ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

পটুয়াখালী পৌর শহরের ৯৫ ভাগ বহুতল ভবনই অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ

প্রকাশিত: ০৮:৪৩, ১১ মে ২০১৯

  পটুয়াখালী পৌর শহরের ৯৫ ভাগ  বহুতল ভবনই অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ

স্টাফ রিপোর্টার, গলাচিপা/ নিজস্ব সংবাদদাতা, পটুয়াখালী ॥ পটুয়াখালী জেলা শহরের শতকরা ৯৫ ভাগ ভবনই অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। এ সমস্ত ভবন নির্মাণে বিল্ডিং এবং ফায়ার কোডের কোনটাই মানা হয়নি। এরমধ্যে যেমন সরকারী ভবন রয়েছে। তেমনি রয়েছে বেসরকারী ভবন। তারওপরে জেলা সদরে রয়েছে পানির সঙ্কট। একের পর এক সরকারী-বেসরকারী প্রাকৃতিক জলাধার হয় ভরাট হয়ে গেছে। না হয় ভরাটের পর্যায়ে রয়েছে। এমনকি টিউবওয়েলগুলোতেও পানি উঠছে না। ফায়ার সার্ভিস অধিদফতরেও লোকবলসহ রয়েছে নানাবিধ সমস্যা। অপ্রশস্ত সড়ক এবং ঘিঞ্জি এলাকার কারণেও শহরে অগ্নিঝুঁকি প্রবল আকার নিয়েছে। এ অবস্থার মধ্যেই শহরে বহুতল ভবন নির্মাণে রীতিমতো হিড়িক পড়ে গেছে। খোদ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মাঠ পর্যায়ের জরিপে পটুয়াখালী জেলা শহরের এ বেহাল দশার চিত্র উঠে এসেছে। জেলার উপজেলাগুলোর চিত্রও প্রায় একই রকমের। কোথাও নেই অগ্নি নিরাপত্তার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং সরেজমিন অনুসন্ধানসহ বিভিন্ন সূত্রে মারাত্মক অগ্নিঝুঁকির এসব তথ্য পাওয়া গেছে। কর্তৃপক্ষ সূত্র জানায়, পটুয়াখালী জেলা সদরের পৌরসভা এলাকায় বর্তমান হোল্ডিং সংখ্যা ১২ হাজার ৬৩৯। খানা ১৬ হাজারের কিছু বেশি। আয়তন চার বর্গ কিলোমিটারের কাছাকাছি। পৌর শহরে বসবাসকারী লোকসংখ্যা লক্ষাধিক। বিপুল সংখ্যক হোল্ডিংয়ের বেশিরভাগ নির্মিত হয়েছে গত দেড় থেকে দুই দশকের মধ্যে। অতিসম্প্রতি ঢাকার চকবাজার ও এফআর টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নি দুর্ঘটনার পরে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনার প্রেক্ষিতে স্থানীয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে বসে। গত ৪ এপ্রিল থেকে ফায়ার সার্ভিসের একাধিক গ্রুপ প্রতিটি সরকারী-বেসরকারী ভবন সরেজমিন পরিদর্শনে নামে। ফায়ার সার্ভিস অধিদফতরের মহাপরিচালকের দফতর থেকে পাঠানো ১৫ দফা নির্দেশনা অনুযায়ী এ পরিদর্শন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সরেজমিন পরিদর্শন কার্যক্রম শেষ না হলেও এরই মধ্যে জেলা শহরে অগ্নিঝুঁকির ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। কর্তৃপক্ষ স্বীকার করে নিয়েছেন শহরের ৯৫ ভাগ স্থাপনাই অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। এরমধ্যে যেমন সরকারী স্থাপনা রয়েছে। তেমনি রয়েছে বেসরকারী স্থাপনা। এসমস্ত ভবন নির্মাণে বিল্ডিং ও ফায়ার কোড মানার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তার ধারে কাছে কেউ যায় নি। প্রতিটি ভবন নির্মাণে ‘অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন ২০০৩’ আইন মানার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা প্রায় সকলেই উপেক্ষা করেছে। ফায়ার সার্ভিসের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জানান, সরেজমিন পরিদর্শনে বহুতল ভবন, বাণিজ্যিক মার্কেট, হাসপাতাল এবং ক্লিনিকে অগ্নিপ্রতিরোধ, অগ্নিনির্বাপণ ও জননিরাপত্তামূলক দিক থেকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ও ‘খুব ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে দু ধরনের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। পরিদর্শন কালে ভবনের লে-আউট প্লান, ফায়ার সার্ভিস অধিদফরের অনুমোদিত ফায়ার সেফটি প্লান ও অনাপত্তি ছাড়পত্র, অকুপেন্সি সার্টিফিকেট এবং ফায়ার ইভিলুয়েসন ড্রিল (মহড়া) প্রশিক্ষণ রেজিস্টার পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হচ্ছে। এছাড়া প্রয়োজনীয় অগ্নি নির্বাপণ সরঞ্জামাদি ও প্রস্ততি আছে কিনা সে বিষয়গুলোর প্রতিও গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। প্রতিদিনই শহরের কোন না কোন এলাকায় চলছে অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ভবন পরিদর্শন। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পটুয়াখালীর সিনিয়র স্টেশন অফিসার মোঃ ফিরোজ আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে শহরের ৯৫ ভাগ ভবনেই অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই। বিল্ডিং কোড না মেনে ভবন নির্মাণসহ অগ্নিদুর্ঘটনা প্রতিরোধে নিয়ম মানছেন না ভবন মালিকরা। এ কারণে দিন দিন এসব ভবনে বাড়ছে অগ্নিঝুঁকি। যেসব ভবনে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা পাওয়া যাবে না, তাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট দফতরে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সুপারিশ করা হবে। প্রয়োজনে ফায়ার সার্ভিসের নিজস্ব আইনে ভবন মালিকদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে পরিদর্শনে ফায়ার সার্ভিসের আগুনের ঝুঁকির তালিকায় যে সব বহুতল ভবন ও বেসরকারী-ক্লিনিক ও হাসপাতাল রয়েছে, তা হল-ড্রিম প্যালেস, এসপি কমপ্লেক্স, গ্রীন ভিউ (হাসপাতাল), হ্যাপি ম্যানর, রজনীগন্ধা, সিটি টাওয়ার (সেন্ট্রাল হাসপাতাল), মৃধা প্লাজা, হিলটন (আবাসিক হোটেল), মাহাবুব ভবন, শাহজাহান প্লাজা, গ্রীন প্ল্যালেসসহ বেশ কিছু বহুতল ভবন। আর অন্যান্য বহুতল বিভিন্ন বাণিজ্যিক ভবনগুলোতে রয়েছে বেসরকারী ব্যাংক, আবাসিক হোটেলসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এগুলোর বেশিরভাগেই অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ও ফায়ার এ্যালার্মসহ অগ্নিনির্বাপণের নেই সামান্যতম ব্যবস্থা। এসব ভবনে অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটলে মুহূর্তেই হতে পারে ভয়াবহ করুণ পরিণতি। পটুয়াখালী জেলা সদরের পৌর শহর এলাকায় বর্তমানে সাততলা থেকে এগারো তলা পর্যন্ত অর্ধ শতাধিক ভবন রয়েছে। এছাড়া ১০ তলা পর্যন্ত বেশ কয়েকটি ভবন বর্তমানে নির্মাণাধীন রয়েছে। যার বেশির ভাগেরই নেই আগুন নেভানোর ব্যবস্থা। এসব ভবনে ফ্লাটবাড়ি ছাড়াও হাসপাতাল, ক্লিনিক, এবং ডায়াগনোস্টিক সেন্টারের মতো স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কর্তৃপক্ষ সূত্রে বলা হয়েছে, প্রতিটি ১১ তলা ভবনে নিজস্ব জলাধার থাকতে হবে, যাতে ৭০ লাখ লিটার পানি থাকবে। অন্যান্য বহুতল ভবনেও আনুপাতিক হারে জলাধার রাখার নিয়ম রয়েছে। এছাড়া থাকবে নিজস্ব পাওয়ার স্টেশন। কিন্তু কোন ভবনেই তা নেই। উঁচু ভবনগুলোতে আপদকালীন সময়ে ফায়ার এক্সিটের জন্য যে ধরনের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন, তাও নেই। কোন কোন ভবনে সামান্য কিছু ব্যবস্থা থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত। ফায়ার এক্সিট সিঁড়ি দিয়ে একজনের নামতেই কষ্ট। অধিকাংশ বাড়িতে নেই ব্যালকনি। বহুতল ভবনগুলোর মাঝখানে নেই পর্যাপ্ত ফাঁকা জায়গা। যা সকলের জন্যই ঝুঁকি বয়ে আনছে। সাম্প্রতিক সময়ে পটুয়াখালী শহরে পানির সঙ্কটও প্রকট আকার নিয়েছে। অধিকাংশ সরকারী-বেসরকারী প্রাকৃতিক জলাধার ভরাট হয়ে গেছে। জেলা প্রশাসকের দফতর ও পুলিশ সুপার দফতরের পাশে বড় একটি সরকারী জলাধার বছর দেড়েক আগে মেডিক্যাল কলেজ স্থাপনের অজুহাতে ভরাট হয়ে গেছে। যে কারণে এ মুহূর্তে বড় ধরনের অগ্নিকা-ে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষের কাছে পানির সঙ্কট মাথাব্যথার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবচেয়ে কাছের পানির উৎস হচ্ছে লাউকাঠি নদী। যা শহরের অধিকাংশ এলাকা থেকে অনেক দূরত্বের। সেখান থেকে পানি সংগ্রহ করে অকুস্থলে পৌঁছানো ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষের কাছে যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ বিষয়। এছাড়া ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষের কাছে পানি সরবরাহের পর্যাপ্ত পাইপ নেই। নেই লেডার। ফলে কোন দ্বোতলা-তিনতলা ভবনে আগুন লাগলেও ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষকে বেশ ভোগান্তি পোহাতে হবে। পটুয়াখালী জেলা শহরের অধিকাংশ রাস্তা সরু। যা দিয়ে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি চলাচল অসম্ভব। তারওপরে রয়েছে বেশ কয়েকটি ঘিঞ্জি এলাকা। শহর গড়ে উঠেছে এবং উঠছে পুরোপুরি অপরিকল্পিত ভাবে। ফলে অগ্নিঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে। এ বিষয়ে পটুয়াখালী পৌরসভার শহর পরিকল্পনাবিদ ফারজানা আক্তার বলেন, যারা ভবন মালিক তারাই বেশির ভাগ নিয়ম লঙ্ঘন করছেন। তারা ভবন নির্মাণের সময় ফায়ার সার্ভিস বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। এমনকি আগুন নেভানোর ক্ষেত্রে কী রকম ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন, সে পরামর্শও গ্রহণ করা হয়নি। ফলে ঝুঁকির মাত্রা বাড়ছে। এছাড়া, পরিকল্পিত নগরায়ন গড়ার জন্য ২০০৮ সালে একটি খসড়া প্লান করা হয়। যা যথাসময়ে মন্ত্রণালয়ে পাঠান হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত তা অনুমোদন পায়নি। পটুয়াখালী ফায়ার সার্ভিস দফতরে প্রয়োজনীয় যানবাহনসহ অন্যান্য সরঞ্জামেরও সঙ্কট রয়েছে। রয়েছে লোকবলের সঙ্কট। পুরো জেলায় মাত্র ৪৮ জন অগ্নিনির্বাপণকর্মী রয়েছে। স্বল্পসংখ্যক এ জনবল দিয়ে অগ্নিঝুঁকি নিরোধ করা সম্ভব নয়। জেলার উপজেলা ও পৌরসভাগুলোতে অগ্নিঝুঁকি প্রকট ধারণ করেছে। পটুয়াখালী সদরসহ জেলায় ৮ উপজেলা ও ৫টি পৌরসভার মধ্যে মধ্যে রাঙ্গাবালী, দুমকী ও গলাচিপা উপজেলায় ফায়ার স্টেশন নেই। গলাচিপা পৌর এলাকায় প্রায় দু’বছর আগে ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন নির্মাণের কাজ শুরু হলেও এখন পর্যন্ত তা শেষ হয়নি। বর্তমানে তা অর্ধসমাপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে। সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে রাঙ্গাবালী উপজেলা রয়েছে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে। সেখানে নৌ ফায়ার সার্ভিসের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। যদিও পটুয়াখালী জেলা সদরে ২০১৪ সালে নৌ ফায়ার সার্ভিসের একটি দফতর করা হয়েছে। কিন্তু সেটিতে নেই প্রয়োজনীয় নৌযানসহ অন্যান্য সরঞ্জাম। প্রত্যন্ত গ্রাম কিংবা চরাঞ্চলে অগ্নি নির্বাপণে নৌ ফায়ার সার্ভিস স্টেশনটি এখন পর্যন্ত কোন ভূমিকা রাখতে পারেনি। পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটাতে অপরিকল্পিত ভাবে গত দেড়-দুই দশকে শত শত সরকারী-বেসরকারী ভবন গড়ে উঠেছে। যার প্রত্যেকটি রয়েছে অগ্নিঝুঁকিতে। সেখানে জরুরি ভিত্তিতে ফায়ার সার্ভিস স্টেশন স্থাপন প্রয়োজন হলেও কোন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। উপজেলাগুলোতেও প্রাকৃতিক জলাধার ভরাট হয়ে যাচ্ছে। যা ভবিষ্যতের জন্য ভয়াবহ অশনিসঙ্কেত হয়ে উঠেছে।
×