ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জাপায় ফের গৃহদাহ ॥ রওশনপন্থীরা কোণঠাসা

প্রকাশিত: ০৯:৪৬, ১১ মে ২০১৯

 জাপায় ফের গৃহদাহ ॥ রওশনপন্থীরা কোণঠাসা

রাজন ভট্টাচার্য ॥ সম্মেলনের ঠিক আগ মুহূর্তে হঠাৎ আটজন প্রেসিডিয়াম সদস্য করায় বিরোধী দল জাতীয় পার্টিতে নতুন করে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। এ ঘটনায় একজন এমপিসহ আরও দুই শীর্ষ নেতা দলের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেছেন। আরও বেশ বেশকজন পদত্যাগ করতে পারেন বলে জানা গেছে। দলের একাধিক পর্যায়ের শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জিএম কাদেরকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয়ার পর থেকেই রওশনপন্থীরা একেবারেই কোণঠাসা অবস্থায় আছেন। এ নিয়ে দলে নতুন করে গৃহদাহ শুরু। রওশনপন্থী নেতাদের বক্তব্য- পরিকল্পিতভাবে একটি পক্ষ দলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে নতুন করে পদায়ন শুরু করেছে। জিএম কাদের বলছেন, যোগ্য ব্যক্তিদের প্রাপ্য সম্মান দেয়া হচ্ছে। যারা মাটি মানুষের জন্য রাজনীতি করেন তারাই মূল্যায়ন পাবেন। আর উড়ে এসে জুড়ে বসা নেতৃত্ব বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না বলেও মত দেন তিনি। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় হঠাৎ করেই জাপায় আটজন প্রেসিডিয়াম সদস্য করার খবর আসে। দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ স্বাক্ষরিত বার্তায় নতুন প্রেসিডিয়ামের তালিকায় সাবেক প্রতিমন্ত্রী, দুইজন এমপি, একজন সাবেক ছাত্রনেতা ও ব্যবসায়ীও রয়েছেন। গণমাধ্যমে পাঠানো এরশাদ স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, পার্টির গঠনতন্ত্রে ২০/১/ক ধারা মোতাবেক এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে, যা অবিলম্বে কার্যকর হবে। জাপার নতুন শীর্ষ নেতাদের মধ্যে রয়েছেন- কাজী মামুনুর রশিদ (ব্যবসায়ী), সৈয়দ দিদার বখত (সাবেক মন্ত্রী), জাফর ইকবাল সিদ্দিকী (সাবেক এমপি), নাজমা আকতার এমপি, আব্দুস সাত্তার মিয়া, আলমগীর সিকদার লোটন (সাবেক ছাত্রনেতা), এমরান হোসেন মিয়া এবং মেজর অব. রানা মোহাম্মদ সোহেল এমপি। জানা গেছে, মূলত জাতীয় যুব সংহতির সভাপতি আলমগীর সিকদার লোটনকে প্রেসিডিয়াম সদস্য করায় ক্ষুব্ধ হন লিয়াকত হোসেন খোকা। সম্প্রতি খোকাকে প্রেসিডিয়ামের পদ থেকে বাদ দেয়া হয়। খোকা ও লোটনের বাড়ি নারায়ণগঞ্জে। দু’জনেই একই আসনে জাপার প্রার্থী হয়েছিলেন। বৃহস্পতিবার নতুন প্রেসিডিয়ামের তালিকা দেখে জাপার সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ও জাতীয় স্বেচ্ছাসেবক পার্টির সভাপতি লিয়াকত হোসেন খোকা গণমাধ্যমে পাঠানো বার্তায় বলেন, শীর্ষ নেতৃত্বের অযোগ্যতার প্রতিবাদে তিনি সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিবের পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনের এই সাংসদ বলেন, আমি জাপার একজন সাধারণ কর্মী। জাতীয় পার্টির জন্মলগ্ন থেকে আছি। বর্তমান দলের নেতৃত্বের ওপর আমার কোন আস্থা নেই। এরশাদের অসুস্থ অবস্থায় একটি মহল পার্টির ভেতর যেভাবে প্রমোশন দিচ্ছে তা মেনে নেয়া যায় না। তবে শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত খোকার পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়নি। জানা গেছে, জাপায় রওশনপন্থী হিসেবে পরিচিত লিয়াকত হোসেন খোকা। তিনি এমপি হওয়ার পর পার্টির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পেয়েছেন রওশনের সহযোগিতায়। একই কায়দায় মনোনয়ন নিয়ে এমপিও হয়েছেন দু’দফা। দলে একটি পক্ষ মনে করে লিয়াকত শীর্ষ নেতৃত্বের যোগ্য নন। তাই তাকে বাদ দিয়ে একজন যোগ্য ব্যক্তিকে প্রেসিডিয়ামের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। জাতীয় পার্টির আগে প্রতিষ্ঠিত হয় যুব ও ছাত্র সংগঠন। সেই নতুন বাংলা ছাত্র সমাজের নারায়ণগঞ্জ জেলার সভাপতি ছিলেন লিয়াকত হোসেন খোকা। পরে জাতীয় ছাত্র সমাজের কেন্দ্রীয় কমিটি ও যুব সংহতির শীর্ষপদে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। তার এই পদত্যাগের বিষয়টি টক অব দ্য পার্টিতে পরিণত হয়েছে। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় পার্টির (জাপা) ৪১ সদস্যের প্রেসিডিয়ামের সভায় আগে থেকেই রয়েছে ৪৬ জন। বৃহস্পতিবার নতুন করে আরও আটজনকে পদোন্নতি দেয়ায় তা ৫৪তে গিয়ে ঠেকল। জানতে চাইলে লিয়াকত হোসেন খোকা বলেন, ত্যাগী নেতাকর্মীদের যথাযথ মূল্যায়ন করা উচিত। আরও স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রমোশন দেয়া উচিত ছিল। স্যারের (হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ) এই অসুস্থতার সুযোগে একটি চক্র দলটাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। প্রমোশনের সঙ্গে পদত্যাগ সম্পর্কিত কি-না, জানতে চাইলে জবাবে সরাসরি হ্যাঁ বা না, কোনটাই বলেননি তিনি। বলেছেন, পার্টিতে যা হচ্ছে তাতে অনেকের মতো আমিও হতাশ। এতে নেতাকর্মীদের মধ্যে একটা প্রভাব পড়বে। ভোটের আগে থেকেই, যেভাবে দলটাকে এগিয়ে নেয়া উচিত ছিল, সেভাবে হয়নি। অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মহাজোট থেকে আমাদের ৪০-৪৫টি আসন পাওয়ার কথা। কিন্তু কেন পেলাম না? একই ঘটনায় দলের যুব বিষয়ক যুগ্ম সম্পাদক আবু সাঈদ স্বপন সন্ধ্যার পর পদত্যাগ করেন। অসম প্রমোশনের কারণে এই পদত্যাগ বলে জানান তিনি। বলেন, দেখেন কাদের প্রমোশন দেয়া হয়েছে! আরতো মেনে নেয়া যায় না। আরও অনেকে পদত্যাগের লাইনে আছে। এছাড়া যুব বিষয়ক সম্পাদক বেলাল হোসেনও পদত্যাগ করেছেন। রওশনপন্থীরা বলেছেন, জাতীয় পার্টির ভেতরে গণতন্ত্র বলতে কিছুই নেই, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের কথাই শেষ কথা। তিনি যখন যাকে খুশি শোকজ-বহিষ্কার করেন, যখন যাকে খুশি প্রমোশন দেন। গঠনতন্ত্রে সেই পদ থাকুক আর নাই থাকুক, তাতেও কিছুই যায় আসে না। একই ব্যক্তিকে এক মাসের ব্যবধানে দু’বার প্রমোশন দিয়েছেন এরশাদ। পার্টিতে যোগদানের আগেই সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পরিষদ প্রেসিডিয়ামের সদস্য করা হয়েছে, এমন হাস্যকর নজিরও রয়েছে জাপায়। অবশ্য পার্টির গঠনতন্ত্রে এরশাদকে অনেকটাই স্বেচ্ছাচারী ও নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। ২০ এর উপধারা (১) বলা হয়েছে, ‘গঠনতন্ত্রের অন্যধারায় যাহাই উল্লেখ থাকুক না কেন-জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত থাকবেন। এ ক্ষমতাবলে তিনি প্রয়োজন বোধে প্রতিটি স্তরের কমিটি গঠন, পুনর্গঠন, বাতিল, বিলোপ করতে পারবেন। তিনি যেকোন পদ সৃষ্টি বা অবলুপ্ত করতে পারবেন। চেয়ারম্যান জাতীয় পার্টির যেকোন পদে যেকোন ব্যক্তিকে নিয়োগ, যেকোন পদ থেকে যেকোন ব্যক্তিকে অপসারণ ও যেকোন ব্যক্তিকে তার স্থলাভিষিক্ত করতে পারবেন। দলের নেতারা বলছেন, যারা যখন এরশাদের কাছাকাছি থাকেন তখন গঠনতন্ত্রে দেয়া দলের চেয়ারম্যানের একক ক্ষমতাবলে তাদের মতাদর্শের লোকদের প্রমোশন বা বহিষ্কার এমনকি গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান করা হয় ২০১৬ সালে জানুয়ারি মাসে। তখন গঠণতন্ত্রে এই পদ ছিল না। রংপুরের এক জনসভায় ছোট ভাই জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান ঘোষণা দেন এরশাদ। এর অল্পদিনের মাথায় রওশনপন্থীদের চাপে রওশনকে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান করা হয়। সেই পদও কিন্তু গণতন্ত্র মোতাবেক ছিল না। পরে কাউন্সিলে (১৪ মে, ২০১৬) গঠনতন্ত্রের সংশোধনী এনে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ও কো-চেয়ারম্যান পদ সংযোজন করা হয়। তবে নিরপেক্ষ নেতারা বলছেন, জাপায় কখন কার প্রমোশন হয়, আর কখন কাকে বহিষ্কার করা হয় তারও কোন ঠিক ঠিকানা নেই। স্ত্রী রওশন এরশাদ ও ছোট ভাই জিএম কাদেরও এই শোকজের হাত থেকে রক্ষা পাননি। কাউন্সিলের বাইরে গিয়ে কয়েক বছরে তিন দফায় শুধু মহাসচিব পদেই রদবদল করেছেন। এরশাদের স্বেচ্ছাচারী এই মনোভাবের কারণে এখন বহুভাগে বিভক্ত জাপা। এরশাদের নেতৃত্বে ূলধারা জাপাসহ জাতীয় পার্টি জেপি, বিজেপি ও জাতীয় পার্টি (জাফর) নামে চারটি ধারা সক্রিয়। দু’টি ধারা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটে, দু’টি ধারা বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটভুক্ত রয়েছে। আবার অনেকে লাঙ্গল ছেড়ে ধানের শীষ ও নৌকার হাল ধরেছেন। জাপার বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা জানিয়েছেন, কমিটির মেয়াদ শেষ। চলতি বছরের মধ্যে নতুন কাউন্সিল হওয়ার কথা রয়েছে। এজন্য ভেতরে ভেতরে দলের প্রস্তুতিও চলছে বলে জানা গেছে।
×