ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নুসরাত হত্যার দায় স্বীকার করে ১২ আসামির জবানবন্দী

প্রকাশিত: ০৯:৫০, ১১ মে ২০১৯

নুসরাত হত্যার দায় স্বীকার করে ১২ আসামির জবানবন্দী

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ ফেনীর সোনাগাজী মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার এক মাস পেরিয়ে গেছে। হত্যাকা-ের গাফিলতির প্রমাণ পাওয়ায় সোনাগাজী মডেল থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডে এখন পর্যন্ত ১২ আসামি আদালতে দায় স্বীকার করে জবানবন্দী দিয়েছে। এদের মধ্যে সরাসরি হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়া দুই তরুণীসহ পাঁচজন রয়েছে। এছাড়া আদালত এই হত্যাকা-ে ৭ জনের সাক্ষ্য নিয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শুক্রবার নুসরাত হত্যার মাস পূর্তি দিনে সোনাগাজী মডেল থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে এই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হলো। পুলিশ সদর দফতর জানায়, নুসরাতকে যৌন হয়রানির অভিযোগ আমলে না নেয়া, পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে বৃহস্পতিবার ওসি মোয়াজ্জেমকে সাময়িক বরখাস্ত করে রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি অফিসে সংযুক্ত করা হয়েছে। পুলিশ সদর দফতরের (মিডিয়া) পুলিশের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) সোহেল রানা জানান, সদর দফতরের গঠিত তদন্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। মোয়াজ্জেম হোসেন আপাতত বেতন-ভাতা ও পদ অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধা পাবে না। শুধু নিয়ম অনুযায়ী খোরাকি ভাতা পাবে। নুসরাত হত্যার ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে তদন্ত শেষে পুলিশ সদর দফতরের তদন্ত দল ওসি মোয়াজ্জেমসহ চারজনের গাফিলতির প্রমাণ পাওয়ার কথা জানিয়ে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছিল। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে ৮ এপ্রিল নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন। মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাকে প্রধান আসামি করে ৮ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞানামা আরও ৪-৫ জনকে আসামি করা হয়। কিন্তু অনেকেই এ ঘটনায় সোনাগাজীর পুলিশের বিরুদ্ধে গাফিলতি এবং আসামি ধরতে গড়িমসির অভিযোগ করেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ঘটনার দিন নুসরাতের গায়ে আগুন দেয়ার সময় পরীক্ষা কেন্দ্রে পুলিশ ছিল। তারপরও এ রকম ঘটনা কীভাবে ঘটল, দোষীরা কীভাবে পালিয়ে গেল- ঘটনার তিনদিন পরও আসামি গ্রেফতারে পুলিশের রহস্যজনক ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এই পরিস্থিতিতে ১০ এপ্রিল ওসি মোয়াজ্জেমকে সোনাগাজী থানার দায়িত্ব সরিয়ে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নে বদলি করা হয়। মামলার তদন্তভার দেয়া হয় পিবিআইর হাতে। সেই রাতেই ঢাকা মেডিক্যালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান নুসরাত। তার ভাইয়ের দায়ের করা হত্যাচেষ্টা মামলাটি রূপান্তরিত হয় হত্যা মামলায়। তখন অভিযোগ ওঠে, ঘটনা ভিন্নখাতে নেয়ার জন্য সোনাগাজী থানার ওসি মোয়াজ্জেম নুসরাতের মৃত্যুর বিষয়টি ‘আত্মহত্যা’ বলার চেষ্টা করেছে। নুসরাতের গায়ে আগুন দেয়ার ওই ঘটনায় সারাদেশ ক্ষোভে-বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে। স্থানীয় পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর ঘটনার তদন্তে যথাযথ গুরুত্ব দেননি বলেও অভিযোগ ওঠে। এই প্রেক্ষাপটে অবহেলার পাশাপাশি সার্বিক বিষয় খতিয়ে দেখতে ১৩ এপ্রিল পুলিশ সদর দফতরের ডিআইজি এসএম রুহুল আমিনের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে দেয়া হয়। তদন্ত দলের সদস্যরা ১৭ এপ্রিল থেকে ২০ এপ্রিল এবং ২২ ও ২৩ এপ্রিল দুই দফা ফেনীতে গিয়ে তদন্ত করে। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সাত চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র, দুই শিক্ষার্থী এবং ৪-৫ সাংবাদিকদেরও বক্তব্য শোনেন তারা। এদিকে নুসরাতের মৃত্যুর পরদিন ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, থানায় ওসির সামনে অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ তুলে ধরতে গিয়ে অঝোরে কাঁদছেন তরুণী নুসরাত। নিজের মুখ তিনি দুই হাতে ঢেকে রেখেছিলেন। সে সময় ওসি মোয়াজ্জেম ‘মুখ থেকে হাত সরাও, কান্না থামাও’ বলার পাশাপাশি এও বলেন, ‘এমন কিছু হয়নি যে এখনও তোমাকে কাঁদতে হবে। ওই ভিডিও ধারণ এবং তা ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়ায় ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা দায়ের করেন সৈয়দ সায়েদুল হক নামে এক আইনজীবী। ওই মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পুলিশকে ২৭ মে পর্যন্ত সময় দেয় সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল। পুলিশ সদর দফতরে তদন্ত প্রতিবেদনে ফেনীর এসপি জাহাঙ্গীর আলম সরকার, সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন, এসআই ইকবাল ও এসআই ইউসুফের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ এনে শাস্তির সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এনামুল কবিরের বিরুদ্ধেও দায়িত্বে অবহেলা ও গাফিলতির সুস্পষ্ট প্রমাণ মিলেছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে এআইজি সোহেল রানা জানান, সাব-ইন্সপেক্টর বা তার নিচের পদের কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে জেলা পর্যায়ে। আর এএসপি বা তার ওপরের পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত হবে। এর অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এই মাসে চার্জশীট ॥ সোনাগাজীতে মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত হত্যার এক মাস ছিল শুক্রবার। নুসরাত হত্যার তদন্তকারী সংস্থা পিবিআই জানায়, নুসরাত হত্যাকাণ্ডে জড়িত ২১ জনকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। এই মামলায় এখন পর্যন্ত ১২ জন দায় স্বীকার আদালতে জবানবন্দী দিয়েছে। এদের মধ্যে সরাসরি হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়া দুই তরুণীসহ পাঁচজন রয়েছে। তারা সিনিয়র জুড়িশিয়াল ম্যজিস্ট্রেট শরাফ উদ্দিন আহামেদ ও মোঃ জাকির হোসাইনের আদালতে স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দী দেয়। তা রেকর্ড করা হয়। জবানবন্দী দেয়া আসামিরা হচ্ছে, সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা, তার সহযোগী নুর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, উম্মে সুলতানা পপি, কামরুন নাহার মনি, জাবেদ হোসেন, আবদুর রহিম ওরফে শরীফ, হাফেজ আবদুল কাদের, জোবায়ের আহমেদ, এমরান হোসেন মামুন, ইফতেখার হোসেন রানা ও মহিউদ্দিন শাকিল। এরা প্রত্যকেই নুসরাত হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। অপর তিন আসামি সোনাগাজী পৌরসভার ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাকসুদুর রহমান, মাদ্রাসার ইংরেজির প্রভাষক আফসার উদ্দিন ও মোহাম্মদ শামীম ওরফে শামীম এখনও রিমান্ডে রয়েছে। এদের তিন জনের জিজ্ঞাসাবাদের পর জবানবন্দী নেয়ার কাজ শেষ হলে অভিযোগপত্র তৈরির কাজে হাত দেয়া হবে। এ মাসেই অভিযোগপত্র জমা দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মামলার তদন্ত সংস্থা পিবিআই’র চট্টগ্রাম বিভাগের স্পেশাল পুলিশ সুপার মোঃ ইকবাল ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে জানান, চাঞ্চল্যকর নুসরাত হত্যা মামলায় চলতি মাসেই অভিযোগপত্র দাখিল হওয়ার সম্ভাবনার রয়েছে। নুসরাতের গায়ে আগুন লাগাতে বোরকা পরে আসে দুর্বৃত্তরা। তারা তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেয়। সেই কেরোসিন ভরা গ্লাসটি উদ্ধার করা হয়েছে। ইতোমধ্যে কেরোসিন ও বোরকা বিক্রেতা ও বোরকা দোকানের কর্মচারী, নুসরাতের দুই বান্ধবী তথা আলিম পরীক্ষার্থী, মাদ্রাসার একজন নৈশপ্রহরী ও একজন পিয়নসহ মোট সাতজনের সাক্ষ্য নিয়েছেন আদালত। এই সাতজনই মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হিসেবে বিবেচিত। পুলিশ সুপার মোঃ ইকবাল জানান, নুসরাতের ওপর অগ্নিসন্ত্রাসের দিন অন্যতম প্রধান তিন আসামি শাহাদাত হোসেন ওরফে শামীম, জুবায়ের আহমেদ ও জাবেদ হোসেন বোরকা পরিহিত ছিলেন। পিবিআই আলামত হিসেবে দুটি বোরকা উদ্ধার করেছে। জুবায়েরের ব্যবহৃত বোরকা গত ২০ এপ্রিল সোনাগাজী কলেজ-সংলগ্ন একটি খাল থেকে এবং শামীমের ব্যবহৃত বোরকা গত ৪ মে মাদ্রাসার পুকুর থেকে উদ্ধার করা হয়। কিন্তু জাবেদ হোসেনের ব্যবহৃত বোরকা উদ্ধার করা যায়নি। বোরকাগুলো কিনেছিলেন আরেক ছাত্রী কামরুন নাহার ওরফে মণি। মণিও গ্রেফতার হয়ে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিয়েছেন। নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার পর পর খুনীরা বিষয়টি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিন এবং পৌর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাকসুদ আলমকে জানায়। নুসরাত হত্যাকাণ্ডের আগে অধ্যক্ষ ‘সিরাজ উদ দৌলা মুক্তি পরিষদ’ নামের ২০ সদস্যের কমিটির জন্য টাকা দিয়েছিলেন একটি বেসরকারী ব্যাংকের কর্মকর্তা জনৈক কেফায়েত উল্লাহ। এই কমিটির আহ্বায়ক ছিল নুর উদ্দিন এবং যুগ্ম-আহ্বায়ক ছিল শাহাদাত হোসেন শামীম। নুর উদ্দিন সোনাগাজী মাদ্রাসা শাখা ছাত্রদলের সভাপতি এবং শাহাদাত হোসেন একই মাদ্রাসার ছাত্রলীগের সভাপতি ছিল। উল্লেখ্য, গত ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন নিপীড়নের দায়ে ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাকে আটক করে পুলিশ। পরে ৬ এপ্রিল ওই মাদ্রাসা কেন্দ্রের সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে নিয়ে অধ্যক্ষের সহযোগীরা তার শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়। ১০ এপ্রিল রাতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মারা যান নুসরাত জাহান রাফি।
×