ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সাইফুজ্জামান

আমাদের সংস্কৃতি ও জাতীয় জাদুঘর

প্রকাশিত: ১০:৫৬, ১০ মে ২০১৯

 আমাদের সংস্কৃতি ও জাতীয় জাদুঘর

বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর সংস্কৃতি লালনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। জাদুঘর গড়ে ওঠা, বিকশিত হওয়া, সমাজ রূপান্তরের বহুমাত্রিক ধারা সমন্বয় করে তার এগিয়ে যাওয়া নিয়ে নতুন শতাব্দীতে ভাবনার সূচনা হয়েছে। জাদুঘরে ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্পকলা, ভাস্কর্য ও নৃতাত্ত্বিক বিবিধ নিদর্শন সংগৃহীত হয়। এ সকল বস্তু নিদর্শন আমাদের হাজার হাজার বছরের সংস্কৃতির মৌলিক উপাদান। বাংলাদেশে জাদুঘর চর্চা ও সংগৃহীত নিদর্শন নিয়ে অল্প বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। এর পেছনে কর্মীদের যেমন দায় রয়েছে তেমন গবেষকদের বিষয়বস্তু ও ইতিহাস সম্পর্কে সচেতনতার অভাব এর মুখ্য প্রতিপাদ্য। এখন জাদুঘর চর্চার অগ্রবর্তী ভূমিকায় যুক্ত হচ্ছেন জাদুঘর কর্মীরা। ক্রমে বেরিয়ে আসছে নতুন তথ্য, উপাত্ত ও বিষয়। জাদুঘরবিদ ড. স্বপন কুমার বিশ্বাস রচিত ‘আমাদের সংস্কৃতি ও বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর’ শীর্ষক গ্রন্থে ১৪টি প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। শিরোনামের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে; দুর্গাপূজার কিছু ইতিহাস, পালরাজ দেবপালের সমসাময়িক শ্রীপাহিলের একটি অপ্রকাশিত প্রস্তর লিপি, প্রাচীন শিলালিপি পাঠোদ্ধার, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত ভোজ বর্মার ৭ম রাজ্যবর্ষের একটি শিলালেখ, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত লিপিযুক্ত একটি উমা-মহেশ্বর মূর্তি, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত একটি অপ্রকাশিত অর্ধনারীশ্বর মূর্তি ও প্রাসঙ্গিক পর্যালোচনা, মঞ্জুশ্রী : একটি অনন্য দুর্লভ মূর্তি, সমাজ গঠনে জাদুঘর, শতবর্ষে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর : অর্জনের কয়েকটি দিক, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর : গৌরবময় ১০৫ বছর, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অপ্রকাশিত কয়েকটি দলিল, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত ‘রামচন্দ্র অভিষেক’ নামক পা-ুলিপি : একটি আলোচনা, বঙ্গবন্ধুর দুর্লভ তিনটি চিঠি। শতবর্ষে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর অর্জনের কয়েকটি দিক প্রবন্ধে বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে- (১) ঢাকা জাদুঘর স্থাপন প্রক্রিয়া : পহেলা মার্চ ১৯১০ (২) ঢাকা জাদুঘর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন : ৭ আগস্ট ১৯১৩ (৩) বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর প্রকল্প অনুমোদন : ২৭ ডিসেম্বর ১৯৭৫, (৪) বঙ্গীয় শিল্পকলার প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন : ৬-৯ মার্চ ১৯৭৬ (৫) শিক্ষামূলক কর্মসূচী স্কুলবাস উদ্বোধন : ৭ আগস্ট ১৯৭৬ (৬) বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন : ১৭ নবেম্বর ১৯৮৩ (৭) ভারতীয় ইসলামী শিল্পকলা প্রদর্শনী : ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ১৭ অক্টোবর ১৯৯৪ (৮) মুদ্রা প্রদর্শনী : ৯-২০ জুলাই ২০১২ (৯) তথ্য যোগাযোগ ও ডিজিটালাইজেশন কার্যক্রম উদ্বোধন : ২০ জানুয়ারি ২০১৩ (১০) আন্তর্জাতিক সেমিনার অনুষ্ঠান ৮-৯ জুলাই ২০১৩। মোটা দাগে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের উল্লেখযোগ্য অগ্রযাত্রায় ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। ১৯১৩ সালের ৭ আগস্ট তৎকালীন সচিবালয়ের একটি কক্ষে ঢাকা জাদুঘর উদ্বোধন করা হয়। ১৯১৪ সালের ২৫ আগস্ট দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত জাদুঘরের দুইটি কক্ষে স্থান পায় ৩৭৯টি নিদর্শন। কালের পথপরিক্রমায় আজ সেই জাদুঘর এক বিশাল সংগ্রহশালা এবং বাংলাদেশের জাতীয় জাদুঘর। ভাস্কর্য, পোড়ামাটির ফলক, মুদ্রা, পদক, পা-ুলিপি, শিলালিপি, মুক্তিযুদ্ধের নিদর্শন, সমকালীন শিল্পকলা, জাতিতাত্ত্বিক এবং প্রাকৃতিক ইতিহাসের নানাবিধ নিদর্শনের বিশাল সংগ্রহের সামান্য অংশই গ্যালারিতে উপস্থাপিত হচ্ছে। অন্য একটি প্রবন্ধ যার শিরোনাম বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর : গৌরবময় ১০৫ বছর তথ্যবহুল। জাদুঘর নিয়ে যারা কাজ করেছেন তাদের জন্য কিছু দিক নির্দেশনা এই গ্রন্থে উপস্থাপিত হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে আলোচ্য একটি উদ্ধৃতি দেয়া হলোÑ ‘এখানে গ্যালারিতে নিদর্শনগুলো বিক্ষিপ্তভাবে অর্থাৎ সময়ানুক্রমিক বা সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারা অনুযায়ী সাজানো নেই। এগুলোকে সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারা যেমনÑ প্রস্তর যুগ, ব্রোঞ্জ যুগ, মৌর্য, শুঙ্গ, কুষাণ, গুপ্ত, পাল, সেন, সুলতানি আমল, মোগল আমল, ব্রিটিশ আমল ইত্যাদি সভ্যতার নিদর্শন দিয়ে সময়ানুক্রমিকভাবে প্রদর্শনী সাজানো প্রয়োজন।’ (পৃ: ১১১)। ট্রেজার ট্রোভ এ্যাক্ট ১৮৭৮-এর সুষ্ঠু ব্যবহার এবং দেশের বিষয়ভিত্তিক জাদুঘরসমূহের যথাযথ বিকাশ ও উন্নয়নের জন্য এর পরিচালনায় পুনর্বিন্যাসের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। বিষয়টি নতুনভাবে ভেবে দেখবার সুযোগ রয়েছে। জাতীয় জাদুঘরের ৪৫টি গ্যালারিতে বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক উপাদান যেমন রয়েছে তেমন রয়েছে বিশ্বসভ্যতা ও প্রাকৃতিক ইতিহাসের স্মারক। শোকেস, আলো ও লেবেলসমূহে প্রদর্শনীর গুণগত মান উন্নয়ন দিন দিন হচ্ছে। আবার সেখানে আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার করে জাদুঘরে দর্শকদের আকর্ষণ ও অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রদানের বিষয়টি লেখক অগ্রাধিকার দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লিখিত তিনটি চিঠি গ্রন্থের উল্লেখযোগ্য বিষয়। একটি চিঠি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বহস্তে লিখিত, অন্য দুইটি বঙ্গবন্ধু স্বাক্ষরিত। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে যুদ্ধাহত গরীব-দুঃখী বাঙালীকে সাহায্য-সহযোগিতা করতে হয়েছিল। তিনি ছিলেন এক স্বপ্নবাজ। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের সংগ্রহে থাকা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেশ কয়েকটি পা-ুলিপি নিয়ে রয়েছে একটি বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যসমৃদ্ধ প্রবন্ধ। এর মধ্যে কয়েকটি পত্র প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হলো। বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গবন্ধুর বাণী বাঙালীর প্রেরণার উৎস। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে প্রতিটি বাঙালীর হৃদয়ে প্রেরণার উৎস হিসেবে ছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দুর্গাপূজার কিছু ইতিহাস প্রবন্ধে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের আলোকে দুর্গাপূজার ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। পালরাজ দেবপালের সমসাময়িক শ্রীপাহিলের একটি অপ্রকাশিত প্রস্তরলিপি থেকে উত্তরবঙ্গে অর্থাৎ প্রাচীন পু-্রবর্ধনভুক্তি এলাকায় নবম শতকে শ্রীপাহিল নামে এক সামন্ত রাজার সন্ধান প্রথমবারের মত জানা যায়। ভোজ বর্মার ৭ম রাজ্য বর্ষের একটি শিলালেখ, লিপিযুক্ত উমা-মহেশ্বর ও অর্ধনারীশ্বর মূর্তি এবং একটি অনন্য দুর্লভ মঞ্জুশ্রী মূর্তি নিয়ে গ্রন্থের লেখক বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তার এই গবেষণা ভাস্বর্য শিল্পের ইতিহাসে নতুন তথ্য ও মাত্রা যুক্ত হয়েছে। ড. স্বপন কুমার বিশ্বাস দীর্ঘদিন বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে কাজ করেছেন। যে বিশাল ঐতিহাসিক সমুদ্র, সম্পদের ওপর জাতীয় জাদুঘর আজ বিস্তৃত; তার কয়েকটি সোনালী ফসল থেকে উদ্ধার করে লেখক রচনা করেছেন আমাদের সংস্কৃতি ও বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর গ্রন্থ। কয়েকটি প্রবন্ধের আয়তন সংক্ষিপ্ত। তবে একজন সাধারণ পাঠক থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞদের বোধগম্য হওয়ার উপযোগী। সহজ, সরল ভাষা, আকর্ষণীয় উপস্থাপনা গ্রন্থটিকে হৃদয়গ্রাহী করে তুলেছে। গ্রন্থটির বহুল প্রচার আমাদের কাম্য।
×