ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ২ লাখ পল্লী ডাক্তার পেশা ছেড়েছেন

প্রকাশিত: ০৯:৪৭, ১১ মে ২০১৯

 পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ২ লাখ পল্লী ডাক্তার পেশা ছেড়েছেন

নিখিল মানখিন ॥ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে অনেক পল্লী চিকিৎসক পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। গত কয়েক বছরে দশ লাখ পল্লী চিকিৎসকের মধ্যে দু’লাখের বেশি চিকিৎসক অন্য পেশায় চলে গেছেন বলে জানিয়েছে পল্লী চিকিৎসক সমিতি। পল্লী চিকিৎসকদের নিয়ন্ত্রণে সরকারী কোন মনিটরিং নেই। তাদের উন্নয়নে সরকারী পরিকল্পনাও নেই। অথচ দেশের প্রাথমিক জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন এই পল্লী চিকিৎসকরাই। এমনটি মনে করেন দেশের চিকিৎসক নেতৃবৃন্দ। তারা বলছেন, দেশের হাজার হাজার পল্লী চিকিৎকদের জন্য কার্যকর সরকারী দিকনির্দেশনা নেই। দেশে চিকিৎসকের সঙ্কট রয়েছে। এ অবস্থায় প্রাথমিক চিকিৎসা সেবাদানে কমিউনিটি হেলথ প্রোভাইডারদের পাশাপাশি পল্লী চিকিৎসকদের কাজে লাগানো যেতে পারে। সরকারী সহযোগিতা ও নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হলে পল্লী চিকিৎসকরা ভুল ও অবৈধ চিকিৎসাসেবায় সম্পৃক্ত হতে পারবেন না। চিকিৎসক নেতৃবৃন্দ বলেন, জনসংখ্যার শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষ গ্রামে বসবাস করেন। এমবিবিএস পাস ডাক্তার গ্রামে নেই বললেই চলে, ফলে গ্রামের বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার জন্যে পল্লী চিকিৎসকদের শরণাপন্ন হতে হয়। পল্লী চিকিৎসক বা গ্রাম ডাক্তাররা গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবায় তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। দেশের প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ দোরগোড়ায় অত্যাবশ্যকীয় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পল্লী চিকিৎসকদের মাধ্যমে পেয়ে থাকেন। গ্রামের গরিব ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতা বাড়াতে পল্লী চিকিৎসকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন পরামর্শ দেয়ার মাধ্যমেও পল্লী চিকিৎসকরা স্বাস্থ্যসেবায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা, শিশু ও মায়ের স্বাস্থ্যসেবা, টিকাদান, পরিবার পরিকল্পনা, সংক্রমক রোগ প্রতিরোধ, যক্ষ্মা শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা, অপুষ্টিজনিত রোগের চিকিৎসা, যৌন রোগের চিকিৎসা, এইচআইভি/ এইডস শনাক্তকরণসহ সকল প্রকার সাধারণ রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে পল্লী চিকিৎসকরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। আমাদের দেশে এমবিবিএস পাস ডাক্তারের যথেষ্ট অভাব রয়েছে, সেক্ষেত্রে বিশেষ করে গ্রাম পর্যায়ের চিকিৎসা ব্যবস্থায় পল্লী চিকিৎসকদের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অনস্বীকার্য। দ্রুততম সময়ের মধ্যে তৃণমূল জনগণের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছাতে পল্লী চিকিৎসকরা ভূমিকা রাখেন। পল্লী চিকিৎসকদের ন্যূনতম এসএসসি পাস ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে চিকিৎসা কার্যক্রম চালানো উচিত। এতে পল্লী চিকিৎসকদের মর্যাদা বাড়বে এবং মানুষের সু-চিকিৎসা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। উল্লেখ্য, বর্তমানে অনেক উচ্চ শিক্ষিতও পল্লী চিকিৎসায় নিয়োজিত রয়েছেন, তাদেরকেও প্রয়োজনীয় এবং যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে পেশাগত দক্ষতা অর্জন করা আবশ্যক। চিকিৎসা পেশা অন্যান্য পেশার তুলনায় স্পর্শকাতর এবং শারীরিক ও মানসিক কষ্ট বা অসুস্থতা তথা জীবন মৃত্যুর সমস্যার সঙ্গে জড়িত হওয়ায় ন্যূনতম শিক্ষা ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ছাড়া এই পেশায় নিয়োজিত হওয়া উচিত নয়। এ বিষয়ে সরকার আগ্রহী ও উপযুক্ত ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে পল্লী চিকিৎসক তৈরির মাধ্যমে গ্রামীণ মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পারেন। সূত্র জানায়, জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির খসড়া জাতীয় সংসদে অনুমোদিত হয়েছে। পাশাপাশি এ পর্যন্ত ১১ হাজার ২৬২ ক্লিনিক চালু করা হয়েছে। সাড়ে ১৩ হাজার সিএইচসিপি নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন। তবে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রাথমিক স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সেবা প্রদানের লক্ষে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক পুরোপুরি চালু করা প্রয়োজন। কারণ গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পল্লী চিকিৎসক ও কমিউনিটি ক্লিনিকের ভূমিকা ব্যাপক। স্বাস্থ্য সংক্রান্ত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর মনিটরিং জোরদার করার দাবি জানিয়েছেন ডক্টরস ফর হেলথ এ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের সভাপতি বিএমএর সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডাঃ রশিদী-ই-মাহবুব। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, স্বাস্থ্য সেক্টরে দুর্বল মনিটরিংয়ের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দায়ী। কেউ কারও দায়িত্ব ঠিক মতো পালন করে না। দেশে ভুয়া ডিগ্রীর অভাব নেই, টাকা দিলেই পাওয়া যাচ্ছে ভুয়া সনদ। এতে অদক্ষ চিকিৎসক সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। যথাযথ মনিটরিং ও সহযোগিতা দেয়ার মাধ্যমে দেশের প্রাথমিক স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবায় পল্লী চিকিৎসকদের কাজে লাগানো যেতে পারে। বাংলাদেশ পল্লী চিকিৎসক সমিতির সভাপতি ডাঃ সবুজ আলী বলেন, বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের ’১০ সালের ৬১নং আইনের ১৫(১), ২২ (১) ও ২৯ (১) ধারা উপধারা সহ বিভিন্ন জনবিরোধী পাশকৃত আইনটি সংশোধন, সংযোজন ও বিয়োজন করা দরকার। পল্লীবাসীর চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য পরিচর্যা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে সিভিল সার্জনের অধীন আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক বছর মেয়াদী পল্লী চিকিৎসক প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করে। কিন্তু এক শ্রেণীর ষড়যন্ত্র-চক্রান্তকারীদের কারণে পল্লী চিকিৎকদের নামের আগে ডাক্তার পদবী ব্যবহার ও নিবন্ধন ছাড়া চিকিৎসা করতে পারবে না এই মর্মে আইন পাশ হয়। এতে হাজার হাজার ডিপ্লোমাধারী পল্লী চিকিৎসক চিকিৎসা সেবা প্রদান থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, পল্লী চিকিৎসকরা নানাভাবে অবহেলার শিকার হচ্ছেন। গ্রামাঞ্চলে তাদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা চালু রয়েছে। ময়মনসিংহের ধোবাউড়া থানায় ছোট্ট চেম্বারে ওষুধ সাজিয়ে বসে আছেন পল্লী চিকিৎসক হোসেন আলী। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, পুরো ধোবাউড়া থানায় প্রায় ২শ’ জন পল্লী চিকিৎসক ছিলেন। কয়েক বছর আগের ঘটনা। পল্লী চিকিৎসকদের সরকারী ও বেসরকারীভাবে মূল্যায়ন কর হয় না। অবহেলার শিকার হয়ে অনেক পল্লী চিকিৎসক নিজ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন। অথচ এখন পর্যন্ত অনেক দরিদ্র রোগী পল্লী চিকিৎসকদের শরণাপন্ন হন। অভিজ্ঞতার বাইরের রোগীকে চিকিৎসাসেবা দিই না আমরা।
×