ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মতিলাল দেব রায়

সড়ক দুর্ঘটনা এবং কিছু কথা

প্রকাশিত: ০৮:৫৩, ১০ মে ২০১৯

 সড়ক দুর্ঘটনা এবং কিছু কথা

ঢাকা শহরসহ মফস্বলে সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশের কোন নাগরিক যদি নিহত বা আহত হন তা হলে তাদের পরিবার কি যথাযথ ক্ষতিপূরণ হিসেবে আর্থিক সাহায্য ও চিকিৎসা সেবা পাওয়ার অধিকার সংরক্ষণ করেন। এটা তার ন্যায্য অধিকার। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, দেশের সুশীল সমাজের কেউ কেউ বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করার জন্য সরকারী আর্থিক ও বিশেষ সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। কিন্তু দেশের কোন কৃষক বা কৃষকের সন্তান বা কোন শ্রমজীবীর সন্তান বা কোন শ্রমিক কোন দুরারোগ্য রোগী বা দুর্ঘটনায় আহত কাউকে বিদেশে পাঠিয়ে সরকারী আর্থিক বা চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়েছে এমন কথা শোনা যায় না। অথচ দেশের যে কোন নাগরিক সে যেই হোক একজন শ্রমজীবী বা বড় কোন কর্মকর্তা বা একজন ভূমিহীন কৃষক রাষ্ট্রের চোখে সকলেই সমান, সকলেই রাষ্ট্রীয় সকল সুযোগ-সুবিধা সমানভাবে পাওয়ার অধিকার রাখে। বাংলাদেশের সংবিধানে উল্লেখ আছে যে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হবেন। মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করার জন্য, নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বন্টন নিশ্চিত করার জন্য এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধাদান নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ঢাকায় দুর্ঘটনা ঘটলে যখন রাস্তা অবরোধসহ ভাঙচুর শুরু হয় যা দেশবাসী ও সরকারের দৃষ্টিগোচর হয়। পরবর্তী সময়ে নিহতের পরিবার থানায় মামলা করেন, কোন কোন ক্ষেত্রে চালককে আটক করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে চালক পলাতক হয়ে যায়। এক সময় বিষয়গুলো চাপা পড়ে যায়। কেউ জানে না থানায় মামলা দেয়ার পর এই মামলার শেষ পরিণতি কি হয়। যে দুর্ঘটনাগুলো নিয়ে বেশি আলোচিত সেগুলোর রাতারাতি কিছু অস্থায়ী সিদ্ধান্ত নেয়া হয় কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঝুলে থাকে। ঢাকা শহরের বাইরে জেলা, উপজেলা এবং গ্রাম পর্যায়ে যে সড়ক দুর্ঘটনা হয় সেগুলোর খবর অনেকেই রাখে না এবং তাদের নিয়ে তেমন কোন চিন্তাও করা হয় না। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে, ২০১৮ সালে ৫৫১৪টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ৭২২১ জন নিহত হন। আহত হন ১৫৪৬৬ জন। সমিতির মহাসচিবের দাবি, পরিবহন খাতের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার লোকজন, পুলিশ, পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের নিয়ে দুর্নীতির দুষ্টচক্র গড়ে উঠেছে। তার ভাষায় এই চক্র চায় না পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসুক। এ জন্যই সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামানো যাচ্ছে না। কোন মৃত্যু কারও কাম্য নয়। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু যে কত হৃদয় বিদারক তা যার পরিবারে ঘটেছে তা কেবল ভুক্তভোগী পরিবার উপলব্ধি করতে পারে। আমি ২০১৯ সালের কয়েকটি সড়ক দুর্ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ করছি, যা নিউইয়র্ক শহরে বসে আমায় গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। মালিবাগের আবুল হোটেলের সামনের রাস্তায় দুই বাসের মাঝখানে পড়ে মিম আক্তার ও নাহিদ পারভিন পলি নামের দুই জন গার্মেন্টস কর্মী নিহত হয়েছেন। মা-বাবার সংসারে সুখ ফেরাতে ঢাকায় এসেছিল বগুড়ার গাবতলী উপজেলার কিশোরী মিম আক্তার (১৬)। নতুন বছরের প্রথম দিনে যোগ দিয়েছিল রাজধানীর মালিবাগে তৈরি পোশাক কারখানায়। দুপুরের বিরতিতে সিনিয়র সহকর্মী নাহিদ পারভিন পলির (১৯) সঙ্গে মগবাজারের পূর্ব নয়াটোলার বাসা থেকে খাবার খেয়ে কর্মস্থলে যাচ্ছিল পথে গাড়ি তাদের পিষে মারে। ২১ জানুয়ারি ২০১৯ চটগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের অনার্স চতুর্থ বর্ষের (২০১২-২০১৩ সেশন) ছাত্রী নুসরাত চৌধুরী নিশাত চট্টগ্রাম ভাটিয়ারী এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হন। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১২ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে না ফেরার দেশে চলে যান। চট্টগ্রাম সিটি কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্রী সোমা বড়ুয়া (১৮) ১৬ জানুয়ারি সকালে চট্টগ্রাম কোতোয়ালি থানার সামনে ভ্যানচাপায় নিহত হন। তিনি চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার বাসিন্দা। একই দিন কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রায় ৭ম শ্রেণীর ছাত্র ওমরকে আজমেরি পরিবহনের চলন্ত বাস থেকে হেলপার ধাক্কা মেরে ফেলে দিলে সে ওই বাসেরই চাকার নিচে পড়ে মাথায় আঘাত পায় পরে হাসপাতালে নেয়ার পর তার মৃত্যু হয়। ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ তারিখে শেরপুরে ইজিবাইকের ধাক্কায় আশিকুর রহমান নামের শেরপুর জেলা পুলিশ লাইনে কর্মরত একজন পুলিশ কনস্টেবল নিহত হন। নিহতদের প্রায় সবাই দেশের প্রত্যন্ত এলাকার বা গ্রাম থেকে উঠে আসা, তাদের কেউ নেই যে আইন আদালতে গিয়ে নালিশ করবে। তাদের দুর্ঘটনার সংবাদ কি কোথাও রেকর্ড থাকবে? এদের বিচার পাওয়ার কি অধিকার নেই। রাষ্ট্র কি এদের বিচারের দায়িত্ব নিতে পারে না। দুর্ঘটনায় যারা মৃত্যুবরণ করেন তাদের পরিবারের কেউ আইনের আশ্রয় নিয়ে দীর্ঘদিন আদালতে আসা-যাওয়া সম্ভব হয় না, তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মামলা করা থেকে বিরত থাকে নিহতের পরিবার। দৈনিক সংবাদের মোজাম্মেল হোসেন মন্টু ১৯৮৯ সালে রাজধানীর শান্তিনগরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। তার মৃত্যুর পর পরিবারের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ চেয়ে করা মামলায় ২৬ বছর পর চূড়ান্ত রায় দেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। ২০১৬ সালের ১৩ এপ্রিল দেয়া ওই রায়ে মন্টুর পরিবারকে তিন কোটি ৫২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দেয়া হয় দুর্ঘটনা সংঘটনকারী গাড়ির কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডকে। কিন্তু রায় হওয়ার প্রায় তিন বছর পরও ক্ষতিপূরণের টাকা বুঝে পাননি প্রয়াত মন্টুর পরিবার। শুধু তাই নয়, আলোচিত পাঁচটি সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনায় করা ক্ষতিপূরণের মামলায় হাইকোর্ট যেসব আদেশ দিয়েছে, সে সবও বাস্তবায়ন হয়নি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই হাইকোর্ট আদেশ দেয়ার পর ওই আদেশের বিরুদ্ধে আপীল বিভাগে আবেদন করা হয়েছে। কয়েকটি মামলায় আপীল বিভাগ হাইকোর্টের আদেশ বহাল রাখলেও আইনী মারপ্যাঁচে ফেলে বিষয়টি উচ্চ আদালতেই ঝুলিয়ে রাখারও নজির পাওয়া গেছে। ফলে সড়ক দুর্ঘটনায় রায় বা আদেশ পেলেও ক্ষতিপূরণ পাওয়া থেকে বঞ্চিত থাকছে নিহতের পরিবার। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের ক্ষতিপূরণের বেশিরভাগ মামলাই নিম্ন আদালতে বিচারাধীন। একাধিক মামলায় উচ্চ আদালত থেকে নিহতের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার রায় হয়েছে। কিন্তু দেশের ইতিহাসে এ পর্যন্ত মাত্র দুটি মামলায় ক্ষতিপূরণ পেয়েছে নিহতের পরিবার। আইনী লড়াই শেষে ১৬ বছর পর ২০১৭ সালের ১৯ এপ্রিল সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাফিয়া গাজীর পরিবারকে ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয় বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশন (বিআরটিসি)। ১৯৯১ সালের ২৯ মার্চ রাজধানীর মৌচাক মার্কেটের সামনে মারা যান নাফিয়া গাজী। এ ছাড়া সড়ক দুর্ঘটনায় বিমানবন্দর সড়কে গত বছরের ২৯ জুলাই জাবালে নূর পরিবহনের একাটি বাসের চাপায় নিহত হন দুই শিক্ষার্থী আবদুল করিম রাজীব ও দিয়া আক্তার মিম। পরে ওই দুই পরিবারকে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ৭ অক্টোবর পাঁচ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণের দেয় জাবাল নূর কর্তৃপক্ষ। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী রাজীব হোসেনের দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বাস মালিক কর্তৃপক্ষকে হাইকোর্ট নির্দিষ্ট অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয়নি। ১৯ মার্চ রাজধানীর কুড়িল এলাকায় সুপ্রভাত বাসের চাপায় মারা যান বিইউপি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরী। পরে ২০ মার্চ হাইকোর্ট থেকে আবরারের পরিবারকে ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু ওই আদেশের বিরুদ্ধেও আপীল করেছে বাস মালিক পক্ষ। উচ্চ আদালত ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিষয়ে যেসব আদেশ দিচ্ছেন, তা অত্যন্ত ইতিবাচক। ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হলে চালকদের মধ্যে বেপরোয়াভাবে গাড়ি না চালানোর বিষয়ে সচেতনতা বাড়বে। তা ছাড়া মালিকপক্ষ বিষয়টি যথাযথভাবে তদারক করতে সচেষ্ট হবে। সড়ক দুর্ঘটনায় এ পর্যন্ত যারা নিহত হয়েছেন বা আহত হয়েছেন অথবা পঙ্গু হয়ে কারও বোঝা হয়ে বা অন্যের অনুগ্রহের ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছেন- তাদের কেউ কি সরকারী/বেসরকারী সাহায্য পেয়েছেন কিনা জানি না। পৃথিবীর উন্নত দেশে দুর্ঘটনা হলে বাস মালিক, ভুক্তভোগী সকলে নিয়ম অনুযায়ী ইন্স্যুরেন্স থেকে সঙ্গে সঙ্গে আর্থিক ও চিকিৎসাসেবা পেয়ে থাকেন। কেউ দোষী হলে আইন অনুযায়ী বিচার হয়। আইন সরকারী/বেসরকারী সকলের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। আমাদের দেশে ঢাকা বা এর আশপাশের কেউ দুর্ঘটনার শিকার হলে গণমাধ্যমসহ সরকারী মাধ্যম ও ওই দুর্ঘটনার সময় সক্রিয় হতে দেখা যায় কিন্তু জেলা-উপজেলাগুলোতে কত দুর্ঘটনায় দেশের মানুষ মৃত্যুবরণ করেন তার দিকে কারও নজর দেয়ার সময় নেই। সংবিধানের মতে সকল নাগরিক একই রকম সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকার সংরক্ষণ করেন। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত সদস্যের পরিবারের কোন ছেলে বা মেয়েকে শিক্ষাগত যোগত্যা অনুযায়ী সরকার কর্তৃক একটি চাকরির ব্যবস্থা ও সেই পরিবারকে এক কালীন কিছু আর্থিক সাহায্য ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেয়ার জন্য আবেদন রাখছি। আমরা জানি, পরিবারের কোন সদস্যের জীবনের মূল্য টাকা দিয়ে সুদ করা যায় না তবুও স্বল্প আয়ের প্রান্তিক পরিবারগুলো যদি এই টাকা সাহায্য হিসেবে পায় তা হলে তাদের আর্থিক অবস্থা পরিবর্তন হলে একটু সান্ত¡না পাবে। পরিশেষে আমার একটি পরামর্শ- দেশের সকল জেলা-উপজেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় যেসব মানুষ নিহত হয়েছেন তাদের সকলের নামের তালিকাসহ বিস্তারিত তথ্য রাখা খুবই প্রয়োজন। যা বিবিএস (বাংলাদেশ বুরু অব স্ট্যাটেস্টিকস) রাখতে পারে। বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের যেমন জন্ম নিবন্ধন হয়, ঠিক তেমনিভাবে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর নিবন্ধনও রাখা জরুরী। তা না হলে সেই নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্রের আচরণ বৈষম্যমূলক বলে বিবেচিত হবে। লেখক : আহ্বায়ক: ক্যাম্পেইন ফর রোড সেফ্টি, নিউইয়র্ক
×