ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শিল্পকলায় যাত্রা উৎসব এবং বিবেকের গান

প্রকাশিত: ০৮:৫৯, ১২ মে ২০১৯

শিল্পকলায় যাত্রা উৎসব এবং বিবেকের গান

সাজু আহমেদ ॥ গ্রামীণ পরিবেশ ও ঐতিহ্যবাহী যাত্রার আবহে সাজানো হয়েছিল পুরো মিলনায়তন। চারিদিকে দর্শকের আসন, মাঝখানে মঞ্চ, লাল-নীল আলোর ঝলকানি। এরই মাঝে বেজে উঠলা সম্মিলিত বাদ্যযন্ত্রের কনসার্ট, যাকে বলা হয় যাত্রার ঐকতানবাদন। ততক্ষণে হলঘর কানায় কানায় পূর্ণ। দর্শক-শ্রোতার সতৃষ্ণ প্রতীক্ষা-যাত্রাপালা শুরু হতে আর কত বাকি? বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে পরীক্ষণ থিয়েটার হলে ২৪-২৬ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হলো ‘যাত্রার নবযাত্রা’ শিরোনামে তিনদিনব্যাপী যাত্রা উৎসব। আয়োজনের বিশেষ আকর্ষণ ছিল বিভিন্ন যাত্রাপালার বিবেকের গান নিয়ে একটি ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠান। উদ্বোধনী পর্বে তিন গুণীকে যাত্রাশিল্পী সম্মাননা দেয়া হয়। এরা হলেন সুলতান সেলিম, ভিক্টর দানিয়েল ও বিবেক শিল্পী গৌরাঙ্গ আদিত্য। উৎসবে অংশগ্রহণকারী দল ও পালাগুলো হলো দেশ অপেরার ‘এক যে ছিলেন মহারানী’। রচনা ও নির্দেশনা মিলন কান্তি দে। জয়যাত্রার ‘দ্বীপের নাম আন্ধার মানিক‘। রচনা- মামুনুর রশীদ, নির্দেশনা- হাবিব সারোয়ার। লোকনাট্য গোষ্ঠীর ‘দুই বিঘা জমি’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার পালারূপ দিয়েছেন শ্যামল দত্ত, নির্দেশনা তাপস সরকার। এছাড়া যাত্রাবিষয়ে উৎসাহ প্রদানের লক্ষ্যে দুটি বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়েও উৎসবে যাত্রা করানো হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থীরা পরিবেশন করেন ‘সোহ্রাব-রুস্তম’। নির্দেশনায় ছিলেন রেজা আরিফ। আয়োজনের শেষ সন্ধ্যায় জাতীয় কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের পারফর্মেন্স এ্যান্ড থিয়েটার স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে মঞ্চায়িত হয় ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’। কবি প্রাবন্ধিক গবেষক আমিনুর রহমান সুলতানের রচনায় পালার নির্দেশনা দিয়েছেন আল্ জাবির। উৎসবে প্রতিটি পালাকে এক লাখ টাকা করে অনুদান দেয়া হয়। উদ্বোধনী পালা ‘এক যে ছিলেন মহারানী’ নানা কারণে ছিল আলোচনায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সামান্য ক্ষতি’ কবিতার ছায়া অবলম্বনে রচিত এ যাত্রাপালায় উঠে এসেছে সমকালীন প্রসঙ্গ। বিশেষ করে বলা যায় নদীর ঘাটে স্নান শেষ করে শীত নিবারণের জন্যে মহারানীর নির্দেশে গরিবের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া, রাজবাড়ির এক পূর্বপুরুষের মৃত্যু দিনে নিজের জন্মদিন পালন করা এবং বিপথগামী সেনাপতি কর্তৃক হত্যা, লুণ্ঠন, মানুষ পুড়িয়ে মারা- এসব ঘটনার দৃশ্যায়ন দর্শকদের নিকট অতীতের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। পালায় মহারানী চরিত্রে বহুমাত্রিক অভিনয় করে ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছেন এ সময়ের যাত্রার হার্টথ্রব নায়িকা পূরবী দত্ত। গোটা যাত্রা উৎসবে তিনিই একমাত্র আলোচিত অভিনেত্রী। এস এম শফি, মণিমালা, আলীনূরও ভাল অভিনয় করেছেন। জয়যাত্রার ‘দ্বীপের নাম আন্ধার মানিক’ তেমন না জমলেও হাবিব সারোয়ার, বেগম তপতী, এ্যানি ভাল অভিনয় করেছেন। লোকনাট্য গোষ্ঠীর ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতার যাত্রারূপ তুলনামুল দুর্বল মনে হয়েছে। অনেক দর্শকই এটিকে যাত্রা নয়, নাটক বলে মন্তব্য করেছেন। এম এ রহিম, পংকজ চক্রবর্তী মোটামুটি অভিনয় করেছেন। যেহেতু তারা পেশাদার যাত্রাশিল্পী নয়, সঙ্গত কারণেই দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি যাত্রাপালার নির্দেশক ও কুশীলবরা প্রযোজনা বিষয়ক আলোচনার বাইরেই থাকবেন। তবে আবহসঙ্গীত, কোরিওগ্রাফি ও প্রযুক্তিগত ভাবনা ওই দুটি পালাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। আমিনুর রহমান সুলতান বঙ্গবন্ধুর ভাষাতাত্ত্বিক বাংলাদেশের দর্শন এবং শিক্ষা ব্যবস্থার আলোকে লিখেছেন ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধ’। ‘সোহরাব-রুস্তম’ পালায় নারী শিল্পী দিয়ে পুরুষ চরিত্র রূপায়ণে পরিবেশনাগত বৈচিত্র্য এসেছে। উৎসবে যাত্রাপালার আসরে দুই বিবেক গলা ছেড়ে গাইলেন ‘ওরে আপন বুঝে চল্ এ বেলা।’ সূত্রধার চিৎকার করে বললেন- আমি যাত্রার বিবেক। যাত্রার বিবেকের গান শুনে তোমাদের নিজেদের বিবেককে জাগ্রত কর। অনুষ্ঠানে ছয়জন বিবেক ১২টি পালায় ১২টি গান গেয়ে শোনান। পালাগুলো হলো ‘রাবন বধ’, ‘সাধক রামপ্রসাদ’, ‘কালাপাহাড়’, ‘আনারকলি’, ‘বাগদত্তা’, ‘রূপবান’, ‘সোহরাব-রুস্তম’, ‘সূর্য সাক্ষী’, ‘একটি পয়সা’, ‘গঙ্গা থেকে বুড়িগঙ্গা’, ‘বাংলার মহানায়ক’। পালার বিবেকরা হলেন কুষ্টিয়ার সত্য চক্রবর্তী, নেত্রকোনার শংকর সরকার, গোপালগঞ্জের গোপাল বিশ্বাস, ময়মনসিংহের জয় গোপাল, মানিকগঞ্জের বাচ্চু খান এবং ঢাকার আবদুর রশীদ। গানের সঙ্গে অভিনয় সংযোগকারী শিল্পীরা ছিলেন এস এ শফি, এম. আলম লাভলু, হাবিব, লিটন, আলীনূর, জি.এম সিরাজ, পূরবী দত্ত, মণিমালা, রিক্তা সুলতানা, মোজাম্মেল হক। শিল্পকলা একাডেমি আয়োজনে এ অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন মিলন কান্তি দে। সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন পূর্ণলাক্ষ চাকমা। দর্শকের মন ভরে না। এক রকম অতৃপ্তি নিয়েই হল ত্যাগ করতে দেখা যায় তাদের। একজন তো বলেই উঠলেন শেষ হয়ে হলো না শেষ। তবে আমরা অপেক্ষায় থাকলাম আরও একটি উৎসব দেখার জন্য। সব মিলে উৎসবটি ভাল একটি আয়োজন ছিল। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী বলেই দিয়েছেন আগামীতে আরও বড় পরিসরে একাডেমিতে যাত্রা উৎসব হবে।
×