ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

হলদিবাড়িতে দৈনিক ১২ হাজার শরণার্থী আসছে ॥ ৯ মে, ১৯৭১

প্রকাশিত: ১০:৩৫, ৯ মে ২০১৯

হলদিবাড়িতে দৈনিক ১২ হাজার শরণার্থী আসছে ॥ ৯ মে, ১৯৭১

১৯৭১ সালের ৯ মে দিনটি ছিল রবিবার। এই দিন কুমিল্লার বগাদিয়া নামক স্থানে মুক্তিবাহিনী ও পাকবাহিনীর মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ হয়। প্রায় ৪-৫ ঘণ্টাব্যাপী উভয় পক্ষের আক্রমণ আর পাল্টা আক্রমণ চলে। পাকসেনারা হতাহত সহযোদ্ধাদের নিয়ে চৌমুহনীর দিকে পিছু হটে। পাকহানাদার বাহিনী দিনাজপুরের অমরখানার জগদল এলাকায় দৃঢ় প্রতিরক্ষা ঘাঁটি স্থাপন করে। অপরদিকে মুক্তিবাহিনী ভজনপুর মূল ঘাঁটি থেকে ৩/৪ মাইল দূরে মাগুরমারী ও ময়নাগুড়ি নামক স্থানে দুটি ছোট ঘাঁটি স্থাপন করে। ফরিদপুরের কোটালীপাড়া থানায় অবস্থানরত পাকসেনাদের ওপর হেমায়েত উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধা দল তীব্র আক্রমণ চালায়। থানায় অবস্থানরত সশস্ত্র পুলিশ ও মিলিটারি সৈন্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিবর্ষণের মুখে লড়াই করার সাহস হারিয়ে ফেলে এবং আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে থানা ছেড়ে পালায়। এদিন ফ্লাইট লেঃ মতিউর রহমান মুক্তি সংগ্রামীদের সপক্ষে পাকিস্তান থেকে একটি বিমান ছিনতাই করে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের পরিকল্পনা করতে থাকেন। এদিন মুক্তিবাহিনীর ৬নং সেক্টরের ভজনপুর সাব-সেক্টরের দায়িত্বে সুবেদার মেজর কাজিমউদ্দিনের স্থলাভিষিক্ত হন ক্যাপ্টেন নজরুল। ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জে পাকহানাদার বাহিনী প্রবেশ করেই বর্ধনপাড়া ও কলাকোপা গ্রামে হামলা চালায়। স্থানীয় দালালদের সহযোগিতায় হানাদাররা গ্রামের লোকজনকে নির্বিচারে হত্যা করে ও বাড়িঘরগুলো আগুনে পুড়িয়ে দেয়। বর্বরদের পৈশাচিক হামলায় ২০ জন নিরীহ গ্রামবাসী নিহত হয়। মুক্তিবাহিনীর ২নং সেক্টরে বিলোনিয়া সাব-সেক্টর প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সাব-সেক্টরের দায়িত্বে কমান্ডার নিযুক্ত হন ক্যাপ্টেন জাফর। পাকসেনা ও রাজাকারদের একটি কনভয় ৫ ট্রাক অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদসহ পত্নীতলা থানার হরতকিডাঙ্গা গ্রামের কাছে পৌঁছলে মেজর নাজমুলের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের গতিরোধ করে এতে উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ বাঁধে। এ সংঘর্ষে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর কনভয় সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়। এদিন কক্সবাজারে পাকবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর তীব্র আক্রমণ চালায়। মুক্তিবাহিনী পাকবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। এদিন জাতীয় পরিষদের সাবেক সদস্য জামায়াত নেতা মওলানা এ.কে.এম ইউসুফের নেতৃত্বে খুলনা কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। এদিন আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘আখাউড়ায় প্রচ- লড়াই : ১৫০ পাক সেনা নিহত’ শিরোনামে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই দিন দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় ‘শরণার্থী আগমন অব্যাহত: সমস্যা বাড়ছে’ শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, হলদিবাড়ি শহরে বাংলাদেশ থেকে অসংখ্য শরণার্থী আসতে থাকায় গুরুতর সমস্যা দেখা দিয়েছে। জেলা কর্তৃপক্ষ বিষয়টি সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানিয়ে বলেছেন, দৈনিক গড়ে ১২ হাজার মানুষ হলদিবাড়ি আসছেন। জেলা কর্তৃপক্ষ আরও বলেছেন, শহর ও সীমান্ত পরিদর্শন করে দেখা গিয়েছে বুধবার প্রায় বারো হাজার শরণার্থী এসেছেন এবং সীমান্তের ওপারে আরও বাইশ হাজার মানুষ এপারে আসার জন্য অপেক্ষা করছেন। কুচবিহার জেলার ছোট শহর হলদিবাড়িতে এ পর্যন্ত দেড় লাখেরও বেশি শরণার্থী এসেছেন। এই অসহনীয় অবস্থার প্রতীকারের জন্য জেলা কর্তৃপক্ষ রাজ্য সরকারের কাছে তাঁবু এবং ওষুধপত্র চেয়েছেন। সরকারী ব্যবস্থাপনায় ইতোমধ্যে ৩৫টি শিবির প্রায় পঞ্চাশ হাজার শরণার্থীকে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গ্রামাঞ্চলের স্কুল-বাড়িগুলোই অস্থায়ী শিবিরে পরিণত হয়েছে। আরও বহু মানুষ রাস্তার পাশে অথবা খোলা মাঠে নিজেদের শতরঞ্জি, চাদর দিয়ে ছাউনি করে কোন মতে মাথা গুঁজবার ঠাঁই করে নিয়েছে। শরণার্থীদের যারা এপারের আশ্রয় শিবিরে এসে আশ্রয় নিয়েছে, তাঁদের মধ্যে এক অভিন্ন বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা গেছে। ধর্ম ও সম্প্রদায়ের কোন পার্থক্য নেই- এক পরিচয় ওরা সবাই বাঙালী। ওপারের আত্মীয়-স্বজনের খবর বিনিময় করছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যারা লড়াই করছেন, ওদের প্রাত্যহিক খবর নেবার জন্য ওরা ব্যগ্র-কবে ঘরে ফিরে যাবে তারই প্রতীক্ষা করছে। আট বছরের তয়েব বাবা- মাকে হারিয়ে আজ ইসলামপুর স্কুলে ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। পাক দস্যুরা গুলিতে তার বাবা ও মাকে হত্যা করেছে। রফিককে গুলী করে বর্বররা তয়েবের মার দিকে বন্দুক তাক করে। তাই দেখে তয়েব কেঁদে ওঠে এবং সঙ্গে সঙ্গে বন্দুকের গুলিতে তার মা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এই দেখে তয়েব নদীর ঘাটের দিকে পালায়। সেখানে অনেক লোক নদী পার হয়ে ভারত সীমান্তের দিকে পালাচ্ছে। তয়েব তাদের সঙ্গে ভিড়ে পড়ে। তার জীবনের মর্মান্তিক ঘটনা সকলকে স্পর্শ করে। তারা তয়েবকে সঙ্গে নিয়ে প্রায় এক সপ্তাহ নানা গ্রাম ঘুরে ইসলামপুরে আসেন। ‘জয় বাংলা সংগ্রাম সংহতি কমিটি’ অনেক উদ্বাস্তুকে বিনা মূল্যে রান্না করা খাদ্য সরবরাহ করেছেন। বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৪ লক্ষ উদ্বাস্তু সীমান্ত পেরিয়ে ত্রিপুরায় এসে হাজির হয়েছে। ত্রিপুরার নিজস্ব লোকসংখ্যা হলো ১৫ লাখ। সাবরুম মহকুমায় এসেছে ১ লাখ ৩৭ হাজার উদ্বাস্তু। এই মহকুমার নিজস্ব লোকসংখ্যা হলো মাত্র ৬০ হাজার। সরকারী সূত্রে এই খবর পাওয়া গেছে। এক বিবৃতিতে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শ্রী শচিন্দ্রলাল সিংহ ত্রিপুরায় আগত উদ্বাস্তুদের সাহায্যে এগিয়ে আসার জন্য রাজ্য সরকারগুলোকে এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রতি আবেদন জানিয়েছেন। করিমগঞ্জে বাংলাদেশ ত্রাণ কমিটির পক্ষ থেকে অসমের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে একটি স্মারকলিপি পেশ করে বলা হয়েছে যে, সীমান্তের অপার থেকে আগত উদ্বাস্তুদের সম্পর্কে উপযুক্ত খোঁজ খবর করার পর ভারতে বসবাসের অধিকার যেন দেয়া হয়। অন্যথায় সমাজবিরোধীরা এই সুযোগে ভারতে এসে হাজির হতে পারে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×