ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

পরিবেশ দূষণরোধে সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে

পায়রা তাপবিদ্যুত কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট নির্মাণ কাজ শেষের পথে

প্রকাশিত: ০৯:৩৮, ১২ মে ২০১৯

 পায়রা তাপবিদ্যুত কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট নির্মাণ কাজ শেষের পথে

রশিদ মামুন, পায়রা তাপ বিদ্যুত কেন্দ্র থেকে ফিরে ॥ পায়রা তাপ বিদ্যুত কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ শেষের পথে। দেশের বড় বিদ্যুত কেন্দ্রের মধ্যে প্রথম এই কেন্দ্রটির কাজ শেষ হতে চলেছে। বিদ্যুত কেন্দ্র দুটি ইউনিটের মধ্যে প্রথমটির ৯০ ভাগ কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রের পরিবেশ দূষণরোধে সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। যদিও বিদ্যুত কেন্দ্রটির কমিশনিং পাওয়ার (যন্ত্রাংশ পরীক্ষার জন্য বিদ্যুত) এবং বিদ্যুত কেন্দ্রটির সঞ্চালন লাইন নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করতে পারছে না পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি (পিজিসিবি)। ফলে কেন্দ্র তৈরি শেষ হলেও গ্রিডে বিদ্যুত সরবরাহ নিয়ে সঙ্কট তৈরি হবে। প্রায় নয় হাজার শ্রমিক দিন রাত ২৪ ঘণ্টা কাজ করে কেন্দ্রটি নির্মাণ করছেন। জানতে চাইলে বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার কোম্পানির (বিসিপিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এম খোরশেদুল আলম বলেন, আমরা নির্দিষ্ট সময়ে কেন্দ্রটি উৎপাদনে আনার বিষয়ে বদ্ধপরিকর। কেন্দ্রটির সার্বিক অগ্রগতি ৭৭ ভাগ। কিন্তু কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট নির্মাণের কাজ ৯০ ভাগ শেষ হয়েছে। প্রথম ইউনিট বাণিজ্যিক উৎপাদনে আসার তিন মাস পরেই দ্বিতীয় ইউনিট উৎপাদনে আসবে। তিনি বলেন, শীঘ্রই পায়রা তাপ বিদ্যুত কেন্দ্রের ২য় ফেইজ আরো একটি এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্রের জন্য চুক্তি করা হবে। ইতোমধ্যে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে কেন্দ্রটির চুক্তি করার বিষয়ে অনুমোদন দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। পরিবেশবাদীদের সবচেয়ে বড় চিন্তা ছিল কয়লা চালিত বিদ্যুত কেন্দ্রের দূষণ। এজন্য বিদ্যুত কেন্দ্রের মাধ্যমে বায়ু, শব্দ এবং পানি দূষণ রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার দাবি জানিয়ে আসছিলেন তারা। সরকার এসব বিষয় নিশ্চিত না করেই কয়লা চালিত বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করছে এমন অভিযোগে দেশে আন্দোলন করছিল সংগঠনগুলো। তবে কেন্দ্র নির্মাণের একেবারে শেষের দিকে গিয়ে দেখাগেছে পরিবেশ রক্ষায় পায়রা তাপ বিদ্যুত কেন্দ্র সকল আন্তর্জাতিক নীতি অনুসরণ করেছে। প্রতিবেশী দেশ ভারত এবং চীন কোন কোন ক্ষেত্রে কয়লা চালিত কেন্দ্রে উন্মুক্ত অবস্থায় কয়লা রেখে দিলেও পায়রা তাপ বিদ্যুত কেন্দ্র কয়লা রাখার জন্য যে কোল ইয়ার্ড নির্মাণ করেছে তা পুরোপুরি ঢাকনা যুক্ত। জাহাজ থেকে কয়লা ওঠার সময়ও ঢাক না যুক্ত কনভেয়ার বেল্টে আনা হবে। বিদ্যুত উৎপাদনের পর ৯৯ দশমিক ৯ ভাগ ছাই ‘এ্যাশ হপারে’ ধরা হবে। ইতোমধ্যে ছাই কেনার জন্য আগ্রহীরা যোগাযোগ শুরু করেছে। ফ্লাই এ্যাশ সিমেন্ট, সিরামিক এবং হলোব্লক ছাড়াও বিভিন্ন শিল্প কারখানা কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। নির্গত গ্যাস ধরতে ফ্লু গ্যাস ডিসালফারাইজার ইউনিট (এফজিডি) নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে কেন্দ্রটির ৯৬ ভাগ ফ্লু গ্যাস ধরা হবে। এর বাইরেও কেন্দ্রটির ২২০ মিটার উচ্চতার চিমনী নির্মাণ করা হয়েছে। প্রায় ৭৫ তলা ভবনের সমান উঁচু চিমনী দিয়ে বাতাসের নির্দিষ্ট স্তরে ধোঁয়া ছাড়া হবে। যাতে করে পরিবেশ দূষণ সর্বনিম্ন পর্যায়ে থাকবে। বিদ্যুত কেন্দ্রটিতে গিয়ে দেখা গেছে, প্রকল্পের সব অবকাঠামো নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। ইউনিট-১ এবং ইউনিট-২ এর টারবাইন-জেনারেটর বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। ইউনিট-১ এর বয়লার হাইড্রোটেস্ট (পানি দিয়ে কোথাও সমস্যা আছে কিনা দেখা) শেষ হয়েছে ইন্সুলেশনের (তাপ নিরোধ) কাজ শেষের দিকে। বয়লার-২ এর ইরেকশনের কাজ চলছে। চিমনী, জেটি, পানি সরবরাহ লাইনের কাজ শেষ হয়েছে। কোল ডোম, পানি শীতলীকরণ কেন্দ্র, পানি শোধনাগার, কনভেয়ার বেল্টের কাজ শেষের দিকে। কিন্তু সংকট বেঁধেছে বিদ্যুত কেন্দ্রটির কমিশনিং পাওয়ার এবং সঞ্চালন লাইন নিয়ে। বিদ্যুত কেন্দ্রের উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল) কে গত ১৭ ডিসেম্বর পিজিসিবি একটি চিঠি দেয়। ওই চিঠিতে কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুম আল বেরুনী কতিপয় সমস্যার কথা উল্লেখ করে বলেন চলতি বছর মার্চের মধ্যে বিদ্যুত কেন্দ্রটির কমিশনিং পাওয়ার দেয়া সম্ভব হবে। বিদ্যুত কেন্দ্রের যন্ত্রাংশ পরীক্ষার জন্য যে বিদ্যুত প্রয়োজন হয় তাকে কমিশনিং পাওয়ার বলা হয়। কিন্তু পিজিসিবি এখনও কমিশনিং পাওয়ারের ২৩০ কেভির লাইনটি চালু করতে পারেনি। ফলে বড় যন্ত্রাংশ পরীক্ষা করতে পরছে না তাপবিদ্যুত কেন্দ্রটি। বিদ্যুত কেন্দ্রটির এই পর্যায়ে যেসব প্রকৌশলীর দরকার হয় তারা চীন থেকে এসে বসেই রয়েছেন। বিকল্প হিসেবে ৩৩/১১ কেভি ক্ষমতার একটি বিকল্প সাবস্টেশন তৈরি করেছে। যা এই পরিকল্পনাতেই ছিল না। এই ক্ষমতার সাবস্টেশন যে পরিমাণ বিদ্যুত সরবরাহ করে তা দিয়ে বড় যন্ত্রাংশ পরীক্ষা সম্ভব নয়। বড় যন্ত্রাংশ পরীক্ষার জন্য ২৩০ কোভি ক্ষমতায় বিদ্যুত সরবরাহ প্রয়োজন। এই সরবরাহ লাইনটি নির্মাণের সময়সীমা কয়েক দফা বাড়িয়ে আগামী জুনে নির্ধারণ করেছে পিজিসিবি। কিন্তু তা শেষ হতে জুলাই পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে বলে মনে করছেন তাপ বিদ্যুত কেন্দ্রের প্রকৌশলীরা। এর বাইরে বিদ্যুত কেন্দ্রটি উৎপাদনে আসলে যে সঞ্চালন লাইন দিয়ে গ্রিডে বিদ্যুত দেয়া হবে তাও নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। বিদ্যুত বিভাগ থেকে সম্প্রতি একজন প্রতিনিধিকে সঞ্চালন লাইনের অগ্রগতি দেখতে প্রেরণ করা হয়। ওই প্রতিনিধি ফিরে এসে সঞ্চালন লাইন নির্মাণের হতাশাজনক অবস্থার কথা জানায়। ওই মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি ফিরে এসে জানান, এখনও অনেক টাওয়ারের পায়েলিংয়ের কাজ শেষ করতে পারেনি পিজিসিবি। তাপ বিদ্যুত কেন্দ্রের কর্মকর্তারা জানান, এই সমস্যা মাথায় নিয়েও তারা আশা করছেন কেন্দ্রটি আগামী ডিসেম্বরেই বাণিজ্যিক উৎপাদনে আসবে। কেন্দ্রের সব কাজ শেষ করে দুই মাস পরীক্ষামূলকভাবে চালানো হবে। অর্থাৎ বিদ্যুত কেন্দ্রটি অক্টোবর থেকেই একটু একটু করে উৎপাদন করতে শুরু করবে। জানতে চাইলে পিজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুম আল বেরুনী জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা আগস্টের মধ্যে বিদ্যুত সঞ্চালন লাইনের কাজ শেষ করে দেব। লাইন এবং সাবস্টেশন দুটোর কাজই চলছে। এর বাইরে কমিশনং পাওয়ারের জন্য আমরা বিকল্প ব্যবস্থা করে দিয়েছি। আর কমিশননিং মূল পাওয়ারের লাইনটি আশা করা হচ্ছে জুনে শেষ হবে। এদিকে দেখা গেছে তাপ বিদ্যুত কেন্দ্রটি ঘিরে স্থানীয় জনপদে কর্মচাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। চার বছর আগের অজপাড়াগায়ে এখন সৃষ্টি হয়েছে শহুরে আবহ। অনেক দূরের মানুষও এখানে এসে ক্ষুদ্র ব্যবসা করছেন। বেশিরভাগই নিজেদের প্রয়োজনে শিখে নিয়েছেন চীনা ভাষা। চীনারাও কেউ কেউ ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলা বলছেন। এদেরই একজন আল আমিন ট্রেডার্সের কর্মচারী হুমায়ুন কবীর জানান, তিনি বছরখানেক হয় এখানে এসেছেন। তার দোকানের বেশিরভাগ ক্রেতাই চীনা নাগরিক। অনেকটা শহরের সুপারশপের মতো দোকানটিতে এলপিজি সিলিন্ডার থেকে সবজি পর্যন্ত পাওয়া যায়। তিনি জানান, এখানে কেন্দ্রটি নির্মাণের আগে কিছুই ছিল না। অনেক শ্রমিক কাজ করাতে নতুন প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে এই অজপাড়াগায়ে। হুমায়ুন কবিরের মতোই লুকমান, মালেক ব্যাপারী, নাসির উদ্দিন শামিল হয়েছেন এই নতুন যাত্রায়। রাষ্ট্রীয় কোম্পানি নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি (এনডব্লিউপিজিসিএল) এবং চীনের সিএমসি এর যৌথ মূলধনী কোম্পানি বিসিপিসিএল কেন্দ্রটি নির্মাণ করছে। অস্ট্রেলিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করা কয়লাতে কেন্দ্রটি চালানো হবে। মোট এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের কেন্দ্রটির ৬৬০ মেগাওয়াট করে দুটি ইউনিট থাকবে। চীনের এক্সিম ব্যাংকের ঋণ সহায়তায় পটুয়াখালীর পায়রায় কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হচ্ছে। এই জায়গাতে আরও ৪ হাজার ৯২০ মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে।
×