ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

১১ মে, ১৯৭১

শত্রুকে নির্মূল না করে ক্ষান্ত হব না!

প্রকাশিত: ১০:১৯, ১১ মে ২০১৯

শত্রুকে নির্মূল না করে ক্ষান্ত হব না!

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ ॥ ১৯৭১ সালের ১১ মে দিনটি ছিল মঙ্গলবার। বাংলাদেশের মুক্তিপাগল মানুষ দখলদার পাকবাহিনীকে রুখে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত পাক ফৌজের বিরুদ্ধে চলছে মুক্তিবাহিনীর প্রচন্ড লড়াই। অস্ত্র বলে বলীয়ান পাক সেনাদের নায়ক টিক্কা খান ভেবেছিল মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ভেঙ্গে দেয়া যাবে বাঙালীর প্রতিরোধ। কিন্তু তাদের সে আশা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। প্রতিদিন বাড়ছে মুক্তি বাহিনীর শক্তি। বাংলাদেশের হাজার হাজার দেশপ্রেমিক মানুষ প্রতিদিন যোগ দিচ্ছে মুক্তিবাহিনীতে। স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী নিচ্ছে দখলদার পাকবাহিনীকে খতম করার চূড়ান্ত প্রস্তুতি। শত্রুর কামান চিরতরে স্তব্ধ না করা পর্যন্ত থামবে না এ যুদ্ধ। এছাড়া কি অন্য কোন পথ খোলা ছিল সাড়ে সাত কোটি বাঙালী ও নেতাদের জন্য? এই দিন সিলেটের মুকুন্দপুর থেকে আজমপুরগামী পাকবাহিনীর এক কোম্পানি সৈন্যকে মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লার নরসিঙ্গার নামক স্থানে এ্যামবুশ করে। এই এ্যামবুশে হানাদার বাহিনীর ৬৩ জন সৈন্য নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লার মীরগঞ্জে পাকবাহিনীর ওপর তীব্র আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের গোলার মুখে পাকসেনারা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে অস্ত্রশস্ত্র ফেলে দিয়ে প্রাণপণে পালিয়ে যায়। তাদের কয়েকজন হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা এ যুদ্ধে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র হস্তগত করে। এদিন গোপালগঞ্জের মানিকহার গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি পাকবাহিনী চারদিক থেকে ঘেরাও করে ফেলে এবং হামলা চালায়। গোপালগঞ্জ সদর উপজেলাপ উরফী গ্রামে ইপিআর সদস্য আব্দুর রবের নেতৃত্বে প্রতিরোধ যুদ্ধে ৫ জন পাকবাহিনী নিহত হয় এবং ১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। পাকবাহিনী আত্রাই উপজেলার সিংসাড়া গ্রামে হঠাৎ আক্রমণ করে ২৯ জন লোককে হত্যা করে। তারা অনেক বাড়িঘর লুটপাট করে ও জ্বালিয়ে দেয়। প্রচন্ড যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ঘাঁটি ত্যাগ করে নিরাপদ আশ্রয়ে পিছিয়ে এসে নতুনভাবে প্রতিরক্ষা ব্যূহ রচনা করে। চট্টগ্রামের শুভপুর সেতুর দুপাড়ে মুক্তি বাহিনী ও পাক বাহিনীর মধ্যে তীব্র মুখোমুখি যুদ্ধ হয়। প্রচন্ড যুদ্ধের পর হাতিয়া পাকবাহিনীর দখলে চলে যায়। তারপর স্থানীয় দালালদের সহযোগিতায় তারা ব্যাপক হত্যাকান্ড চালায়। এদিন সিনেটর এ্যাডওয়ার্ড কেনেডি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে বলেন, আমাদের সরকারের একাংশ নিরপেক্ষতার দোহাই দিয়ে বলেছেন, পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপারে আমাদের জড়িত হওয়া উচিত নয়। কিন্তু আমরা সেখানে জড়িয়ে পড়েছি। সেখানে সহিংসতার কাজে আমাদের দেয়া অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে। আমি মনে করি, পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান রাজনৈতিক ও মানবিক সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব মুখ্যত পাকিস্তানের। এ পরিস্থিতির উত্তরণে আমি আমাদের সরকার, পাকিস্তান নেতৃবৃন্দ ও বিশ্ব নেতৃবৃন্দের প্রতি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য আবেদন জানাচ্ছি। একই সঙ্গে শরণার্থীদের সাহায্য করার জন্য ভারত সরকার বিশ্বের প্রতি যে আবেদন জানিয়েছেন, তাতে সারা দেয়ারও অনুরোধ করছি। আমি মনে করি না, পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান সমস্যা অবজ্ঞা করার মতো একটি বিষয়। এ ব্যাপারে অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্র সরকারের করণীয় আছে। লাখ লাখ নিরপরাধ মানুষের জীবন রক্ষার দায়িত্ব এ বিশ্বের প্রতিটি সরকারেরই এবং মানবজাতির স্বার্থে তা পালন করতেই হবে। এদিন পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রধান নুরুল আমিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। সাক্ষাতে নুরুল আমিন প্রেসিডেন্টকে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক তৎপরতা বৃদ্ধি করার সবিনয় অনুরোধ জানান। শান্তি কমিটি এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তাদের সঙ্গে সর্বক্ষণিক যোগাযোগের জন্য ২৫৭৭৬৫ ও ২৮৩২৬৬ এই ফোন নম্বর দুটি ব্যবহার করতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানায়। ঢাকায় স্বাধীনতাবিরোধীরা আরও তৎপর হয়ে ওঠে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় শান্তি কমিটির ২৫টি ইউনিয়ন শাখা গঠিত হয়। এদিন জয়বাংলা পত্রিকায় বলা হয়, এ যুদ্ধ আপনার আমার সকলের। রক্তের অক্ষরে লেখা হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস। যেমন লেখা হয়েছে আরও অনেক দেশের। অন্যান্য দেশের মানুষের দেশপ্রেমের কাছে হার মেনেছে বিদেশী হানাদাররা। আমাদের কাছেও মানবে। ঘাতকের ক্ষমা নেই। শত্রুকে নির্মূল না করে ক্ষান্ত হব না আমরা। বিদেশী পর্যবেক্ষকদের মতে বাংলাদেশের অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়াটা ইয়াহিয়া সরকারের কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ সাহায্যে স্যাবর জেট কিংবা চাইনিজ মিগ ব্যবহার করে চালানো জ্বালাও-পোড়াও নীতিতে ধ্বংস হয়েছে শস্যভা-ার, চা বাগান এবং গুদাম যা আর্মির ভয়ভীতি প্রদর্শনের অস্ত্র হিসেবে দুর্ভিক্ষ এবং অর্থনৈতিক মন্দার দিকে নির্দেশ করছে। দেশটির জন্মলগ্নে আন্তর্জাতিক সঙ্কট দেখা দিতে পারে। রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য দেশে এখনও নেতৃত্ব প্রদানকারী দল রয়েছে। একটি শান্তিপূর্ণ উপায়ে দেশ বিভাজনের বন্দোবস্ত করা আবশ্যক। গণহত্যার দ্বারা পরিষ্কারভাবে ইয়াহিয়ার যুদ্ধের নির্দেশ পাওয়া যায় এবং সে ধরে নেয় পাকিস্তান মৃত এবং সে জাতির জন্য মানবতা প্রকাশের কোন লক্ষণই ছিল না। আকস্মিক এই যুদ্ধের ফলে সমগ্র বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ক্ষয়ক্ষতির পূরণ অচিন্তনীয়। যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত এই জাতিকে ভবিষ্যতে টিকে থাকার জন্য দারিদ্র্যতা, অনাহার ও রোগ-বালাই থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য বাস্তবতা নিরীক্ষণের মাধ্যমে একটি অর্থনৈতিক পরিকল্পনা কর্মসূচী নিতে হবে। এ ধরনের কোন কর্মসূচী যার দ্বারা যুদ্ধের ভয়াবহতা সম্পর্কে বিশ্ববাসীর বিবেককে জাগ্রত করতে পারে। পর্যাপ্ত পরিমাণের আন্তর্জাতিক সাহায্যের দ্বারা ক্ষয়ক্ষতি পূরণ করে ভবিষ্যতে গণতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায়বিচারের অবকাঠামো তৈরি করতে পারবে। ভারতীয় পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এক বিবৃতিতে বলেন, আমি ১৫ ও ১৬ মে আসাম, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গ সফরে যাই বাংলাদেশের শরণার্থীদের দুঃখ-দুর্দশার অংশীদার হতে, তাদের প্রতি সংসদের ও দেশবাসীর সহানুভূতি-সমর্থন জানাতে এবং তাদের সেবা করার জন্য যেসব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা দেখতে। আমাদের আপ্রাণ ইচ্ছা থাকা সত্ত্বে¡ও আমরা সব শরণার্থীকে আশ্রয় দিতে পারিনি। অনেকে এখনও খোলা জায়গায় রয়েছেন। কর্তৃপক্ষের ওপর ভীষণ চাপ পড়ছে। প্রতিদিন ৬০ হাজার করে শরণার্থী সীমান্ত পার হয়ে ভারতে আসছেন। গত ৮ সপ্তাহে প্রায় ৩৫ লাখ লোক বাংলাদেশ থেকে ভারতে এসেছেন। এরা বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী, সমাজের বিভিন্ন স্তরের ও বয়সের লোক। এরা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে সামরিক সন্ত্রাসের হাত থেকে বাঁচার জন্য সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে এসেছে। বহু শরণার্থী আহত। আমাদের জনগণ নিজেদের দুঃখ-কষ্টের ওপর স্থান দিয়েছেন শরণার্থীদের দুঃখ-কষ্ট। যে সাহস ও সৌর্যের সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণ তাদের দুঃখ-দুর্দশা বরণ করেছেন এবং ভবিষ্যতের জন্য তারা যে দৃঢ় মনোবল ও আশা রাখেন তা দেখে আমি মুগ্ধ। শ্রীমতী গান্ধী বলেন, বাংলাদেশের ঘটনাবলী সম্পর্কে ভারতের হাত রয়েছে এ কথা দুরভিসন্ধিমূলক, বাংলাদেশের জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা ও তাদের স্বতঃস্ফূর্ত ত্যাগ স্বীকারের প্রতি অবমাননাকর। নিজেদের দুষ্কর্মের জন্য ভারতকে দায়ী করার একটি সুপরিকল্পিত অবস্থান নিয়েছেন পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী। বিশ্ববাসীকে প্রতারণা করার পাকিস্তানী এ প্রচেষ্টা বিশ্ব প্রেস ধরে ফেলেছেন। তিনি বলেন, আমরা কোনদিন পাকিস্তানের ঘরোয়া ব্যাপারে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করিনি। আজও আমরা কোন ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে চাই না। কিন্তু পাকিস্তান যাকে ঘরোয়া বিষয় বলে দাবি করছে, ভারতের পক্ষেও সেটি একটি ঘরোয়া ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং ঘরোয়া ব্যাপারের নামে পাকিস্তান যেসব তৎপরতা চারাচ্ছে তা থেকে বিরত থাকতে বলার অধিকার আমাদের আছে। আমাদের লাখ লাখ নাগরিকের কল্যাণ ও শান্তি বিঘ্নিত হচ্ছে। ভারতীয় ভূমিতে পঞ্চাশ ষাট লাখ পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিককে তাদের বাস্তুভিটা থেকে বিতাড়িত করার অধিকার কি পাকিস্তানের আছে? এসব হতভাগ্য ব্যক্তিদের আমরা আশ্রয় ও সাহায্য দিতে বাধ্য হয়েছি বলে তার সুযোগ নিয়ে আরও শরণার্থী পাঠাবার সুবিধা পাকিস্তানকে দেয়া যায় না। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×