ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

‘সন্ধ্যার মেঘমালা’ ॥ কথাশিল্পে শঙ্খে সমুদ্রনিনাদ

প্রকাশিত: ১০:৪৬, ১০ মে ২০১৯

 ‘সন্ধ্যার মেঘমালা’ ॥ কথাশিল্পে শঙ্খে সমুদ্রনিনাদ

বিশ শতকের সত্তরের দশক থেকে লেখা শুরু করে প্রায় পঞ্চাশ বছর সাহিত্যসাধনায়রত অনীক মাহমুদ (জন্ম ১৯৫৮) আজ সৃষ্টিশীলতায় বটবৃক্ষের মতো বহুধা বিস্তৃত। কবিতা দিয়ে লেখকজীবন শুরু করেন এবং কবিতাকেই সে জীবনের প্রধান আশ্রয় করে তোলেন। কিন্তু শুধুমাত্র কাব্যচর্চার পরিবৃত্তে নিজেকে সীমাবদ্ধ না রেখে কাব্যনাট্য, ছোটগল্প, শিশুতোষ রচনা, গান, গবেষণাসহ বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় তাঁর সদর্প বিচরণ তাঁর সৃজনশীল সত্তাকে বিচিত্র করে তুলেছে। ক্রমান্বয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের সাহিত্যের প্রধান সারির অন্যতম পরিচিত মুখ। অনীক মাহমুদের এই নিরন্তর সাহিত্য-সাধনায় ২০১৮ সালে যোগ হয়েছে উপন্যাস। ২০১৮ সালের অক্টোবরে ‘গ্রন্থ কুটির’ থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘সন্ধ্যার মেঘমালা’। অবশ্য গ্রন্থাকারে প্রকাশের পূর্বে উপন্যাসটি কলকাতা থেকে বরুণকুমার চক্রবর্তীর সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘কথামুখ’ পত্রিকায় ঐ বছরই শারদীয় সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার পর পাঠক মহলের অভিনন্দিত সাড়া অনীক মাহমুদের ঔপন্যাসিক সত্তাকেও সমমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে। অনীক মাহমুদ উপন্যাসটি শুরুই করেছেন এমন কাব্যিক নিবিড়তায় : ‘কোথাও কেউ নেই! কেউ থাকে না শেষ পর্যন্ত। কংস নারায়ণের কিংবদন্তি বারানঈ নদীর জল গড়িয়ে কেবল ঢেউয়ের মাথায় আছড়ে পড়ে। রতনঘাট থেকে আচিনঘাট ফকিরনি থেকে রানি নদীর ধারা ইয়াছিন নদের মরা বুকে কখনো কখনো ঊর্মিলতা জড়ো করে জগৎ জীবনের উচ্ছ্বাসকে তীব্র করে। বর্ষা আর শ্রাবণের অথৈ মেলবন্ধন ইয়াছিনের চড়াবুকে ভরা গাঙের মদদ এনে দেয়। শীতের শেষে কিংবা চৈত্রের দাবদাহে এর ফাটা বুকের আর্তনাদ পাখিদের কণ্ঠে ফুটে ওঠে। আকাশে যখন চাতকের আহাজারি ‘ফটিক জল-ফটিক জল’ নিচেও তখন গবাদি পশুদের জলের তিয়াসায় ইতিউতি অন্বেষণ বুক ফাটা হাম্বা রব! ইয়াছিন নদ যৌবন হারিয়ে মরাগাঙ বনে যায় চৈত্র-বৈশাখে। আষাঢ়-শ্রাবণে হঠাৎ ফুঁসে উঠে ডুবিয়ে ফেলে ডাঙার ধান-পাট। এই দোটানা জলের বিবর ছোঁয়া একটি জনপদ বৈশালী।’ এভাবেই অনেকগুলো বিস্মৃতিপ্রায় নদ-নদীর পাড় ধরে ঔপন্যাসিক আমাদের এনে দাঁড় করান বৈশালী নামের এক জনপদে। উপন্যাসে এই জনপদেরই এক মর্মন্তুদ কাহিনি শোনাবেন এ উপন্যাসের নায়ক রাজীব পাইক। অনীক মাহমুদ সে কাহিনিরই কথকঠাকুর। ঔপন্যাসিক অনীক মাহমুদ পুরো উপন্যাসটিকে চৌদ্দটি অংশে বিভাজন করেছেন। প্রতিটি অংশকেই লেখক দুই, তিন, চার... এইভাবে ভাগ করেছেন। প্রথম অংশে বৈশালীর স্মৃতিময় দিনগুলোর পাশাপাশি উপন্যাসের নায়িকা নির্বিন্ধ্যার শৈশব জীবনের বর্ণনা করেন উপন্যাসের নায়ক রাজীব। জমিদার কন্যা নির্বিন্ধ্যার চঞ্চলতা, শৈশবের পাকাপাকা কথা, শৈশব সঙ্গী রাজীবের সঙ্গে খেলা করা প্রভৃতির বর্ণনার পাশাপাশি বৈশালীর জমিদার বাড়ির বর্তমান করুণ পরিণতি, জমিদারদের বিভিন্ন কর্মচারীর পদ-পদবী ও অবস্থান আর সেই সঙ্গে জমিদারের পাইকপুত্র রাজীব ও জমিদার-কন্যা নির্বিন্ধ্যার শৈশব-কৈশোরের প্রেম ও অন্তরঙ্গতা। দ্বিতীয় অংশে বৈশালীর জমিদার বাড়ির গল্প এবং রাজীবের সন্ন্যাসী বেশে ফিরে আসা। দ্বিতীয় অংশে রাজীবের সন্ন্যাসী বেশ আর পুত্রহীন জমিদার শশীকান্তের দ্বিতীয় বিয়ে ও প্রথম স্ত্রীর শর্ত পাঠক মহলকে ক্রমান্বয়ে কাহিনির প্রতি আগ্রহী ও একনিষ্ঠ করে তোলে। পাঠকমনে জন্ম দেয় অনেকগুলো প্রশ্ন ও কৌতূহল। তৃতীয় অংশে শশীকান্তের প্রথম স্ত্রীর শর্তানুযায়ী দত্তকপুত্র গ্রহণ ও রাজশাহীর শিল্প-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক পরিবেশের সঙ্গে জমিদার বাড়ির সম্পর্ক বর্ণিত হয়েছে। চতুর্থ অংশে জমিদার শশীকান্তের মৃত্যু হয়। অবশ্য তার আগেই শশীকান্ত দত্তকপুত্র রমাকান্ত ও দ্বিতীয় স্ত্রীর পুত্র শ্যামাকান্তের মধ্যে জমিদার বাড়ি ও সম্পত্তি সমান দুই ভাগে ভাগ করে দেন। এই রমাকান্তেরই কন্যা নির্বিন্ধ্যা। পঞ্চম অংশে উপন্যাসের কাহিনি বেশ শিখরে উঠতে থাকে। অর্ধেক জমিদারির জমিদার রমাকান্ত কন্যা নির্বিন্ধ্যার সঙ্গে রাজীবের সম্পর্ক মেনে তো নিলেনই না বরং দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত কর্মচারী রাজীবের বাবা পাইক রাজেশকে করেন চাকরি ও বাস্তুচ্যুত। শুরু হয় রাজীবের বাস্তুহীন জীবন। ৬ষ্ঠ অংশে রাজীবের পারিবারিক দুর্ভোগ রাজীব-নির্বিন্ধ্যার পত্রালাপ ও প্রেমের একনিষ্ঠতা বর্ণিত হয়েছে। সপ্তম অংশে রাজীবের কেরানির চাকরি লাভ ও পরিবারের স্বস্তি। এক্ষেত্রে জমিদার বাড়ির সঙ্গে রাজীবের পরিবারের যোগসূত্রটি রক্ষায় ঔপন্যাসিক রাজীবের বন্ধু মহেন্দ্রের দাদু শচীনন্দন চরিত্রটি বড় ভূমিকা পালন করে। অষ্টম অংশে জমিদার রমাকান্তের প্রভাব ও প্রতাপের বর্ণনা পাওয়া যায়। তদুপরি এ সংক্রান্ত বিভিন্ন মিথ বর্ণনায় লেখক সিদ্ধহস্ত। বিশেষত জমিদারদের গুপ্ত ঘর, দুনলা বন্দুক, বাঘ শিকার, প্রতিপক্ষকে হত্যা প্রভৃতি মিথ ক্রমশ পাঠককের সামনে সামন্ততান্ত্রিক সমাজজীবনের ছবি মূর্ত হয়ে ওঠে। এমন প্রভাব ও প্রতিপত্তির নবম অংশে নির্বিন্ধ্যা জমিদারী পরিবেশ, পিতৃপ্রতাপ ও শৈশব-কৈশোর স্মৃতিময় বৈশালী ত্যাগ করে চলে আসে কেরানি রাজীবের কাছে। দশম অংশে বৈশালীর জমিদার বাড়িতে দেখা যায় কন্যা হারানো পিতা-মাতার শোকগ্রস্ত অথচ এক চাপা বেদনার্ত পরিবেশ। সে বেদনাকে আরো চাপিয়ে রেখে জমিদার রমাকান্ত কন্যার প্রতি হয়ে ওঠে নির্মম- ত্যাগ করলেন কন্যাকে। এগারোতম অংশে রাজীব-নির্বিন্ধ্যার বিয়ে। বারোতম অংশে ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের নির্মমতা ও তৎপরবর্তী পাকিস্তান আমলে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের বাস্তবতা। বিশেষত নবগঠিত সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তানে অমুসলিম সম্প্রদায়ের পাকিস্তান ত্যাগের করুণ ছবি ভেসে ওঠে এ অংশে। এ আবহ আরো করুণ ও বেদনাবহ হয়ে ওঠে তেরোতম অংশে। রমাকান্তের জমিদারি নেই। স্ত্রী-কন্যাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন শ্যালকের বাসায়। নিজে জমিদারি ত্যাগ করলেও দেশ ত্যাগ করেন নি। প্রাক্তন জমিদার রমাকান্ত হোমিও প্যাথিক চিকিৎসক হয়ে গ্রহণ করেছেন মানবসেবার কাজ। কিন্তু প্রিয় কন্যা নির্বিন্ধ্যাকে দেখতে যাননি একবারও- এমনকি প্রায় কাছাকাছি বসবাস করলেও নির্বিন্ধ্যাও তার বাবাকে দেখতে যান নি। একটা চাপা অভিমান পিতা-কন্যাকে আজীবন আলাদা করে রেখেছে। এ অংশেই এই পৃথক অবস্থাতেই মৃত্যু হয় জমিদার রমাকান্ত ও কন্যা নির্বিন্ধ্যার। উপন্যাসের শেষ ও চৌদ্দতম অংশে একা ও নিঃসঙ্গ এক সন্ন্যাসী রাজীবের জীবনের করুণ বাস্তবতা পাঠকমনে তোলে বেদনার সকরুণ সুর। মৃত্যুর পূর্বে নির্বিন্ধ্যা শেষ বারের জন্য এসেছিলেন বৈশালীতে। শৈশব-কৈশোর স্মৃতিধুলো মেখে নিয়েছিলেন সাড়া শরীরে। সেই বৈশালীতেই ফিরে এসেছেন রাজীব। সব হারিয়ে জীবনের শেষ সময়ে এসে উপস্থিত হয়েছেন বৈশালীতে- যে বৈশালী থেকে শুরু শুধু তারই জীবন নয়- শুরু হয়েছিল জমিদারি পর্বের এক নতুন যুগ। রাজীবের চোখের কোণে যে সমুদ্র সেখানে জমে আছে শুধুই স্মৃতির জল। এ স্মৃতি শুধু রাজীব-নির্বিন্ধ্যার নয়, এ স্মৃতি এক মহাকালের। উপন্যাসের কাহিনি শুরু হয়েছে উনিশ শতকীয় বৃটিশ শাসিত ভারতবর্ষের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিবেশে। ক্রমশ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে উপন্যাস শেষ হয়েছে একাত্তর পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশে। রাজীব-নির্বিন্ধ্যার প্রেম ও পরিণতির মাঝে বৃটিশ শাসন, পাকিস্তান আমল, জমিদারি প্রথা, রানী আনন্দময়ী, নরোত্তম ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ও ঠাকুরবাড়ি, রাজা রামমোহন, মুঘল শাসন, অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, রজনীকান্ত সেন সহ ভারতবর্ষ তথা বাঙালির ইতিহাসের উনিশ ও বিশ শতকের স্বর্ণযুগের নানান আবহ ও ইতিহাস। সর্বোপরি বাংলার অন্যতম জনপদ রাজশাহীর মাটি ও মানুষের জানা-অজানা অনেক ইতিহাসের মেলবন্ধন ঘটেছে মূল কাহিনির বাস্তবতায়। প্রেম, ইতিহাস, সমাজ, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বহুবিধ এই মেলবন্ধন উপন্যাসটিকে মহাকাব্যিক মর্যাদায় অভিষিক্ত করে তুলেছে। এক প্রেমগাথাকে কেন্দ্র করে রাজশাহী জনপদের দুইশত বছরের ইতিহাসকে মাত্র আশি পৃষ্ঠায় মলাটবন্দি করে অনীক মাহমুদ উপন্যাসশিল্পে ঘোষণা করেছেন শঙ্খে সমুদ্রনিনাদ। অনীক মাহমুদ, সন্ধ্যার মেঘমালা, প্রকাশক: গ্রন্থ কুটির, প্রথম প্রকাশ: অক্টোবর ২০১৮, প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ, পৃ. ৮০, মূল্য: ১৫০ টাকা।
×