ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বাঙালির জনযুদ্ধ ॥ ১২ মে ১৯৭১

প্রকাশিত: ০৮:৫৭, ১২ মে ২০১৯

 বাঙালির জনযুদ্ধ ॥ ১২ মে ১৯৭১

১৯৭১ সালের ১২ মে দিনটি ছিল বুধবার। মে মাসের এইদিন উ থান্ট প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার উদ্দেশ্যে এক পত্রে লেখেন, ২৫ মার্চের ক্রাকডাউনের পর ঢাকা থেকে জাতিসংঘের যেসব কর্মকর্তা ফেরত এসেছেন তাঁদের মাধ্যমে ও অন্যান্য সূত্র থেকে তিনি এক নেতিবাচক পরিস্থিতির আঁচ পেয়েছেন। তিনি ইয়াহিয়াকে জানান, পাকিস্তানের সম্মতি পেলে জাতিসংঘের বিশেষায়িত সংস্থাগুলো ভূমিকা রাখতে পারে। অন্যদিকে, ভারত সরকারও জাতিসংঘে পূর্ব বাংলা থেকে আগত শরণার্থীদের সাহায্যের আবেদন জানায়। জুলাই মাসের শুরুতে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) প্রধান ইরানি নাগরিক প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান ঢাকা সফর শেষে দিল্লিতে যান। যেখানে তিনি সংবাদ সম্মেলনে জানান, পূর্ব বাংলায় যতক্ষণ ভয়ের কারণসমূহ বিদ্যমান থাকবে, ততক্ষণ শরণার্থীরা ভারত থেকে ফেরত যাবে না। ৫ মে জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে প্রিন্স আগা খান শরণার্থী ব্যবস্থাপনায় ভারত ও মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ করেন। এদিন মার্কিন সিনেটর বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটি বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানে সাহায্য বন্ধ রাখার আহ্বান জানায়। বাংলাদেশে মার্কিন বিমান ও ট্যাঙ্ক ব্যবহার সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র সরকার পাকিস্তানের কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করে। মার্কিন কংগ্রেসম্যান কর্নেলিয়াস গ্যালাঘর প্রতিনিধি সভায় বাংলাদেশ সমস্যাটিকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনার জন্য সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর প্রতি আহ্বান জানান। জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যের আহ্বান জানিয়ে বলেন, পূর্ববঙ্গের বাঙালীদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের সংগ্রামকে উপেক্ষা করার কোনো অবকাশ নেই। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস অব আমেরিকার বিশেষ প্রতিবেদক ঢাকা সফর শেষে খবর দেন, শকুনের দল এতো খেয়েছে যে, তাদের আর ওড়ার শক্তি নেই। মার্চ থেকে প্রায় ৫ লাখ বাঙালীর মৃতদেহ তারা খাদ্য হিসেবে পেয়েছে। তবে দায়িত্বশীল মহলের হিসেবে মৃতের সংখ্যা ১০ লাখের ওপর। চট্টগ্রাম-ঢাকা সড়কের শুভপুর সেতু এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে পাক হানাদারবাহিনী ট্যাঙ্ক ও কামান নিয়ে আক্রমণ চালায়। সারাদিন যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা সেতু ত্যাগ করে নিরাপদ স্থানে অবস্থান নেয়। কুমিল্লার চৌমুহনীর দেড় মাইল উত্তরে মান্দারহাট নামক স্থানে এ্যামবুশরত মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য ঘেরাও করার চেষ্টা চালায়। ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাকবাহিনীর তুমুল সংঘর্ষ বাধে। এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা কোনো ক্ষতি স্বীকার না করে নিরাপদ স্থানে চলে আসতে সক্ষম হয়। ব্যর্থ পাকসেনারা পরে মান্দারহাট বাজার সম্পূর্ণভাবে পুড়িয়ে দেয়। ঢাকায় সামরিক কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করে, পাক সেনাবাহিনী মুক্তিবাহিনীর কাছ থেকে সুনামগঞ্জ দখল করে নিয়েছে। পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রধান নুরুল আমিন বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনো রাজনৈতিক সমাধানের প্রশ্ন ওঠে না। নিখিল ভারত ইত্তেহাদুল মোছলেমানের প্রেসিডেন্ট আবদুল ওয়াহিদ বলেন, বাংলাদেশের স্বীকৃতির ব্যাপারে কেউ অংশগ্রহণ করলে তার পরিণতি হবে অত্যন্ত মারাত্মক। জাতিসংঘ সেক্রেটারি জেনালে উ থান্ট বিশেষ এজেন্সিসমূহের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের সাহায্যদানের যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তার জবাবে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বলেন, পাকিস্তান অবশ্যই সাহায্য নেবে, তবে এ সাহায্য বিতরণ করবে নিজস্ব সংস্থাসমূহের মাধ্যমে। নারায়ণগঞ্জে আজিজ সরদারকে আহবায়ক করে ১২৪ সদস্যবিশিষ্ট নারয়ণগঞ্জ শান্তি কমিটি গঠন করে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে কাজ শুরু করে স্বাধীনতা-বিরোধীরা। এইদিন আনন্দবাজার পত্রিকায়” বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজের ব্যাপক গেরিলা আক্রমণ” শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে আজ মুক্তিফৌজ ব্যাপক গেরিলা আক্রমণ চালায়। সীমান্তের ওপার থেকে পাওয়া খবরে জানা যায়, মুক্তিফৌজ কমান্ডোরা রংপুর জেলার কোলাঘাট, মোগলহাট ও অমরখানায় পাকিস্তানী সামরিক ঘাঁটিগুলির ওপর আক্রমণ চালিয়ে যায়। মুক্তিফৌজের কমান্ডো দলের আমচকা হামলায় মোহলহাটে বহু পাকিস্তানী সেনা নিহত হয়। দিনাজপুর জেলায় মুক্তিফৌজ পার্বতীপুর-সান্তাহার রেল রুটে পঞ্চবিবি ও জয়পুরহাট শহরে পাক সামরিক ঘাঁটিগুলির ওপর আক্রমণ চালিয়ে সড়ক-যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করে ফেলে। জয়পুরহাটের সংঘর্ষে সাতজন পাকসেনা নিহত হয়। সেখানে মুক্তিফৌজ রেলওয়ে সিগন্যাল ও বিদ্যুৎ কেন্দ্র উড়িয়ে দেয়। নিকটবর্তী উরি রেলসেতুটিও বিধ্বস্ত। হিলির পাঁচ মাইল উত্তরে পাকিস্তানী সামরিক ঘাঁটির কাছে গেরিলারা একটি ডিজেল ইঞ্জিন ও কয়েকটি বগি উড়িয়ে দেয়। পটুয়াখালী, ভোলা ও বরিশালে মুক্তিফৌজ সক্রিয়, তৎপর। দক্ষিণ-পূর্ব রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজে ফেনী এলাকায় শুভপুরে পাকিস্তানীদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এতে বহু পাকসৈন্য খতম হয়। মুক্তিফৌজ কমান্ডোরা কুড়িগ্রামে পাকিস্তানী ঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিফৌজের ১২ জন বন্দী জওয়ানকে ছাড়িয়ে আনে। ধরলা ও কুড়িগ্রামের মধ্যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু কমান্ডোরা ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়। ময়মনসিংহ জেলার দুর্গাপুর থানার কাছে পাকিস্তানী সৈন্যদের সঙ্গে এক সংঘর্ষে কমান্ডো দল অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ ভর্তি তিনটি জীপ আটক করে। পাঁচদিন ধরে হানাদার বাহিনীকে বাঁধা দেয়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা আখাউড়া চেকপোস্ট থেকে আজ বিকালে সরে গিয়েছে। মুক্তিফৌজ মহল থেকে বলা হয়েছে, সরে আসার আগে মুক্তিযোদ্ধারা ডজনখানেক পাকসেনাকে খতম করে। মুক্তিফৌজের একজন কমান্ডার জানান, রণকৌশলের অংশ হিসেবেই এই পশ্চাদপসারণ। অমৃতবাজার পত্রিকা ’চট্টগ্রামে পাক বর্বরতা’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়,পূর্ববঙ্গের এই বন্দরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক ব্যাপক শেলিং ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। সাধারণ জনগণের উপর ব্যাপক হত্যাকান্ড পরিচালিত হয়। মাত্র পাঁচ দিন আগে ১১০ কিলোমিটার দক্ষিণে অন্যান্য অঞ্চলে তারা মুক্তি ফৌজের মুখোমুখি হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি তবে সেখানে শ্রমিকের অভাবে কার্গো জমে আছে যা দিয়ে অভ্যন্তরীণ পরিবহনে ব্যবহৃত হয়। চট্টগ্রামের শিল্পপতিরা বলেছেন, এখানকার অর্থনীতি ও কার্যকলাপ পূনরুদ্ধারের জন্য অনেক মাস লাগবে। এই দিন চট্টগ্রাম ছিল ছয় বিদেশী সাংবাদিকের চার দিনের সফরের সর্বশেষ স্টপ। ২৬ শে মার্চের নিষেধাজ্ঞার পর থেকে এরাই প্রথম সংবাদদাতা যাদের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এটি পূর্ববাংলায় কয়েক ডজন শহরগুলির প্যাটার্ন প্রায় একই রকম। কুমিল্লাতেও সংবাদদাতারা দেখেছিলেন যে, ক্ষতি হয়ত কম ছিল কিন্তু পরিবেশ উত্তেজনাময় ছিল। কুমিল্লা, যেটি ভারতীয় সীমান্ত বরাবর একটি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা- যেখানে সৈন্যরা ব্যাপকভাবে অটোমেটিক অস্ত্র সহ টহল দিচ্ছে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×