ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কৃষিযন্ত্র ব্যবহারে নতুন বিপ্লবের হাতছানি

প্রকাশিত: ১০:২৯, ১২ মে ২০১৯

কৃষিযন্ত্র ব্যবহারে নতুন বিপ্লবের হাতছানি

যান্ত্রিকীকরণের বহুবিধ সুবিধাদির ফলে কৃষক দিন দিন কৃষিযন্ত্রের প্রতি ঝুঁকে পড়ছে। কৃষিযন্ত্র ব্যবহারে কৃষকদের ফসল উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা ফসল থেকে আর একটা ফসল লাগানোর মধ্যবর্তী সময় কমে যাওয়ায় কৃষকরা বছরে এখন ২টা ফসলের স্থানে ৩টা ফসল অনায়াসেই করতে পারছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কৃষি প্রকৌশলীদের মতে, ধান যদি যান্ত্রিক উপায়ে কর্তন বা রিপার দ্বারা কর্তন করা সম্ভব হয়, তবে কৃষকদের প্রায় ৮৪৫০০০ টন ধান সাশ্রয় হবে। এক গবেষণায় জানা যায়, দেশে প্রতি বছর প্রায় ৩০,০০০ কোটি টাকার খাদ্য শস্য নষ্ট হয় শুধুমাত্র পরিকল্পিতভাবে ফসল কর্তন, ফসল কর্তনোত্তর ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে। কৃষি প্রকৌশলীদের গবেষণায় আরও জানা যায়, বিগত দশকে দেশে ফসল কর্তনোত্তর ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ২,৫০,০০০ কোটি টাকা। ইউএসএআইডির অর্থায়নে বাংলাদেশের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিশক্তি ও যন্ত্র বিভাগের এ্যাপ্রোপ্রিয়েট স্কেল মেকানাইজেশন ইনোভেশন হার কর্তৃক পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, সনাতন পদ্ধতির পরিবর্তে ট্রান্সপ্ল্যান্টার যন্ত্রের মাধ্যমে যদি ধানের চারা রোপণ করা হয়, তাহলে কৃষকের শতকরা ৫০ ভাগ চারা রোপণ খরচ বাঁচায়। রিপার ও কম্বাইন হারভেস্টার যন্ত্র দিয়ে ধান কাটা হলে সনাতন পদ্ধতির চেয়ে যথাক্রমে ৩৬ ও ৫৩ ভাগ খরচ বাঁচায়। অপরদিকে সনাতন পদ্ধতিতে ধান কাটা হলে ধানের অপচয় হয় শতকরা ৬.৩৬ ভাগ। কিন্তু যন্ত্রের মাধ্যমে ধান কাটা হলে ধানের অপচয় হয় মাত্র শতকরা ১.২৭ ভাগেরও কম। বারির ফার্ম মেশিনারি এ্যান্ড পোস্টহারভেস্ট প্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এক জরিপে দেখা গেছে, কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের শুধুমাত্র বারি গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ যন্ত্র ও মাড়াই যন্ত্র ব্যবহারের ফলে ইউরিয়া সাশ্রয় ও ফসলের ক্ষয়ক্ষতি সাশ্রয় বাবদ ৭৩৫০ কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব। কৃষি বিপ্লবের হাতছানি : কৃষিযন্ত্রের স্বর্ণযুগ ১৯১২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম কৃষিযন্ত্র বিপণনকারী কোম্পানি ইয়ানমার। প্রতিষ্ঠার পর থেকে জাপানী এ প্রতিষ্ঠানটির উদ্ভাবিত কৃষিযন্ত্রের বাজার বিশ্বের ১১৯টি দেশে সম্প্রসারিত হয়েছে। তবে কৃষিযন্ত্র ব্যবহারে দ্বিতীয় যুগে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ। এ দেশের কৃষকেরা জমি চাষ, সেচ ও ফসল মাড়াইয়ে যন্ত্রের ব্যবহারে প্রায় সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এখন শুরু হয়েছে রোপণ, ফসল কাটাসহ দ্বিতীয় পর্যায়ের যন্ত্রপাতির ব্যবহার। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কৃষিযন্ত্র ব্যবহারে ভিন্নতা আসে। বাংলাদেশে যেহেতু মাথাপিছু আয় বাড়ছে, সেহেতু কৃষি খাতে শ্রমিক সঙ্কট তৈরি হচ্ছে। ফলে নতুন ধরনের কৃষিযন্ত্র ব্যবহারে আগ্রহ বাড়ছে কৃষকের। পাশাপাশি সরকারও কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারে উৎসাহ দিচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, কৃষি যন্ত্রায়ণে বড় প্রাতিষ্ঠানিক রূপায়ণ ঘটে ১৯৯৭ সালে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মাধ্যমে। জানা গেছে ২০১০ সালের ৪ এপ্রিল থেকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, খামারবাড়ির অধীনে ২৫% ভর্তুকিতে দক্ষ কৃষি প্রকৌশলীদের দ্বারা পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টর, শক্তিচালিত ধান মাড়াই ও ভুট্টা মাড়াই যন্ত্র, গুটি ইউরিয়া এ্যাপ্লিকেটর ও কম্বাইন হারভেস্টার যন্ত্রের জনপ্রিয়করণ প্রকল্প চালু করা হয়। এরপর ১৩ আগস্ট ২০১৩ সালে প্রকল্পের দ্বিতীয় মেয়াদে ৩০% ভর্তুকিতে শ্রমিকের ঘাটতি পূরণের জন্য ধান রোপণ যন্ত্র (ট্রান্সপ্ল্যান্টার), পাওয়ার টিলারচালিত বীজ বপন যন্ত্র, ধান কাটার রিপার ও মাড়াই যন্ত্র ও কম্বাইন হারভেস্টার যন্ত্র জনপ্রিয়করণের কাজ জোরদার করা হয়। এই ধারাবাহিকতায় ভর্তুকির পরিমাণ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ সাল থেকে হাওড় ও নিচু এলাকার জন্য ৭০% এবং বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার জন্য ৫০% বৃদ্ধি করে কৃষিযন্ত্রগুলোর জনপ্রিয় করণের কাজ অব্যাহত রয়েছে। এ প্রকল্পটি জুন ২০১৯ সাল পর্যন্ত চলমান থাকবে। তবে উল্লেখ করা প্রয়োজন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারী ও দাতা প্রতিষ্ঠানও কৃষি যন্ত্রায়নে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। কৃষকের অনুপ্রেরণা সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি দেশের কৃষকরা যাতে ভালভাবে কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে পারে সে জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ভাল কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। দেশীয় উৎপাদন বা শিল্প বিকাশে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি এবং সুলভ মূল্যে কৃষকের কাছে দেশে উৎপাদিত কৃষি যন্ত্রপাতি পৌঁছে দিতে সরকার বর্তমান অর্থবছরের বাজেটে খুচরা কৃষি যন্ত্রাংশ আমদানিতে শুল্ক হার ৬৩ ভাগ থেকে কমিয়ে ১ ভাগ নির্ধারণ করেছে। এর ফলে কৃষক কম মূল্যে কৃষি যন্ত্রপাতি কিনতে পারবেন। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ফলে দেশের শস্য উৎপাদন বিগত ২৫ বছরে প্রায় দ্বিগুণেরও বেশি অর্জন সম্ভব হয়েছে। তবে শস্য সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তির ক্ষেত্রে শুধুমাত্র কৃষি যন্ত্রপাতির সঠিক ব্যবস্থাপানার অভাবে প্রতিবছর মোট খাদ্য শস্য উৎপাদনের ৭-১০ ভাগ অপচয় হয়। যান্ত্রিকীকরণে উৎপাদন খরচ কমে কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এসিআই মোটরসের হিসাব অনুযায়ী, ১ একর জমি চাষে সনাতন পদ্ধতিতে খরচ হয় ৩ হাজার টাকা। এটা পাওয়ার টিলারে নেমে আসে ৩১০ টাকায়। আর টাক্টরে ৫৭৫ টাকা ব্যয়ে চাষ করা যায় সমপরিমাণ জমি। ফসল কাটার ক্ষেত্রে ১ একর জমিতে সনাতন পদ্ধতির খরচ ৮ হাজার ৪০০ টাকা। একই জমিতে ফসল কাটার যন্ত্র বা রিপার মেশিনে খরচ ৩৮৫ টাকা। কাটা ও মাড়াই বাবদ কম্বাইন্ড হারভেস্টরে ব্যয় ১ হাজার ১০০ টাকা। বিএইউর কৃষি শক্তি ও যন্ত্র বিভাগের এক গবেষণা অনুযায়ী, ১ হেক্টর জমিতে বীজ, জমি তৈরি, সারের দামসহ ধান রোপণে ট্র্যান্সপ্ল্যান্টার মেশিনের খরচ ১৪ হাজার ৮৮১ টাকা। সনাতন পদ্ধতির ব্যয় ২৪ হাজার ৪৪৫ টাকা। যান্ত্রিকীকরণই গড়বে আধুনিক ও লাভজনক কৃষি কৃষিজমির পরিমাণ দিন দিন কমছে, কৃষি শ্রমিকরা শহরমুখী হচ্ছে তারপরও কৃষি অর্থনীতি সমৃদ্ধ হওয়ার পেছনে রয়েছে কৃষিযান্ত্রিকীকরণের বিশেষ অবদান। হালের বলদ, লাঙল-জোয়ালের উপর কৃষকের ভরসার সেদিন এখন আর নেই। আধুনিক প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় নতুন নতুন যন্ত্রপাতির ব্যবহারে দেশের কৃষিখাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। এসব যন্ত্রের ব্যবহারের ফলে কৃষকের কমেছে শ্রম ও খরচ, অপরদিকে কয়েকগুণ বেড়েছে উৎপাদন। দেখা যাচ্ছে প্রতিনিয়তই কৃষি কাজে শ্রমিকের অভাবে কৃষকরা সঠিক সময়ে ফসল জমিতে লাগাতে না পারার ফলে কৃষকদের মাঝে কৃষি কাজে যন্ত্র ব্যবহারের ব্যাপক চাহিদা পরিলক্ষিত হচ্ছে। কৃষি কাজের যন্ত্রের ব্যবহারের ফলে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) ও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) উদ্ভাবিত কৃষি যন্ত্রপাতির চাহিদা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। একইকারণে স্থানীয়ভাবে তৈরি এসব কৃষি যন্ত্রপাতির চাহিদা বৃদ্ধির ফলে গড়ে ওঠেছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরি কারখানা। কৃষি মন্ত্রণালয় ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারের মাধ্যমে দেশে বর্তমানে ৯৫ ভাগ জমি চাষ হচ্ছে। বালাইনাশক ব্যবহারে ৯০ ভাগ, ফসল মাড়াইয়ে ৭৫ ভাগ যন্ত্রপাতি ব্যবহার হচ্ছে। অর্থাৎ যে সব যন্ত্রপাতির দাম কম সে সব যন্ত্রেরও ব্যবহার বেশি। এ দিকে সার প্রয়োগে যন্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে ৩ ভাগ, চারা রোপণ ১ ভাগ, ফসল কাটা ১ ভাগ, এগুলোর বেশিরভাগই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএইউ) ফার্ম পাওয়ার এ্যান্ড মেশিনারি বিভাগের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, জমি চাষে এখন প্রায় ৯০ শতাংশের বেশি যান্ত্রিকীকরণের ছোঁয়া লাগলেও পিছিয়ে রয়েছে ট্রান্সপ্ল্যান্টিং ও হারভেস্টিং। মাত্র শূন্য দশমিক ১ শতাংশ জমিতে ট্রান্সপ্ল্যান্টিং করতে ব্যবহার করা হচ্ছে যন্ত্রের। অন্যদিকে মাত্র শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ জমিতে হারভেস্টিং করতে ব্যবহার করা হচ্ছে যন্ত্রের। যন্ত্রের ব্যবহার না থাকায় আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছেন কৃষক।
×