গুণতি, প্রখর রোদে মালবোঝাই করে ট্র্যাক-কাভার্ড ভ্যান, লঞ্চ কিংবা ঠেলাগাড়িতে করে রাজধানীসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিয়ে যাওয়া এখানকার নৈমিত্তিক দৃশ্য। নতুন পোশাক দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে দেয়ার কাজে মহাব্যস্ত ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই। ইসলামপুরে বস্ত্র ব্যবসায়ী সমিতির নিবন্ধিত ছোট-বড় দোকান রয়েছে প্রায় চার হাজার। এর বাইরে আরও অন্তত ছয় হাজার ছোট ও মাঝারি দোকান রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন টং মার্কেট, হাজি শরফুদ্দিন ম্যানশন, হাজি ইউসুফ ম্যানশন, আমানউল্লাহ কমপ্লেক্স, হাজি কে হাবিবুল্লাহ কমপ্লেক্স মার্কেট, লতিফ টাওয়ার, আহসান মঞ্জিল (মিউ.) সুপার মার্কেট, এ মাবুদ রাইন টাওয়ার, লায়ন টাওয়ার, মদিনা ভবন, হাজি শামসুদ্দিন ম্যানশন, ২৪ নম্বর মসজিদ মার্কেট নুরজাহান ম্যানশন, হালিম প্লাজা, সোনার বাংলা মার্কেটসহ আশপাশের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি দোকান বাহারি পোশাকে সুসজ্জিত। প্রখর রোদের মধ্যেই মোড়ে মোড়ে মালপত্র উঠানো-নামানো হচ্ছে। ক্রেতা-বিক্রেতার নিরাপত্তা দিতে ব্যস্ত নিরাপত্তাকর্মীরাও। একাধিক ব্যবসায়ী জানালেন, এবার রমজানের শুরু থেকেই বেচাকেনা জমজমাট। পাইকার ও খুচরা দুই পর্যায়ের ক্রেতা এখন ভিড় করছেন। চাঁদ রাত পর্যন্ত চলবে এই কেনাকাটা। হাবিবুল্লাহ কমপ্লেক্স মার্কেটের ব্যবসায়ী নুরুল হোসেন জানান, রাজধানীর গাউসিয়া থেকে শুরু করে নিউমার্কেট, বিভিন্ন বুটিক, ফ্যাশন হাউসসহ দেশের সব প্রান্তে যাচ্ছে ইসলামপুরের থ্রিপিসসহ বিভিন্ন পোশাক। যাচ্ছে বিদেশেও। নবাববাড়ি এলাকার আল-আমিন স্টোরের বিক্রেতা আবদুল ওদুদ বলেন, এখন বেশি বিক্রি হচ্ছে থ্রিপিস ও পাঞ্জাবি। ইসলামপুরের পোশাকের দোকানগুলোতে মান ও কাজ ভেদে ৬৫০ টাকা থেকে আড়াই হাজার টাকায় মিলছে দেশী থ্রিপিস। সেলাই ছাড়া থ্রিপিস মিলছে ৫৫০ থেকে ১৫০০ টাকা। নানা কারুকাজ ও রঙের পাঞ্জাবি মিলছে ৩৫০ থেকে ৪০০০ টাকা পর্যন্ত। মিম ফ্যাশনের বিক্রেতা কামরুল হাসান বলেন, ভারত, পাকিস্তানের সুপার মডেল আর জনপ্রিয় চলচ্চিত্র অভিনেত্রীদের পরনে যে পোশাক দেখা যায়, হুবহু সেই থ্রিপিস এখানকার মার্কেটে পাওয়া যায়। রঙ ও ডিজাইন দেখে দুটি পোশাকের মধ্যে পার্থক্য বোঝার উপায় নেই। ব্যবসায়ীরা জানান, দেশী কাপড়ে ডিজাইনার ও কারিগররা এসব থ্রিপিস তৈরি করেন। দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় ভারত-পাকিস্তানের থ্রিপিসের চেয়ে এখানকার থ্রিপিসের চাহিদা বেশি। ইসলামপুর মূল সড়কের দুপাশের মার্কেটে রয়েছে কয়েকশ শাড়ি কাপড়ের দোকান। মাঝামাঝি স্থানের মার্কেটে বিক্রি হয় চাদর, থ্রিপিস, স্যুট ও মার্কিন কাপড়। প্রতিষ্ঠানগুলো এখন মূল সড়ক ছাপিয়ে আশপাশের সড়ক ও লেনেও স্থান করে নিয়েছে। আশেক লেন, সৈয়দ আওলাদ হোসেন রোডসহ নবাববাড়িতে রয়েছে বিশাল সব কাপড়ের মার্কেট। ইসলাম প্লাজা, হাজি কে হাবিবুল্লাহ মার্কেটে পাওয়া যাচ্ছে দেশী-বিদেশী শার্ট, প্যান্ট, পাঞ্জাবি ও নারীদের জামার গজ কাপড়। হোসেন মার্কেটের ঠিক সামনেই রয়েছে ঐতিহ্যবাহী আহসান মঞ্জিল (মিউ.) সুপার মার্কেট। এখন চায়না মার্কেট নামেই সর্বাধিক পরিচিত। এক কালার, সালোয়ার-কামিজ, আনস্টিচ থ্রিপিস, পাজামা-পাঞ্জাবি, শার্ট, স্যুট, প্যান্ট, বোরকার গজ কাপড় ছাড়াও দেশি পর্দা ও সোফার কভারের কাপড়ের দোকান। প্লাজা মার্কেটে পাওয়া যাচ্ছে গার্মেন্ট ক্যাটাগরির গজ কাপড়। গজ কাপড়ের আরেক মার্কেট গুলশান আরা সিটি। এখানকার শোরুমগুলোতে মিলছে শিফন জর্জেট, টিস্যু, ভেলভেট, জিন্সসহ ডেনিমের গজ কাপড়। চাদরের গজ কাপড় মিলবে দৌলত কমপ্লেক্স এবং ভারতীয় আনস্টিচ থ্রিপিসের জন্য হায়াৎ দোলন কমপ্লেক্স বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ। আদেল কমপ্লেক্স, হাকিম ম্যানশন, আমির মার্কেটসহ বেশ কিছু মার্কেটে রয়েছে দেশী শাড়ি-কাপড়ের দোকান। পাকিজা, নন্দিনী প্রিট শাড়ি কাপড়ের শোরুম রয়েছে এসব মার্কেটে। জাকাতের শাড়ি কাপড় পাওয়া যাবে এখানকার দোকানগুলোতে। ইসলামপুর ছাড়াও উর্দু রোডে চলছে জমজমাট বেচাকেনা। ইসলামপুরের ব্যবসায়ীরা জানান, নরসিংদীর মাধবদী ও বাবুরহাট, ঢাকার সাভার, কুমিল্লার দাউদকান্দি এবং নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন মিল থেকে শাড়ি ও লুঙ্গি তৈরি করিয়ে এনেছেন তারা। রাজধানীসহ রাজশাহী, সিলেট, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, রংপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চলের পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের আগমনে মুখরিত ইসলামপুরের মার্কেটগুলো। ইসলামপুর রোডের প্যারাডাইস ভবনের নিচতলায় কথা হয় কিশোরগঞ্জের ব্যবসায়ী মুহিবুল ইসলাম ও রফিকুল ইসলামের সঙ্গে। দোকানের জন্য রোজার আগেই দু’বার ইসলাপুরের এসেছিলেন এই দুই ব্যবসায়ী। তারা জনকণ্ঠকে বলেন, গত বছরের তুলনায় এবার পাইকারিতে দাম একটু বেশি। ফলে ঈদে খুচরা বাজারে পোশাকের দাম একটু বাড়বে বলে জানান তারা। রবিবার সিলেটের আল হামরা শপিং সেন্টারের ব্যবসায়ী হাবিবুর রহমান দোকানের কর্মচারীদের নিয়ে কাপড় কিনতে এসেছিলেন ইসলামপুরে। তিনি জানালেন, মূলত দেশী পোশাকই তিনি এখান থেকে কিনে থাকেন। ইন্ডিয়ান পোশাকের জন্য আলাদা সাপ্লাইয়ার রয়েছে। এবার বাচ্চাদের ও নারীদের পোশাকে বৈচিত্র্য এসেছে বেশ। এখানকার ব্যবসায়ীরা জানান, একসময় বিদেশ থেকে আমদানি করা কাপড়ের পাইকারি বাজার ছিল ইসলামপুরে। এখন আর সে রকম নেই, চিত্র পাল্টে গেছে। ইসলামপুরের কাপড়ের ব্যবসার বড় অংশই এখন দেশী কাপড়ের দখলে। পাকিজা ফেব্রিক্স কালেকশনের সহকারী ম্যানেজার দীপক চন্দ্র ভৌমিক জনকণ্ঠকে বলেন, ইসলামপুরে তাদের মোট ছয়টি শোরুম রয়েছে। মূলত শব-ই বরাতের পর থেকে দশ রমজান পর্যন্ত তাদের বেচাবিক্রি হয়। এ পর্যন্ত আশানুরূপ ভাল বিক্রি হয়েছে বলে তিনি জানান। ইতোমধ্যে বেশিরভাগই বেচা শেষ। তারা মূলত থ্রিপিস, লুঙ্গি, বিছানার চাদর, শাড়ি ইত্যাদি বিক্রি করে থাকেন। থ্রিপিস বিক্রি করছেন ৫৫০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকায়। ফেব্রিক্স ফ্যাশনের আজিজুর রহমান জানালেন, ৬০-৮০ টাকা দামে লেডিস আইটেমের গজ কাপড় বিক্রি করছেন তারা। মূলত নিম্নবিত্তদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে তারা কাপড় সরবরাহ করেন। এখান থেকে নিয়ে কাপড় যান টেইলার্স ব্যবসায়ীরা। তারা সেলাই করে আবার দোকানিদের কাছে বিক্রি করেন। এজন্য তাদের ঈদ ব্যবসা শুরু হয় শব-ই বরাতের আগেই। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভাল থাকায় এবার ব্যবসা ভাল বলে জানান তিনি। দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ ভাল থাকায় ব্যবসা নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করলেন অনেক ব্যবসায়ী। তবে রাস্তা খারাপ ও যানজটের কারণে খোভ প্রকাশ করলেন ব্যবসায়ীরা। একই সঙ্গে বিদেশী পোশাকের বাজার দখল নিয়ে চিন্তিত এখারকার অধিকাংশ ব্যবসায়ী। ইসলাপমপুরের পাশাপাশি উর্দু রোডেও চলছে জমজমাট বেচাকেনা। বেচাকেনায় ব্যতিব্যস্ত ব্যবসায়ীদের দম ফেলার যেন ফুরসত নেই। ইসলামপুর ও উর্দু রোডের দোকানি ও ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এবার ঈদ উপলক্ষে দেশী মিনি থ্রিপিস ৪২০-৮০০ টাকা, থ্রিপিস ৩৫০-৩৫০০ টাকা, লুঙ্গি ২০০ থেকে ৭০০ টাকা, পাঞ্জাবি ছোটদের ২৫০-২৮০০ টাকা, বড়দের পাঞ্জাবি ৪০০-৮০০০ টাকা ও থান কাপড়ের প্রিন্টের থ্রিপিস ৪৫০-৯৫০ টাকা।
×