ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

হতভাগ্য ড্যাশ-৮ ॥ আর আকাশে উড়বে না

প্রকাশিত: ০৯:২৪, ১০ মে ২০১৯

 হতভাগ্য ড্যাশ-৮ ॥  আর আকাশে  উড়বে না

আজাদ সুলায়মান ॥ ইয়াঙ্গুনের দুর্ঘটনায় সৌভাগ্যক্রমে সব আরোহী প্রাণে রক্ষা পেলেও উড়োজাহাজটি মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয়েছে। এটি আর আকাশে উড়বে না। সে সময় দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া ও বৃষ্টি থাকায় উড়োজাহাজটিতে আগুন ধরেনি। এতেই সব আরোহী প্রাণে বেঁচে গেছেন। এ ধরনের দুর্ঘটনায় সাধারণত আগুন ধরে গিয়ে প্রতিটি আরোহীর প্রাণহানি ঘটে। বিমানের পাইলটের দক্ষতায় প্রাণহানি ঘটেনি। এ ধরনের বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে কোন প্রাণহানি ও বড় কোন ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই বিমান অবতরণ করানোটা পাইলটের দক্ষতা বলে মনে করছেন এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এ ধরনের পরিস্থিতিতে বিমান অবতরণ না করে উড়ে যাওয়া বা অপেক্ষা করাই পাইলটের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত। যদি কোন কারণে পেছনের দুটি চাকা কাজ করার আগে সামনের চাকার নোজ হুইল খুলে যায় সে ক্ষেত্রে বিমানে এই ধরনের সমস্যা হতে পারে। এছাড়া ল্যান্ড করার পর বাতাসের ধাক্কায় আবার যদি উঠে পরতে হয় তাহলে নামার সময় এ রকম হতে পারে বলে জানিয়েছেন এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ আশীষ রায় চৌধুরী। জানা গেছে, হতভাগ্য ড্যাশ-৮ উড়োজাহাজটি এর আগেও একাধিকবার যান্ত্রিক ত্রুটির শিকার হয়েছিল। কানাডার বম্বার্ডিয়ারের কোম্পানির এই উড়োজাহাজটির রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে এর আগেও প্রশ্ন উঠেছিল। পাইলটদের অভিযোগ, উড়োজাহাজটির উড্ডয়নযোগ্যতা না থাকার পরও তাদের ফ্লাই করতে বাধ্য করা হয়। দুর্ঘটনার শিকার উড়োজাহাজটির পাইলট নজরুল শামীম মাস খানেক আগেও এই প্রতিনিধির কাছে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে, কোন সময় এটি বড় দুর্ঘটনার শিকার হতে পারে। দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখতে ইতোমধ্যে একটি তদন্ত কমিটি করেছে কর্তৃপক্ষ। তাদের চীফ অব ফ্লাইট সেফটি ক্যাপ্টেন শোয়েব চৌধুরী ৬ সদস্যের এই তদন্ত দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এ ছাড়া উড়োজাহাজটির ক্ষতি নিরূপণে বিমানের গ্রাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারদের একটি দল মিয়ানমারে গেছে। বৃহস্পতিবার ভোরেই মিয়ানমার থেকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে অপেক্ষমাণ ১৭ যাত্রীকে। এদিকে মিয়ানমারের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসা ছবিতে কানাডার কোম্পানি বম্বার্ডিয়ারের তৈরি ড্যাশ-৮ উড়োজাহাজটিকে ভাঙ্গা ডানা নিয়ে রানওয়ের পাশে ঘাসের মধ্যে পড়ে থাকতে দেখা যায়। এভিয়েশন সেফটি নেটওয়ার্ক জানায়, ওই বিমানে আগুন না ধরলেও ফিউজিলাজ ভেঙ্গে তিন টুকরো হয়েছে। ফরোয়ার্ড প্যাসেঞ্জার ডোরের পেছনে এবং রিয়ার সার্ভিস ডোরের ঠিক পেছনে কাঠামো ভেঙ্গে গেছে। উড়োজাহাজের তলাও ফেটে গেছে। ডান পাশের ডানাও জোড়া থেকে ভেঙ্গে গেছে। বিমানের কোন দায়িত্বশীল বিভাগ স্বীকার না করলেও প্রকৌশল শাখার সূত্র জানিয়েছে- উড়োজাহাজটির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। খাস বাংলায় বলা চলে এটি ভেঙ্গে পাঁচ টুকরো হয়ে গেছে। এটিকে আর কখনও উড্ডয়নযোগ্য করা সম্ভব হবে না। দেশে ফিরিয়ে আনাও সম্ভব হবে না। প্রায় ২০ মিলিয়ন ডলারের এই উড়োজাহাজটি বছর খানেক আগে কানাডা থেকে লিজে আনা হয়। এটি ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় এখন বিমানবহরে মোট দুটো ড্যাশ-৮ মডেলের এয়ারক্রাফট সক্রিয় রয়েছে। অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক ফ্লাইটগুলো সামাল দেয়া এখন কঠিন হয়ে পড়বে। এটাকে বিমানের মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা বলে হিসেবে দেখা হচ্ছে। ঘটনার পর বৃহস্পতিবার বলাকায় ডাকা এক সংবাদ সম্মেলনে জনসংযোগ শাখার মহাব্যবস্থাপক শাকিল মেরাজ বলেন, মিয়ানমারে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা সেখানে আছেন। তারা সর্বক্ষণিক খোঁজ-খবর নিচ্ছেন, তদারকি করছেন। যে ১৪ জন সেখানে চিকিৎসা নিচ্ছেন, তাদের সর্বোচ্চ ভাল চিকিৎসা দেয়ার জন্য যা যা করা দরকার, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পক্ষ থেকে তার সবকিছুই করা হচ্ছে। বিমানটি বীমার আওতায় রয়েছে। বীমার শর্ত অনুসারে আহত যাত্রীরা ক্ষতিপূরণ পাবেন। তবে কে কতটা আহত হয়েছেন এসব পর্যবেক্ষণ করে বীমা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। বিমানের কান্ট্রি ম্যানেজার মীর আক্তার সেখানে আছেন, ঘটনার পর থেকেই সর্বক্ষণিক আপডেট নিচ্ছেন। এখন পর্যন্ত সব ঠিকঠাক আছে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী যাত্রীদের জন্য যে ধরনের সাপোর্ট লাগবে আমরা সেটা বিমানের পক্ষ থেকে দেব। জিএম শাকিল মেরাজ বলেন, সবচেযে বড় কথা হলো এই দুর্ঘটনায়, আমাদের যাত্রী এবং ক্রু, সবাই নিরাপদে আছেন, বড় কোন সমস্যা হয়নি। তাদের চিকিৎসা চলছে, আশা করছি তারা দ্রুতই সুস্থ হয়ে উঠবেন। ২৯ জনের মধ্যে একজনের বয়স ছিল ২ বছরের কম। তাদের কতজন দেশী, কতজন বিদেশী বা কয়জন কোন দেশের নাগরিক তা পাসপোর্ট চেক করে আমরা আপনাদের জানাব। মিয়ানমার থেকে বুধবার যে যাত্রীদের নিয়ে বিমানের ওই ফ্লাইটের ফেরার কথা ছিল, তারা ইয়াঙ্গুন বিমানবন্দরে আটকা পড়েছিলেন। তাদের নিয়ে আসার জন্য বিমানের বিশেষ ফ্লাইট বিজি ১০৬০ রাতে ঢাকা থেকে মিয়ানমারে পাঠানো হয়। উড়োজাহাজটির কতটা ক্ষতি হয়েছে তা শাকিল মেরাজের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা যেটুকু ছবিতে দেখেছি, একটা হিউজ ইমপ্যাক্ট তৈরি হয়েছে এ্যাক্সিডেন্টের পর, বডির স্ট্রাকচারাল ড্যামেজ হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করার জন্য বিমানের পক্ষ থেকে গ্রাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারদের একটি টিম সেখানে গেছেন। তারা সেখান থেকে এসে এ্যাসেসমেন্ট রিপোর্ট দিলে আমরা মিডিয়া আপডেট দেব। বিমানটি কতদিন আগে আনা হয়েছিল, কতদিনের পুরনো- এ বিষয়ে প্রশ্নের কোন উত্তর দেননি শাকিল মেরাজ। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, দুর্ঘটনায় আহত যাত্রীদের চিকিৎসা ব্যয়ভার বহন করবে বিমান। আহতদের চিকিৎসা ও অন্য সব ধরনের সেবা ও সহযোগিতা দিতে বিমানের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া মিয়ানমারে বাংলাদেশ দূতাবাস হাসপাতালে ভর্তি যাত্রীদের সার্বিক বিষয়ে তদারকি ও খোঁজখবর রাখছেন। দুর্ঘটনার পর ১৯ জন যাত্রী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। এর মধ্যে চারজনকে চিকিৎসা শেষে বুধবার রাতেই ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এদিকে বিমানের প্রকৌশল শাখা জানিয়েছে, ওই উড়োজাহাজটিতে প্রায়ই যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিত। এ পর্যন্ত কয়েকবার বড় ধরনের দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে এটি। এয়ারক্রাফটটি অপারেশনের উপযোগী না হলেও প্রতিদিন চার-পাঁচটি রুটে চলাচল করত। গত ৬ মার্চ হায়দরাবাদ থেকে সি-চেক (বড় ধরনের মেরামত) সেরে দেশে আসার পথেই এয়ারক্রাফটটির ইঞ্জিনের ওপরে থাকা ব্লাংকেট পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ফলে ইঞ্জিন অস্বাভাবিক উত্তপ্ত হয়ে পড়ে এবং ইঞ্জিন অয়েল বিপজ্জনক মাত্রায় চলে আসে। তখন আকাশেই বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। কিন্তু অল্পের জন্য রক্ষা পায়। যদিও বিমানটিতে ওই সময় কোন যাত্রী ছিল না। সেদিন এয়ারক্রাফটটির নিউমেটিক লাইনের পাইপে ক্ল্যাপ খোলা ছিল। যে কারণে অয়েল লিক করায় এই সমস্যা হয়। ওই সময় কানাডা-বম্বার্ডিয়ার কোম্পানির প্রতিনিধিরা এসে উড়োজাহাজটিকে উড্ডয়নযোগ্য বলে ঘোষণা দিলে বিমান আবার সেটিকে অপারেশনে নিয়ে আসে। তার দুই মাসের মধ্যেই বিধ্বস্ত হলো সেটি। এবার যেভাবে দুমড়ে-মুচড়ে ধ্বংস হয়েছে এটাকে আর উড্ডয়নযোগ্য করা যাবে না বলে জানিয়েছেন বিমান প্রকৌশলীরা। এ সম্পর্কে বিমানের অপর একজন প্রকৌশলী জানান, গত ২৫ জানুয়ারি এয়ারক্রাফটটিকে ভারতের হায়দরাবাদের ‘জিএমআর এ্যারো টেক কোম্পানি’তে পাঠানো হয় ‘সি-চেক’ (বড় ধরনের মেরামত) করানোর জন্য। ১৫ দিনে ‘সি-চেক’ শেষ করার কথা থাকলেও সময় লাগে প্রায় দেড় মাস। আবার সমস্যা সারানোর বদলে নতুন সমস্যা তৈরি করে এয়ারক্রাফটটিকে ঢাকায় পাঠানো হয়। এ ঘটনার পর ‘জিএমআর এ্যারো টেক কোম্পানি’র সি-চেকের কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জানা গেছে, দুর্ঘটনার শিকার উড়োজাহাজটির পাইলট নিজের জীবন বাজি রেখে প্রতিটি যাত্রীর প্রাণ বাঁচানোর দৃঢ় মানসিকতায় অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা করেন। তবে আবহাওয়ার বুলেটিন তিনি অমান্য করেই অবতরণ করেছিলেন কিনা সেটা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ওই রকম পরিস্থিতিতে তিনি কি অবতরণ করে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন নাকি হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তদন্তকারীরা সেটাই খতিয়ে দেখছে। দুর্ঘটনার পর সামাজিক মাধ্যমে আসা ছবিতে পাইলট শামীম নজরুলকে রক্তাক্ত অবস্থায় পায়ে হেঁটে বিমান থেকে টার্মিনালে আসতে দেখা যায়। তাকেও হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। আহতদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে বেশি আঘাত পেয়েছেন। তার মাথা ফেটে যাওয়ায় প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। হটলাইন ॥ আহত যাত্রীদের স্বজনরা যাতে জরুরী প্রয়োজনে যোগযোগ করতে পারে, সেজন্য বিমানের অপারেশন্স কল সেন্টারে একটা হটলাইন চালু করা হয়েছে। এর নম্বর +৮৮০২৮৯০১৫৩০।
×