ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আঞ্চলিক দলের সন্ত্রাসে পাহাড়ের রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন

প্রকাশিত: ০৯:৫৪, ৯ মে ২০১৯

আঞ্চলিক দলের সন্ত্রাসে পাহাড়ের রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ পাহাড়ে আঞ্চলিক দলগুলোর সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে মূলধারার রাজনীতির পরিবর্তন শুরু হয়েছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিন পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। উপজেলা নির্বাচনের চিত্রও একই রকম। ২৫ উপজেলায় নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের ১৭ জন জয়লাভ করেছেন। আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে জেএসএস (মূল) পেয়েছে তিনটি, জেএসএস (সংস্কার) তিনটি, ইউপিডিএফ (মূল) পেয়েছে একটি ও স্বতন্ত্র পদে একজন জয়লাভ করেন। নির্বাচনের এমন ফলই বলে দিচ্ছে পাহাড়ের রাজনীতিতে একটা বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। নির্বাচনে এ ধরনের ফলাফল প্রসঙ্গে পার্বত্য অধিকার ফোরামের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন, দীর্ঘদিন ধরে পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত পাহাড়ী-বাঙালীদের জিম্মি করে রেখেছে আঞ্চলিক দলগুলো। তাদের অস্ত্রের ভয়ে কেউ মুখ খুলতে পারত না। অত্যাচার নির্যাতনের ঘটনা অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। সাধারণ উপজাতি ও পাহাড়ী বাঙালী এসব থেকে মুক্ত থাকতে চায়। বিষয়টি নিয়ে উপজাতিরা বেশি সোচ্চার ছিল। তাদের কারণেই মূলত এত বেশি পরিবর্তন ঘটেছে। বাঙালীদের ওপর অত্যাচার করা হলে তারা অন্তত কথা বলতে পারে। প্রতিবাদ জানাতে পারে। কিন্তু পাহাড়ীদের ওপর নির্যাতন করা হলে তারা এসব করতে পারে না। আঞ্চলিক সংগঠনগুলো তাদের ওপর বেশি মাত্রায় নির্যাতন ও চাঁদাবাজি করে। এসব কারণে বাঙালী-উপজাতিরা ওইসব দল থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছেন। যদিও এসবের কারণে তাদের অনেককে চরম মূল্য দিতে হচ্ছে। এরইমধ্যে অনেক উপজাতি নেতা মূল ধারার রাজনীতির মঞ্চে উঠে আঞ্চলিক দলগুলোর বিরুদ্ধে বক্তব্যও দিয়েছেন। বলেন, মূল ধারার রাজনীতি এখানে পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত না হলে পাহাড় হয়ে উঠবে অশান্ত। ফলে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়বে। হাবিব বলেন, উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যানের বাইরে ভাইস চেয়ারম্যান (পুরুষ) পদে আওয়ামী লীগের ১২, জেএসএস (মূল) এর ৪, ইউপিডিএফ (মূল) এর ২, পার্বত্য নাগরিক পরিষদের ১ ও স্বতন্ত্র পদে ৬ জন জয়লাভ করেছেন। একইভাবে ভাইস চেয়ারম্যান (মহিলা) পদে আওয়ামী লীগের ১৪, জেএসএস (মূল) এর ৩, জেএসএস (সংস্কার) এর ১, ইউপিডিএফ (মূল) এর ১ ও স্বতন্ত্র পদে ৬ জন জয়লাভ করেন। সবমিলিয়ে উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ৪৩, জেএসএস (মূল) এর ১০, জেএসএস (সংস্কার) এর ৪, ইউপিডিএফ (মূল) এর ৪, পার্বত্য নাগরিক পরিষদের ১ ও স্বতন্ত্র পদে ১৩ জন জয়লাভ করেন। সূত্র জানিয়েছে, যুগ যুগ ধরে পাহাড়ে আঞ্চলিক দলগুলোর প্রাধান্যই ছিল। তারাই পাহাড়কে নিজেদের মতো করে চালাত। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ অন্যান্য দলের প্রাধান্য পাওয়া যেত না। আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর একছত্র আধিপত্যে বলা চলে মূল ধারার রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা ছিলেন কোণঠাসা। খুনোখুনী, দমন, পীড়ন, চাঁদাবাজি আর অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে সম্প্রতি আঞ্চলিক সংগঠনগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন সাধারণ পাহাড়ীরা। পাশাপাশি পার্বত্য অঞ্চল ঘিরে জুম্মল্যান্ড আন্দোলনকে বাংলাদেশ বিরোধী বলে মনে করছেন তারা। এদিকে, সাধারণ মানুষ এসব সংগঠন থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলায় বেপরোয়া হয়ে উঠছে আঞ্চলিক দলগুলো। তাই দল ত্যাগ করলেই হত্যা করা হচ্ছে। বাড়ি থেকে অপহরণ মুক্তিপণ নেয়া নিত্যদিনের ঘটনা। অনেকে আবার গুমের শিকার হয়েছেন। পরিবারের সদস্যদের ওপর নেমে আসছে নির্মম নির্যাতন। কথিত আছে- আঞ্চলিক দলগুলোতে ঢোকা যায়, বের হওয়া যায় না। কেউ বের হতে চাইলে তাকে চরম মূল্য দিতে হয়। তিন পার্বত্য জেলায় বর্তমানে চারটি আঞ্চলিক সংগঠন বেশ সক্রিয়। এগুলো হচ্ছে জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্ত লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), জেএসএস (সংস্কার), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) ও ইউপিডিএফ (সংস্কার)। এছাড়া এসব সংগঠনের পৃথক অঙ্গসংগঠন পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, হিল উইমেন্স ফেডারেশন, যুব সমিতি, মহিলা সমিতি ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরামসহ একাধিক শাখা সংগঠন রয়েছে। এসব সংগঠনের রয়েছে সন্ত্রাসী গ্রুপ। তারা পাহাড়ে নিয়মিত চাঁদা আদায়সহ নানা অপকর্ম করে যাচ্ছে। স্থানীয়রা জানান, অতীতে পার্বত্য অঞ্চলের যে কোন নির্বাচনে সরাসরি হস্তক্ষেপ থাকত এসব আঞ্চলিক দলগুলোর। তাদের সহায়তা ছাড়া সাধারণ পাহাড়ীদের সমর্থন পাওয়া যেত না। এবার জাতীয় নির্বাচনে ঘটেছে উল্টো ঘটনা। তিন পার্বত্য জেলায় বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করেছেন আওয়ামী লীগ দলীয় এমপিরা। জাতীয় নির্বাচনে খাগড়াছড়ি ২৯৮নং আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা। তিনি নৌকা প্রতীক নিয়ে ২ লাখ ৩৬ হাজার ১শ’ ৫৬ ভোট পান তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ইউপিডিএফ সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী সিংহ প্রতীক পান ৫৯ হাজার ২শ’ ৫৭ এবং ধানের শীষ ৫১ হাজার ২শ’ ৬৬ ভোট পেয়েছিলেন।
×