ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াবে ॥ বড় ধরনের ছাড় দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

প্রকাশিত: ১০:০৫, ১২ মে ২০১৯

 পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াবে ॥ বড় ধরনের ছাড় দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

অপূর্ব কুমার ॥ শেয়ারবাজার চাঙ্গা করতে বড় ব্যাংকগুলোকে বড় ধরনের ছাড় দিতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আস্থা সঙ্কটে থাকা শেয়ারবাজারে নগদ টাকার প্রবাহ বাড়ানোর উদ্যোগ হিসেবে বিদ্যমান বিনিয়োগসীমা সংক্রান্ত আইন পরিবর্তনের পথে হাঁটছে বাংলাদেশ ব্যাংক। শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টদের এ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এই পরিবর্তন আসছে। গত কয়েক বছর ধরেই শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সঙ্গে বাজার সংশ্লিষ্টরা নগদ টাকার প্রবাহ বাড়াতে বিনিয়োগসীমা সংক্রান্ত আইনটি পরিবর্তনের দাবি জানিয়ে আসছিল। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা সংক্রান্ত জটিলতা অবসানে বিএসইসির এ প্রস্তাবে সায় ছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক শুরুতে এ বিষয়ে খুব বেশি আগ্রহী ছিল না। তবে শেষ মুহূর্তে হলেও পুঁজিবাজারে আস্থা ফেরাতে বিনিয়োগসীমা সংক্রান্ত আইন পরিবর্তনের পক্ষে মত দিয়েছে। এ সপ্তাহের মধ্যেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক নগদ টাকার প্রবাহ বাড়াতে পরিপত্র জারি করবে। ব্যাংকগুলোকে এই ছাড় দেয়া হলে বেশ কিছু ব্যাংক নতুন করে শেয়ারবাজারে অর্থলগ্নি করতে পারবে। আর যেসব প্রতিষ্ঠানের অতিরিক্ত বিনিয়োগ রয়েছে, তাদের শেয়ার বিক্রি করতে হবে না। একইসঙ্গে আইসিবির একক গ্রাহকের ঋণসীমার শর্ত আপাতত শিথিল করা হচ্ছে। এছাড়া কয়েকদিন আগেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ সংস্থা ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশকে (আইসিবি) ৯০০ কোটি টাকা পুনঃঅর্থায়ন তহবিল পুনর্ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিল। নির্ভরশীল সূত্রে জানা গেছে, বালাদেশ ব্যাংকের নতুন আদেশে বলা হবে, বেমেয়াদী মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ এবং দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ, যা দৈনন্দিন লেনদেনে প্রভাব ফেলে না তা শেয়ারবাজারের বিনিয়োগ হিসাবে ধরা হবে না। অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং শেয়ারবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির মধ্যে বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত এক বৈঠক থেকে এমন নীতিগত কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ সপ্তাহেও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে আরও একাধিক বৈঠক হবে। সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা-পর্যালোচনা শেষে বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে পরিপত্র জারি করবে। একই সঙ্গে আইসিবিতে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একক গ্রাহকের ঋণসীমার শর্ত শিথিলের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার গবর্নর ফজলে কবিরের সভাপতিত্বে বৈঠকে বিএসইসির চেয়ারম্যান খায়রুল হোসেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব আসাদুল ইসলাম, সরকারী বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান আইসিবির এমডি কাজী ছানাউল হক, বাংলাদেশ ব্যাংকের উপদেষ্টা আল্লাহ মালিক কাজেমী ও এসকে সুর চৌধুরী, ডেপুটি গবর্নর এসএম মনিরুজ্জামান এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের আরও দুজন উর্ধতন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। শেয়ারবাজারে বড় দরপতনের সময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে গবর্নর ও বিএসইসি চেয়ারম্যানের আলোচনার সূত্র ধরে বৈঠকে বলা হয়েছে, শেয়ারবাজার পরিস্থিতি কোনভাবে এমন পর্যায়ে যেতে দেয়া যাবে না যাতে সরকার আরও বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে। এজন্য নিজ নিজ সংস্থার অবস্থান থেকে নীতি সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে। শেয়ারবাজারে ধারাবাহিক পতন নিয়ে নানামুখী আলোচনা-সমালোচনা ও বিনিয়োগকারীদের ক্ষোভের মুখে সম্প্রতি বেশকিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। গত বুধবার বিএসইসি আইপিও প্রক্রিয়ায় তালিকাভুক্ত হওয়া কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালক ও প্লেসমেন্টধারীদের শেয়ারের লক ইন (বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা) সীমা লেনদেন শুরুর দিন থেকে গণনার সিদ্ধান্ত নেয়। এছাড়া প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) ফিক্সড প্রাইস ও বুক বিল্ডিং পদ্ধতি, প্লেসমেন্ট, আইপিও পরবর্তী সময়ে বোনাস শেয়ার ইস্যু, তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের ২ শতাংশ ও ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ-সংক্রান্ত বিধিমালা সংশোধনে দুটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর আগে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের জন্য গঠিত ৯শ’ কোটি টাকা তহবিলের মেয়াদ তিন বছর বৃদ্ধি এবং তহবিলটি ঘূর্ণায়মান তথা অর্থ ফেরত আসার পর আবার ঋণ দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে আরও আলোচনা হয়, ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের জন্য গঠিত ৯শ’ কোটি টাকার ঘূর্ণায়মান তহবিলের অব্যবহৃত অর্থ এখন থেকে সরকারী বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান আইসিবি ব্যবহার করতে পারবে। এছাড়া আইসিবিতে ব্যাংকগুলোর একক গ্রাহকের ঋণসীমার শর্ত আপাতত শিথিল করা হবে। কেননা বর্তমানে আইসিবিতে সোনালীসহ কয়েকটি রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংকের যে পরিমাণ বিনিয়োগ রয়েছে তা একক গ্রাহকের ঋণসীমার তুলনায় বেশি। একক গ্রাহকের ঋণসীমার নিয়মের কথা বলে কোন কোন ব্যাংক আইসিবির কাছ থেকে টাকা চাইছে। এ পরিস্থিতিতে ঋণসীমার শর্ত শিথিলের বিষয়ে ভাবা হচ্ছে। এর মাধ্যমে বাজারে তারল্য বাড়বে। এর বাইরে ব্যাংক খাতে তারল্য বাড়াতে আরও কোন পদক্ষেপ নেয়ার সুযোগ থাকলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাও দেখবে। বিদ্যমান নিয়মে ব্যাংকগুলো আদায়কৃত মূলধন, শেয়ার প্রিমিয়াম হিসেবে রক্ষিত স্থিতি, সংবিধিবদ্ধ সঞ্চিতি ও রিটেন্ড আর্নিংসের ২৫ শতাংশ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে পারে। আর সমন্বিত পদ্ধতিতে ব্যাংক ও তার সাবসিডিয়ারি মিলে বিনিয়োগ করতে পারে ৫০ শতাংশ। এই বিনিয়োগ হিসাবের ক্ষেত্রে ব্যাংকের ধারণ করা সব ধরনের শেয়ার, ডিবেঞ্চার, কর্পোরেট বন্ড, মিউচুয়াল ফান্ড ইউনিট ও অন্যান্য পুঁজিবাজার নিদর্শনাপত্রের বাজার মূল্যের হিসাব করা হয়। সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানের গ্রাহককে দেয়া মার্জিন ঋণের স্থিতি, ভবিষ্যৎ মূলধন প্রবাহ বা শেয়ার ইস্যুর বিপরীতে বিভিন্ন কোম্পানিকে দেয়া ব্রিজ ঋণ ও পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে গঠিত তহবিলের চাঁদাও এ হিসাবের মধ্যে ধরা হয়। এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ। তাদের মতে, পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে এ খাতে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমার যে সংজ্ঞা বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারণ করেছে, তার পরিবর্তন তথা পুনর্বিবেচনা করা উচিত। বিনিয়োগসীমা থেকে তালিকাবহির্ভূত কোম্পানি বাদ দিলে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ সক্ষমতা বাড়বে। এতে পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াবে। এ বিষয়ে ডিএসইর এমডি কেএএম মাজেদুর রহমান বলেন, ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা থেকে তালিকাবহির্ভূত প্রতিষ্ঠান বাদ দিলে তাদের বিনিয়োগ সক্ষমতা বাড়বে। তারা বাড়তি কিছু অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের সুযোগ পাবে। এটা পুঁজিবাজার গতিশীল করতে ভূমিকা রাখবে। এ প্রসঙ্গে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, পুঁজিবাজারে বহু সমস্যা রয়েছে। ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা থেকে তালিকাবহির্ভূত কোম্পানি বাদ দেয়া অবশ্যই পুঁজিবাজারের জন্য ইতিবাচক। তবে বাজার ভাল করতে হলে দুর্বল কোম্পানির তালিকাভুক্তি বাদ দিয়ে ভালমানের কোম্পানি নিয়ে আসতে হবে। এদিকে বিশ্বের সব পুঁজিবাজারে মিউচুয়াল ফান্ডসহ অন্য ফান্ডগুলো পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও বাংলাদেশের পুঁজিবাজার এখনও অনেকটাই ব্যাংকনির্ভর। কিন্তু ব্যাংকগুলোকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মনীতি মেনে চলতে হয়। আগে কোন ব্যাংক তার মোট আমানতের ১০ শতাংশ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারত। কিন্তু ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের পর ব্যাংকগুলো পরিশোধিত মূলধনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারে। কিন্তু এ বিনিয়োগসীমার ২৫ শতাংশ পুরোটা পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকে হিসাবে নিলে কোন ক্ষতি ছিল না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব ব্যাংকের তালিকাবহির্ভূত কোম্পানি, মিউচুয়াল ফান্ড ও বন্ড সব ধরনের বিনিয়োগকেই ২৫ শতাংশের মধ্যে হিসাব করছে, যা ব্যাংকগুলো নতুন করে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারছে না। জানা গেছে, ২০১০-১১ সালের পুঁজিবাজার বিপর্যয়ের পর সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে পুঁজিবাজারকে স্থিতিশীলতায় ফেরাতে নেয়া কয়েকটি সুপারিশের মধ্যে একটি ছিল ব্যাংকের দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগকে পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা হিসেবে হিসাব না করা। পরে ২০১৪ সালে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের পর এসব বিষয় চাপা পড়ে যায়। অবশ্য ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা পরিশোধিত মূলধনের ২৫ শতাংশ ঠিক রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়। তখন থেকেই বিষয়টি নিয়ে বিরোধিতা করে আসছিলেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। তাদের যুক্তি ছিল, বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলে পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতার স্বার্থে কিছু বিনিয়োগকে এ সীমার বাইরে রাখতে পারে। যেমন তালিকাবহির্ভূত কোম্পানি ও বিভিন্ন বন্ডে বিনিয়োগ। এটা করা হলে ব্যাংকগুলো পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য কিছু তহবিল বাড়তি পাবে। যেহেতু আমাদের পুঁজিবাজার এখনও পুরোপুরি পরিপক্ব নয়, তাই এখানে ব্যাংকই বাজারের মূলশক্তি। মিউচুয়াল ফান্ডগুলো এখনও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। তাই মিউচুয়াল ফান্ডসহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান পুরোপুরি সক্ষমতা ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত পুঁজিবাজার সচল রাখতে গেলে বাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগের কোন বিকল্প নেই।
×