ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

হারমিটাজ জাদুঘর- সেন্ট পিটার্সবার্গ

প্রকাশিত: ০৮:৫৬, ১২ মে ২০১৯

হারমিটাজ জাদুঘর- সেন্ট পিটার্সবার্গ

১৯৮১ সালে বাংলাদেশ সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের যুগ্ম-সচিব হিসেবে ঘোড়াশাল ২১০ মেঃ ওঃ তাপবিদ্যুত কেন্দ্র তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ঋণ সহায়তায় আনা ও স্থাপন করার জন্য আমি সেদেশে গিয়েছিলাম। সোভিয়েত কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তখনকার সময়ের প্রায় নিম্নতম আন্তর্জাতিক মূল্যে (৭২ মিলিয়ন ডলার) এই তাপ বিদ্যুত কেন্দ্র তাদের দিয়ে সরবরাহকরণ ও স্থাপনের জন্য চুক্তি করার চূড়ান্ত পর্যায়ে আমি হাসতে হাসতে বলেছিলাম, মস্কোতে বলশয় থিয়েটারের ব্যালে নৃত্য আর লেনিন গ্রাদের (এখনকার সেন্ট পিটার্সবার্গ) হারমিটাজ জাদুঘর না দেখে আমরা চুক্তি সই করব কি করে? সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ হাসতে হাসতে বললেন, আমরাও বা কিভাবে আমাদের দুই ঐতিহ্যের শীর্ষ নিশানা না দেখিয়ে তোমাদের ফিরে যেতে দেব? চুক্তি সই করার আগেই তোমরা বলশয় ব্যালে ও হারমিটাজ জাদুঘর দেখতে পারবে এবং তাই তারা করেছিলেন। এভাবেই বলশয়ের ব্যালে এবং হারমিটেজ দেখার বিরল সৌভাগ্য আমাদের হয়েছিল। এর বাইরে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ আমাদের দেখিয়ে দিলেন চায়কোভস্কি থিয়েটার ও মস্কো রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়। বলশয় ব্যালে আমাদের দেশে বেশ পরিচিত। সেই তুলনায় হারমিটাজ জাদুঘর- যা সারা বিশ্বের চিত্র কর্ম ও প্রত্ন সামগ্রীর প্রধান সংগ্রহশালা, তেমনিভাবে পরিচিত নয়। হারমিটাজ জাদুঘরের ওপর তাই একটি অবতারণামূলক লেখা পাঠকদের হাতে তুলে দেয়া পালনীয় দায়িত্ব বলে আমি মনে করেছি। সুনির্দিষ্ট একক লক্ষ্যে নিবেদিত তপোবন সদৃশ হারমিটাজ জাদুঘর ১৭৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। সমকালে এটি পৃথিবীর ২য় বৃহত্তম চিত্র শিল্পের সংগ্রহশালা। প্যারিসের লুভ জাদুঘর বা সংগ্রহশালার পরেই এর স্থান। শান্ত, নিস্তরঙ্গ ও বিস্তৃত নেভা নদীর ডান পাড়ে হারমিটাজ জাদুঘর পাশাপাশি অবস্থিত ৫টি ইমারত নামত (১) শীত কালের প্রাসাদ (উইন্টার প্যালেস), (২) ক্ষুদ্র হারমিটাজ, (৩) পুরনো হারমিটাজ, (৪) নতুন হারমিটাজ, (৫) হারমিটাজ নাট্যশালা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত। ৩০ লাখেরও বেশি চিত্রশিল্প ও অন্যান্য প্রত্ন সম্ভার নিয়ে এই জাদুঘর। সম্ভবত এটি পৃথিবীর বৃহত্তম জাদুঘর। বিভিন্ন যুগের প্রদর্শনীয় চিত্রশিল্প ও কারুকর্ম, মুদ্রা, অস্ত্রশস্ত্র এবং পোর্সেলিনের পাত্র ও তৈজসপত্রাদি নিয়ে এই জাদুঘর পৃথিবীর সকল জাতির সৃজনশীলতার সংগৃহীত ঐতিহ্য হিসেবে বিবেচনীয়। পৃথিবীর প্রায় সকল দেশ ও এলাকা থেকে চিত্রশিল্প, দেয়াল আবরণী, প্রত্ন দ্রব্য, ব্যবহৃত তৈজস, বস্ত্র, অস্ত্র, সোনা, রুপা, দস্তা ও পিতলের মুদ্রা এই জাদুঘরে প্রায় ৪০০ বছর ধরে আহরিত হয়েছে। চীন, মঙ্গোলিয়া ও ভারত থেকে চিত্রশিল্প, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকার আদিবাসীদের ব্যবহৃত নিদর্শনমূলক দ্রব্য, পণ্য এবং পূরনো মিসর থেকে আনা প্রত্ন সম্ভার এখানে সংরক্ষিত হয়েছে। হারমিটাজ জাদুঘর ১৭৬৪ সালে প্রতিষ্ঠা করেন তৎকালীন রুশ সাম্রাজ্ঞী মহামতী ক্যাথেরিন। শীতকালীন প্রাসাদে- যা রুশ সম্রাট বা জারদের নিবাস হিসেবে ব্যবহার্য ছিল তা সাম্রাজ্ঞী ক্যাথেরিন ক্রমান্বয়ে চিত্রশিল্প ও অন্যান্য প্রত্ন সম্ভার সারা পৃথিবী থেকে সংগ্রহ করে ভরিয়ে তুলেন। এই সাম্রাজ্ঞী শিল্প ও সংস্কৃতির অন্যতম পীঠস্থান হিসেবে সেন্ট পিটার্সবার্গ ও এই জাদুঘরকে প্রতিষ্ঠা দেয়ার লক্ষ্যে সে সময়কার প্রথিতযশা শিল্পীদের ৪০০০ চিত্র-শিল্প, ৩৮,০০০ বই, ১০,০০০ খোদিত মণিমুক্তা, ১০,০০০ রেখা চিত্র, ১৬,০০০ মুদ্রা ও মেডাল ক্রয় কিংবা বন্ধুত্ব বা সমঝোতার ভিত্তিতে সংগ্রহ করেন। বিশেষত পশ্চিম ইউরোপ থেকে ১৩ থেকে ১৭ শতাব্দীর চিত্রশিল্প, স্থাপত্য, রেখাচিত্র সংগ্রহ ও সংরক্ষণের ওপর তার বিশেষ দৃষ্টি ছিল। জাদুঘরের ৪ প্রধান ইমারতের ১ ও ২ তলার ১২০ সংখ্যক কামরাগুলোতে এসবের বেশির ভাগ সন্নিবেশিত করা হয়। প্রাচীন মিসর থেকে সংগৃহীত মূল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রী ও নিদর্শনসমূহ কেবল শীতকালীন প্রাসাদের নিচ তলায় স্থান পায়। সৌম্য, শান্ত ও বিস্তৃত নেভা নদীর পাশে সকল সংগ্রহ প্রধানত এই ৪ ইমারতে প্রদর্শনীয় অবয়বে রাখা হয়। সাম্রাজ্ঞী ক্যাথেরিনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে পরবর্তীকালে সম্রাট প্রথম আলেকজান্ডার ও প্রথম নিকোলাস শীতকালীন প্রাসাদটিকে চিত্রশিল্প, প্রত্নদ্রব্য ও সামগ্রীতে সমৃদ্ধ করেন। প্রথম দিকে এই জাদুঘরের প্রবেশাধিকার কেবল রাজন্যদের মাঝে সীমিত ছিল। ১৮৫২ সালে হারমিটাজের সকল ইমারত জনগণের দর্শনের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। স্মর্তব্য, ব্রিটেনের লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারের পশ্চিম সীমায় অবস্থিত জাতীয় গ্যালারি জনগণের জন্য উন্মুক্ত করা হয় আরও আগে, ১৮২৪-এ। ১৯১৭ এর বিপ্লবের পর সমগ্র হারমিটাজ রাষ্ট্রীয় মালিকানা ও পরিচালনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় ও সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যান্য জাদুঘর থেকে বেশ সংখ্যক নামকরা প্রদর্শনীয় চিত্র ও প্রত্ন-সামগ্রী হারমিটাজে স্থানান্তর করা হয়। ১৯৩০-৩৪ সালে তৎকালীন সোভিয়েত সরকার অর্বাচীনতার চরম পর্যায়ে অর্থ সংগ্রহের মোড়কে হার্মিটাজ থেকে ২০০০ এরও বেশি চিত্রশিল্প ইউরোপ ও আমেরিকায় গোপনে বিক্রি করে। তেমনি ১৯৩১ সালে হারমিটাজ থেকে ওয়াশিংটন ডিসির জাতীয় চারুকলা সংগ্রহশালায় ২১টি ঐতিহ্যবাহী চিত্রশিল্প স্বল্পমূল্যে হস্তান্তর করে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের তান্ডবলীলা থেকে হারমিটাজে রক্ষিত চিত্র ও সামগ্রী সযত্নে সোভিয়েত সরকার প্রতিরক্ষণ করে ছিল। মহাযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে জার্মানি ও পূর্ব ইউরোপের অন্যান্য দেশ থেকে হারমিটাজের জন্য প্রত্ন সামগ্রী সোভিয়েত সরকার কর্তৃক সংগ্রহ করে আনা হয়। বছরে ৪২ লাখেরও বেশি দর্শক এই জাদুঘর দেখেন। পক্ষান্তরে ব্রিটেনের লন্ডনের জাতীয় গ্যালারিতে গত বছর দর্শনার্থীর সংখ্যা হয়েছিল ৫৭ লাখের বেশি। বলা হয়ে থাকে, হারমিটাজে যেসব চিত্রশিল্প ও প্রত্ন সামগ্রী রক্ষিত তা কেউ এক জীবনে দেখে শেষ করতে পারবেন না। এ মনে রেখেই আমি সেই সফরকালীন সময়ে হারমিটাজের শীতকালীন প্রাসাদে একদিন ধরে প্রধানত চিত্রশিল্প দেখায় মনোনিবেশ করেছি। অনেকক্ষণ ধরে দেখেছি রেমব্রান্ডট্রের ‘ক্রস থেকে নেমে আসা’ (১৬২৪), ফ্রান্স হালসের ‘হাত মোজা পরা যুবকের মুখচ্ছবি’ (১৬৫০), লিওনার্ডো ভিঞ্চির ‘ম্যাডোনা লিটা’ (১৮৭০), টিটিয়ানের ‘আয়না হাতে প্রেম দেবী’ (আঁকার কাল অজানা), ভেগাসের ‘কনকর্ডের নিলয়’ (আঁকার কাল অজানা), ভ্যান গগের ‘রাতের হোয়াইট হাউস’ (আঁকার কাল অজানা)। দেখেছি পিকাসোর ২৭টি চিত্র কর্ম- এক পুরো কামরা ভরে সাজানো। পিকাসোর এত বড় সংগ্রহ প্যারিসের পিকাসো জাদুঘরের বাইরে, এমনকি নিউইয়র্কের মহানগরী ললিতকলা জাদুঘরেও আমি দেখতে পাইনি। অবশ্য পিকাসোর জগদ্বিখ্যাত ‘গোয়ার্নিকা’ হারমিটাজে নেই- যা ১৯৮১ সালে নিউইয়র্কের আধুনিক ললিতকলা জাদুঘরে দেখতে পেরেছি। তার আরেক বিখ্যাত চিত্রশিল্প ‘সেবাইন নারীদের ধর্ষণ’ মুগ্ধ নয়নে বার বার দেখেছি বস্টন ললিতকলা জাদুঘরে। হারমিটাজে রক্ষিত রেমব্রান্ডের ১৩টি, রুবেনস এর ১১টি, রাফায়েলের ২টি চিত্রশিল্প জগতের অমূল্য সম্পদ। এই জাদুঘরে রক্ষিত জার্মান শিল্পী কাসপার ডেভিড ফ্রেডারিক এর ‘সমুদ্র তটে চন্দ্রোদয়’, ফ্রানজ স্টাকের ‘এক নারী নিয়ে দুই পুরুষের সংগ্রাম’ অপূর্ব ও অবিস্মরণীয়। বিখ্যাত চিত্রশিল্পী রেনো, মনেট, ভ্যান গগ, সিজানে, পিসারেত ও ভেগাসের আঁকা শিল্পকর্ম আমাকে মোহিত করেছে। মনেট এর ‘প্রাতকালের ভাবধারণা’ এই জাদুঘরের অন্যতম আকর্ষণ। এসব দেখতে দেখতে মনে এসেছে প্যারিসের ল্যুভ জাদুঘরে রক্ষিত সর্বকালের অবিস্মরণীয় দ্য ভিঞ্চির ‘মোনালিসা’ যা প্রায় ১ ঘণ্টা ধরে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আমি প্রথমবার দেখেছিলাম। যুগ পরম্পরায় মানুষের চোখ আর অন্তর দিয়ে দেখা ও অনুধাবনের এই সকল হৃদয়স্পর্শী প্রতিস্থাপন ও প্রতিবিম্ব। ইহকালে দর্শনার্থীদের জীবনকে যাপন করার যৌক্তিকতায় অনুধাবিত করে। হারমিটাজে চিত্রশিল্পের এই বিশাল সংগ্রহের পটে একদিকের দীনতা চোখে লাগে। এখানে সমসাময়িক চিত্রশিল্পের সংগ্রহ প্রায় নেই বললেই চলে। অতীতের পটে বর্তমানকে যাচাই করে ভবিষ্যতের স্বপ্ন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের সামনে তুলে দেয়ার চিরন্তন প্রক্রিয়ায় বর্তমানকে অবহেলা করা সম্ভবত পূর্র্ণাঙ্গ সৃজনশীল কার্যক্রম হিসেবে অন্তর্ভুক্তি নয়। অবশ্য ইউরোপের জাদুঘরসমূহের তুলনায় সমকালীন প্রদর্শনীয় শিল্প কর্মের প্রতি আপেক্ষিকভাবে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন জাদুঘর। ১৯১৭ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গে যে সমসাময়িক নিরাভবন দাগচটা টেবিলে দাঁড়িয়ে মহামতী লেলিন অগণিত জনগণের সামনে সাধারণ মানুষের সত্তার প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন, (সেই টেবিল এখনও সংরক্ষিত) তার যথার্থ অনুসরণে সমকালকে অবহেলা করার কোন পরিসর সৃজনশীলতার চলমানয়তায় স্থান পেতে পারে না। এদিকে হার্মিটাজ কর্তৃপক্ষ যত তাড়াতাড়ি দৃষ্টি দেবেন তত তাড়াতাড়িই সেই বিপ্লবোত্তর কর্মজীবী ও উৎপাদনশীল জনগণ তাদের অতীতের আলোকে আরও অর্থবহ ভবিষ্যত গড়তে সন্দিপীত হতে পারবে। হারমিটাজ, ল্যুভ ও অন্যান্য ইউরোপীয় জাদুঘর স্থাপন ও গড়ার ইতিহাস মনে করিয়ে দেয়, সে মহাদেশের নৃপতিরা মানুষের সৃজনশীল ঐতিহ্য ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে প্রতিফলিত করার ক্ষেত্রে যেরকম আগ্রহী ও সক্রিয় ছিলেন, এশিয়া বিশেষত এই উপমাহাদেশের রাজা-সুলতান- বাদশারা তেমন ছিলেন না। এ স্বীকার করে নিলেও এশিয়া ও এই উপমহাদেশে সৃষ্ট ও বিকশিত লোকজ শিল্প সংস্কৃতির নিদর্শনাদি সংরক্ষণ করে ইউরোপিয়ান ও আমেরিকান প্রতœতত্ত্ববিদরা তাদের প্রশংসনীয় কাজ অধিকতর বিস্তৃত ও পূর্ণাঙ্গ করতে পারবেন বলে আমার মনে হয়। এই প্রেক্ষিতে ও লক্ষ্যে ইউরোপের হারমিটাজ ও ল্যুভ এবং আমেরিকার নিউইয়র্ক, শিকাগো ও বস্টনের ললিতকলা কেন্দ্রসমূহ মানুষের সৃজনশীলতার আরেক অবহেলিত দিক- লোকজ সংস্কৃতি সংরক্ষণের দিকে নজর দিতে পারে এবং এক্ষেত্রে আমাদের দেশের ও ভারতের জাদুঘরগুলো ঐসব বিশাল ও সফল প্রত্নতাত্ত্বিক সংরক্ষণাগারসমূহের সঙ্গে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করতে পারে। আমার ধারণা বাংলাদেশ থেকে এই ধরনের প্রস্তাব গেলে এক্ষেত্রে ও লক্ষ্যে হারমিটাজ কর্তৃপক্ষ সানন্দে এগিয়ে আসবেন। হার্মিটাজ দেখে আমি উদ্বেগ ভারাক্রান্ত মনে ভেবেছি, এই উপমহাদেশের প্রথিতযশা শিল্প ও চারুকলাবিদদের সৃষ্টি আমরা সযত্নে সংরক্ষণ করতে ভুলে গিয়েছি। রামকিংকর, যামীনি রায়, চুগতাই, ফিদা হাসান, এমনকি বাংলাদেশের জয়নুল, এসএম সুলতান, কিবরিয়া ও কামরুলের সৃজনসমূহ ব্যক্তিগত সংগ্রহের বাইরে সংরক্ষিত নেই বললেই চলে। এসব সম্পদের সম্ভাব্য হারিয়ে যাওয়ার অপমান থেকে বাঁচতে হলে আমাদের এদের শিল্পকর্ম সংরক্ষণ ও প্রদর্শনে অধিকতর সচেতন হতে হবে। প্রায় এক যুগ আগে হারমিটাজে রক্ষিত এসব চিত্রশিল্পসমূহের বিভিন্ন দিক নিয়ে প্যারিস নিবাসী বাংলাদেশের প্রখ্যাত শিল্পী শাহাবুদ্দিন তার স্ত্রী আনার সঙ্গে আমি ও স্ত্রী সিতারা তার প্যারিসের নিবাসে দীর্ঘ সময় নিয়ে কথা বলেছি। শাহাবুদ্দিন হারমিটাজে সংরক্ষিত এসব শিল্পকর্মকে পৃথিবীর সকল সৃজনশীল মানুষের উত্তরাধিকার হিসাবে বিবেচনা করেছেন ও সম্মান জানিয়েছেন। তেমনি সে বছরই আরেক বিখ্যাত মাদ্রিদ প্রবাসী বাঙালী শিল্পী মনিরুল ইসলামের সাথে মাদ্রিদে তার নিবাসে গভীর রাত পর্যন্ত এসব ধ্রুপদী শিল্পের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করেছি আমি ও সিতারা। হারমিটাজে রক্ষিত ও প্রদর্শিত ঐসব শিল্পকর্ম সম্পর্কে মনিরের উচ্ছ্বসিত নিবেদন- এসব চিত্রশিল্প সব দেশের শিল্পপিয়াসীদের তৃপ্তি ও সন্তোষের চিরায়ত আধার, এরা সবাই আধুনিক চিত্রশিল্পীদের নমস্য ও অনুকরণীয়। স্পেনে জন্ম নেয়া পিকাসোর শিল্পকর্ম ‘গোয়ার্নিকা’র যে ব্যাখ্যা মনিরুল ইসলাম সে রাতে আমাদের দিয়েছেন তা অন্যার্য যুদ্ধ ও সংঘাতবিরোধী শিল্পীর পরিপূর্ণ ভাবধারা আমাদের কাছে পরিস্ফূটিত করেছে। স্মর্তব্য, পিকাসো আজীবন কমিউনিস্ট ভাবধারায় প্রভাবিত থেকে সাধারণ মানুষের জন্য শিল্পকর্মকে নিবেদিত করতে চেয়েছেন। হার্মিটাজ জাদুঘর কর্তৃপক্ষ নেদারল্যান্ডসের আর্মস্টারডাম, ইতালির ফেরারা নগর, লিথুনিয়ার রাজধানী ও রাশিয়ার পূর্বান্ত ভ্লাডিভোস্টকে হার্মিটাজ নামেই তার তাদের শাখা খুলেছেন। এসব স্থানে মূল হারমিটাজ থেকে সময়ান্তরে চিত্রশিল্প ও প্রত্ন সামগ্রী পাঠিয়ে এবং প্রদর্শন শেষে আবার মূল হারমিটাজ নিয়ে রাখার প্রশংসনীয় প্রক্রিয়া তারা অনুসরণ করছেন। উল্লেখ্য, ব্রিটিশ জাদুঘর বা লন্ডনস্থ জাতীয় গ্যালারি কিংবা নিউইয়র্কের মহানগরী ললিতকলা কেন্দ্র এই ধরনের শিল্পের বিচ্ছুরণধর্মী পদক্ষেপ নিতে এখনও এগিয়ে আসেনি। আমাদের ছেলে জয় সপরিবারে গত বছর হার্মিটাজ দেখে এসেছে। হার্মিটাজের কথাও শুনেছিল আমাদের কাছ থেকে। দেখে এসে বলেছে, আমরা মুগ্ধ হয়েছি হার্মিটাজ দেখে। তোমরা আবার দেখে এসো সেই হার্মিটাজ। আমি ও সিতারা নির্দ্বিধায় বলেছি- আমরা আবার যাব। ১৯৮০ থেকে এই শতাব্দীর ২য় দশকের শেষ পর্যন্ত হারমিটাজে আহরিত নতুন ও মোহন চারুকলা সম্ভার দেখে তৃপ্তি নিয়ে শান্ত ও নিস্তরঙ্গ নেভার তীর থেকে এই পদ্মা, মেঘনা, যমুনা তটে ফিরে এসে সেই জাদুঘরের কথা, সবাইকে বলব। লেখক : সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী
×