ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

চাষীরা ঝুঁকছেন কম সেচের আবাদে

দিনাজপুরে পানির স্তর আশঙ্কাজনকভাবে নিচে নেমে গেছে

প্রকাশিত: ০৯:৩৭, ১২ মে ২০১৯

 দিনাজপুরে পানির স্তর আশঙ্কাজনকভাবে নিচে নেমে গেছে

সাজেদুর রহমান শিলু, দিনাজপুর ॥ দিনাজপুর জেলায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আশঙ্কাজনকভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে। পানি উত্তোলনে নানা সমস্যার কারণে চাষীরা বাধ্য হয়ে কম সেচের আবাদে ঝুঁকছেন। জলবায়ু পরিবর্তনে একদিকে এ অঞ্চলে বৃষ্টিপাতে পানি রিচার্জ না হওয়া এবং অন্যদিকে অতিরিক্ত পানি উত্তোলনে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নিমে নেমে যাচ্ছে। ফলে এ অঞ্চলে ধানসহ সেচ নির্ভর চাষাবাদ কমেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব অন্যদিকে সেচের জন্য বরেন্দ্র উন্নয়ন বহুমুখী কর্তৃপক্ষের ভূগর্ভস্থ থেকে অপরিকল্পিত পানি উত্তোলনকেই দায়ী করছেন পরিবেশবাদী, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর ও সচেতনমহল। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, প্রতি ১০ বছরে দিনাজপুর জেলায় পানির স্তর প্রায় ১০-১৫ ফুট নিচে নামছে। মাত্র ৩০ বছর আগে যেখানে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ছিল ৩০ ফুট, অপরিকল্পিতভাবে পানি উত্তোলনের ফলে আজ সেখানে পানির স্তর নেমে দাঁড়িয়েছে ৮০ থেকে ৯০ ফুট অথবা তার চেয়েও বেশি। জানা গেছে, ১৯৮৫ সালের খরা মৌসুমে দিনাজপুর জেলায় পানির স্তর ছিল গড়ে ২০ ফুট ৬ ইঞ্চি, ১৯৯৫ সালে পানির স্তর নেমে দাঁড়ায় ৩০ ফুটের উপর। ২০১০ সালে পানির স্তর নেমেছে প্রায় ৬৬ ফুট। বর্তমানে দিনাজপুর জেলায় পানির স্তর নেমে দাঁড়িয়েছে ১৩৫ ফুটে। এ অবস্থায় এসব গভীর নলকূপ আরও যুগোপযোগী না করলে আর কয়েক বছরের মধ্যেই বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দেবে। এতে কৃষক ধান উৎপাদন না করতে পেরে মারাত্মক সঙ্কটে পড়বে। সেই সঙ্গে সরকারের খাদ্যশস্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ভেস্তে যাবে। দেশ চরম সঙ্কটে পড়বে বলে মনে করছেন কৃষিবিদরা। দেশের উত্তরাঞ্চলের দিনাজপুর জেলায় কয়েক বছর আগে থেকেই পানির এই সঙ্কটের তীব্রতা অনুভব করছেন লোকজন। বিশেষ করে পানির অভাবে এখানকার কৃষি ও বনজ সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। শুকিয়ে গেছে নদীনালা। খাল পুকুরেও পানি থাকে না। গ্রামীণ অর্থনীতির চালিকা শক্তি কৃষি বা সেচ এবং যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যম নদী খালও দখল হয়ে গেছে। স্থানীয়দের ভাষায় দিনাজপুরের অনেক এলাকায় আগে থেকেই মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। দিনাজপুরের বীরগঞ্জ, কাহারোল, বিরল ও সদর উপজেলায় পানিশূন্যতার চিত্র এটি। এসব উপজেলার কয়েকটি গ্রামে চলছে পানির জন্য তীব্র হাহাকার। কোন কোন গ্রামের মানুষ দুই কিলোমিটার দূরে গিয়ে নলকূপ থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করছেন। আবার কিছু এলাকায় রাতে নলকূপে একটু করে পানি ওঠায়, লোকজন রাত জেগে পানি সংগ্রহ করছেন। অনাবৃষ্টি আর ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় গ্রামে গ্রামে চলছে পানির জন্য হাহাকার। জানা যায়, বোরো চাষের জন্য নির্বিচারে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে এখন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছেন এসব গ্রামের মানুষ। অনেক এলাকায় চাষাবাদ তো দূরের কথা, মানুষের খাবার পানি পাওয়া দুষ্কর। শনিবার সকালে বীরগঞ্জ উপজেলার লক্ষ্মীপুর এলাকায় সরেজমিন দেখা যায়, দূর-দূরান্ত থেকে হাঁড়ি-পাতিল, বালতি ও কলস নিয়ে পানি সংগ্রহ করতে যাচ্ছেন গ্রামের নারীরা। দেখা যায়, ৫৩নং লক্ষ্মীপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নলকূপে কিছুটা পানি উঠছে। সেখানেই লাইন ধরে পানি সংগ্রহ করছেন তারা। এখানে পানি সংগ্রহ করতে আসা লক্ষ্মীপুর গ্রামের বাসন্তি রানী (৫২) বলেন, ‘কি কোহিম বা, পানির অভাবে ৩ দিন ধরি গাও ধও নাই। হামার যে কি কষ্ট শুরু হইছে, এইটে একদিন থাকিলে বুঝা পাবেন।’ বীরগঞ্জ উপজেলার ৭নং মোহম্মদপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গোপাল দেব শর্মা জানান, লক্ষ্মীপুর গ্রামের বেশ কয়েকটি স্থানে মাটি খুঁড়ে পাইপ বসিয়েও পানি পাওয়া যায়নি। পুকুরের মাটি খুঁড়েও পানি মেলেনি। এই ইউনিয়নের কোন নলকূপে পানি উঠছে না। আশপাশের কয়েকটি গ্রামের মানুষ ৫৩নং লক্ষ্মীপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি নলকূপ থেকে পানি সংগ্রহ করছেন। অনেকে দুুই কিলোমিটার দূর থেকে পানি সংগ্রহ করার জন্য আসছেন। লক্ষ্মীপুর গ্রামের নারী ইউপি সদস্য গান্ধাধারী রায় বলেন, ‘এলাকার মানুষ বলছে রাস্তাঘাট চাই না, পানি চাই। পানি না দিলে ভোট দেব না। এরপরও আমরা তাদের জন্য পানির ব্যবস্থা করতে পারছি না।’ পাশের গ্রামের কৃষক অনিল রায় ও গোলাম মোস্তফা বলেন, জমি আবাদ দূরের কথা, পানির অভাবে মুখ-হাত ধুতে পারি না। গোসল করি না কতদিন। খাবার পানি নেই, রান্নাবান্নার পানি নেই। আত্মীয়-স্বজনরা আমাদের বাড়ি আসতে চাইলে বলি, ‘বাবা মিষ্টি লাগবে না, পানি নিয়ে আসিও। আমাদের গ্রামে এক ফোঁটা পানিও নাই।’ লক্ষ্মীপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র সুমন চন্দ্র রায় জানায়, গত এক মাসে মাত্র ৬ দিন গোসল করেছি। মা পানি সংগ্রহ করতে রাত জেগে নলকূপ চাপেন। অনেক সময় দুই কিলোমিটার দূরে পানি সংগ্রহ করতে যান তিনি। আমরা অনেক কষ্টে আছি। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের বীরগঞ্জ উপজেলার প্রকৌশলী হুমায়ুন কবির বলেন, এ অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম হওয়ায় বেশকিছু এলাকায় পানি উঠছে না। আমরা ইতোমধ্যে ১৩টি নলকূপ বসানোর পদক্ষেপ নিয়েছি। এসব নলকূপের জন্য প্রধান অফিসে বরাদ্দ চেয়ে আবেদন করা হয়েছে। এদিকে পানির জন্য হাহাকার চলছে দিনাজপুরের কাহারোল-বিরল ও সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায়। সদরের ১০ ইউনিয়নের মধ্যে ছয়টিতে পানির ভয়াবহ সঙ্কট। বিভিন্ন মেশিন বসিয়ে বড় বড় গর্ত খুঁড়েও পানির সন্ধান পাচ্ছে না গ্রামের মানুষ। বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) নির্বাহী প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান খান বলেন, বীরগঞ্জের কিছু এলাকায় আমরা খাবার পানি সরবরাহ করি। এরপরও পানির সঙ্কট কিছু এলাকায়। বীরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইয়ামিন হোসেন কয়েকটি গ্রামে খাবার পানি সরবরাহের জন্য বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছেন। আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। পাইপ সংগ্রহের কাজ চলছে। দ্রুত সময়ে বীরগঞ্জ উপজেলায় খাবার পানি সরবরাহ করা হবে।
×