ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাগেরহাটে আশ্রয়ণ প্রকল্পে দুই রকম ঘর

প্রকাশিত: ১০:১১, ১২ মে ২০১৯

বাগেরহাটে আশ্রয়ণ প্রকল্পে দুই রকম ঘর

বাবুল সরদার, বাগেরহাট ॥ জমি আছে-ঘর নাই’ এমন গৃহহীন হতদরিদ্র পরিবারের জন্য আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের অধীনে বাগেরহাট জেলার সকল উপজেলায় ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। এই প্রকল্পের অধীন প্রতিটি ঘরের জন্য বরাদ্দ বাজেট ও নক্সা একই রকম। তবুও বাগেরহাটে চিতলমারী উপজেলায় নির্মিত ঘরের নক্সার সঙ্গে এর পার্শ্ববর্তী ফকিরহাট ও কচুয়া উপজেলার নির্মিত ঘরের নক্সার কোন মিল নেই। কাজের মানও ভিন্ন। ফকিরহাট ও কচুয়া উপজেলায় নির্মিত ঘর গুলিতে জানালা থাকলেও চিতলমারী উপজেলায় নির্মিত ঘরের কোনটিতেই জানালা নেই। চিতলমারীতে জানালাহীন বদ্ধঘর। অথচ পার্শ্ববর্তী ফকিরহাট ও কচুয়া উপজেলায় প্রতিঘরে চার(৪)টি করে জানালা। আলো-বাতাসের ঝলকানি। স্বাস্থ্য সম্মত পরিবেশ। প্রকল্প বাস্তবায়ন নীতিমালা এক উপজেলায় মানা হলেও অন্য উপজেলায় তার কোন তোয়াক্কা নেই। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের ঘর নির্মাণ কাজে এমন নানা প্রকার তথ্য-চিত্র পাওয়া গেছে সরেজমিনে। চিতলমারীতে নির্মিত ৬০৪টি ঘর কি পরিবেশ সম্মত ঝুঁকিমুক্ত? প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের সকল ঘর নক্সায় এবং গুনে-মানে একই রকম হওয়ার কথা। কিন্তু কাজে কেন এই ভিন্নতা? জনমনের এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে পাওয়া যায় চমকপ্রদ তথ্য। আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের পরিচালক আবুল কালাম শামসুদ্দিন (যুগ্ম সচিব) মোবাইল ফোনে বলেন, ‘জানালা বিহীন ঘর নির্মাণের কোন সুযোগ নেই। প্রকল্পের অনুমোদিত নক্সা অনুযায়ী সকল ঘর করতে হবে। প্রত্যেক ঘরে জানালা থাকবে। সরকারী নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে। চিতলমারী উপজেলায় জানালাবিহীন ঘর কিভাবে নির্মাণ হলো আমি খোঁজ নিচ্ছি।’ আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের অনুমোদিত নক্সা অনুযায়ী প্রতিটি ঘরে চারটি জানালা (প্রতিটির প্রস্ত দুই ফুট ছয় ইঞ্চি এবং দৈর্ঘ্য তিন ফুট), একটি দরজা (প্রস্ত তিন ফুট এবং দৈর্ঘ্য ছয় ফুট) থাকবে। রয়েছে ঘরের আরও নানা পরিমাপ। উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, প্রতিটি এক লাখ টাকা মূল্যের মোট ৯৪৯টি ঘরের মধ্যে চিতলমারী উপজেলায় ৬০৪টি এবং কচুয়া উপজেলায় ৩৪৫টি ঘর নির্মাণ হয়েছে। প্রতি পরিবারের গড়ে পাঁচজন হারে প্রায় চার হাজার ৭৪৫ জন মানুষের আশ্রয়ের ব্যবস্থা হয়েছে এই ঘরে। প্রকল্পের সুবিধাভোগীরা জানান, চিতলমারী উপজেলায় নির্মিত জানালাবিহীন ঘরগুলো অন্ধকারাচ্ছন্ন গুমোটঘরে পরিণত হয়েছে। টিনের ছাউনি দেয়া ঘরের একটি মাত্র সরু দরজা। আলো-বাতাস যাতায়াতের বিকল্প কোন পথ নেই। আগুন, ঝড়বৃষ্টি বা অন্যকোন দুর্যোগ হলে ঘরের ভেতর হতে বাইরে দ্রুত বের হওয়ার বিকল্প কোন পথ নেই। তাদের মতে, ঘরের প্রতিটি পিলারের ভেতরে তিনটি রড দেয়া হয়েছে। ঘরের উপকরণ উপজেলা সদর হতে নির্দিষ্ট বাড়ি পর্যন্ত নেয়ার ব্যায়ভার পাঁচ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বহন করতে হয়েছে দরিদ্র ওই পরিবারদের। তারপরেও অনেকের ঘর ও লেট্র্রিনের কাজ অসম্পূর্ণ রয়েছে। ঘরগুলো নির্মাণের ছয় মাস না পেরোতেই অনেক ঘরের মেঝে, পিলার ফেটে গেছে। তাদের রয়েছে আরও নানা অভিযোগ। প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) আহ্বায়ক ও চিতলমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আবুসাঈদ বলেছেন, ‘প্রথম পর্যায়ে ৯৯টি এবং পরে ৫০৫টি ঘর বরাদ্দ আসে। তৃণমূল পর্যায়ে ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বারদের নিয়ে যাচাই-বাছাই করে ৬০৪ জন উপকারভোগীর তালিকা প্রস্তুত করা হয়। প্রতিটি ঘরে এক লাখ টাকা বরাদ্দ আসে। ৬০৪টি ঘরে মোট ছয় কোটি চার লাখ টাকা। অনেকে ঘর পেয়ে খুবই খুশি-আনন্দে কেঁদেছেন। আমিও খুশি তাদের ব্যক্তিগতভাবে ঘরগুলো করে দেয়ার দায়িত্ব পেয়ে।’ তিনি আরও জানান, তার অফিসের কর্মচারী আকরাম ও রফিক ঘর নির্মাণ কাজে সহযোগিতা করেছে। কাজ বাস্তবায়নে কোন অনিয়ম, দুর্নীতি হলে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। অপরদিকে, কচুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাসমিন ফারহানা বলেন, ‘চার ধাপে ৩৪৫ জন সুবিধাভোগী ঘর পেয়েছেন। ঘর নির্মাণ ও সুবিধাভোগী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে নীতিমালা অনুসরণ করা হয়েছে। কাজের ক্ষেত্রে ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধনের চেষ্টা করেছি।’ সুবিধাভোগী চূড়ান্তকরণ সম্পর্কে তিনি জানান, ব্যাপক প্রচারণার পর ঘরপ্রাপ্তির জন্য আবেদন করে এলাকার মানুষেরা। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ হতে তাদের বাড়ি পরিদর্শন করে ঘরের ছবিসহ বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এরপর পিআইসি কমিটির উন্মুক্ত সভার মাধ্যমে প্রস্তাবিত তালিকা জেলা কমিটিতে পাঠানো হয়। চূড়ান্ত সুবিধাভোগীদের ঘর নির্মাণের পর পুনরায় ছবি তুলে তা পূর্ববর্তী ছবির পাশে সংরক্ষণ করা হয়। কচুয়া উপজেলার মঘিয়া ইউনিয়নের খলিশাখালী গ্রামের সুবিধাভোগীরা জানান, কচুয়া উপজেলায় প্রতিটি ঘরে চারটি জানালা আছে। প্রতিটি পিলারের ভেতর চারটি করে রড রয়েছে। ঘরের উপকরণাদি বাড়িতে পৌঁছানোর জন্য কোন বাড়তি ব্যয় হয়নি। এদিকে চিতলমারীর প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ইউএনও কার্যালয়ে কর্মরত দুই ব্যক্তি ঘর নির্মাণ কাজে সার্বক্ষণিক সক্রিয় ছিলেন। তারা ঘরের উপকরণাদি প্রস্তুত, সরবরাহ, ঘর নির্মাণসহ সকল দায়িত্ব পালন করেন। রাজমিস্ত্রিরা জানায়, মালিকের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিটি পিলার তিনটি রড, খোয়া-বালু-সিমেন্ট দিয়ে তৈরি করেছে। ঘরে লাগানো সেই পিলার এবং ঘরের পাঁকা মেঝেতে ইতোমধ্যে ফাঁটল ধরেছে। চিতলমারী উপজেলায় ঘর পাওয়া হতদরিদ্র মুক্তিযোদ্ধা, বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা নারী, শারীরিক প্রতিবন্ধী, উপার্জনে অক্ষম ব্যক্তির সংখ্যা কত? উত্তরে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) সদস্য সচিব চিতলমারী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সোহাগ ঘোষ জানান, ঘর সংক্রান্ত সকল তথ্য ইউএনও কার্যালয়ে পাওয়া যাবে। ইউএনও মহোদয় কাজটি তার নিজের তত্ত্বাবধানে করেন। কাগজে-কলমে সদস্য সচিব হলেও তার কাছে কোন তথ্যাদি নেই। পিআইসির সদস্য এলজিইডির চিতলমারী উপজেলা প্রকৌশলী মোঃ জাকারিয়া ইসলাম জানান, ঘর নির্মাণ সংক্রান্ত কোন কাজে তার কোন পরামর্শ নেয়া হয়নি। তাই তিনি কিছু বলতে পারছেন না। আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় ‘যার জমি আছে ঘর নাই’ তার নিজ জমিতে গৃহ নির্মাণ নীতিমালা অনুযায়ী, উপজেলা নির্বাহী অফিসারের তত্ত্বাবধানে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) দ্বারা উপজেলা প্রশাসন সরসরি ক্রয় পদ্ধতিতে ঘর নির্মাণ কাজ সম্পাদন করবে। নীতিমালা অনুযায়ী, পাঁচ সদস্যের পিআইসির আহ্বায়ক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, সদস্য সচিব উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা, সদস্য সহকারী কমিশনার (ভূমি), এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলী এবং সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান। প্রকল্পের সুবিধাভোগী নির্বাচনের নিয়মে উল্লেখ আছে, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাইকিংসহ ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে ঘরের জন্য দরখাস্ত আহ্বান করবেন। পরে ‘উপজেলা আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প টাস্কফোর্স’ কমিটি প্রকাশ্য সভায় উপযুক্ত পরিবার বাছাইপূর্বক জেলা কমিটির নিকট প্রস্তাব পাঠাবে। জেলা কমিটি যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত তালিকা সুপারিশসহ আশ্রয়ণ-২ কার্যালয়ে পাঠাবে।
×