ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকা-দিল্লী দৌড়ঝাঁপ করেও হতাশ

জেট এয়ার বন্ধ হওয়ায় পাওনাদাররা বিপাকে

প্রকাশিত: ০৯:৪৯, ৯ মে ২০১৯

 জেট এয়ার বন্ধ হওয়ায় পাওনাদাররা বিপাকে

আজাদ সুলায়মান ॥ জেট এয়ারওয়েজ আকস্মিকভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শুধু ভারত নয়- বাংলাদেশেরও বিপুল সংখ্যক পাওনাদার বিপাকে পড়েছেন। এ সঙ্কট দুনিয়াব্যাপী। পাওনাদাররা চরম হতাশায় দিন গুনছেন। তাদের পাওনা নিকট ভবিষ্যতে আদায়েরও কোন সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন দেশী-বিদেশী এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা। ঢাকায় এই মুহূর্তে কয়েক শত পাওনাদার এ নিয়ে চরম অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। জানতে চাইলে সিভিল এভিয়েশনও ঠিকমতো জবাব দিতে পারছেন না। কবে নাগাদ কোন প্রক্রিয়া বাংলাদেশের লোকজনের পাওনা আদায় করা সম্ভব হবে জানতে চাইলে সিভিল এভিয়েশনের (মেম্বার অপারেশন) এয়ার কমডোর মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এয়ারলাইন্সগুলো আন্তর্জাতিক নিয়ম কানুন মেনেই এক দেশ থেকে অন্য দেশে গিয়ে ব্যবসা করে। যদি কোন পাওনা থাকে সেটা আদায় করারও নীতিমালা রয়েছে। সিভিল এভিয়েশন রেগুলেট বডি হিসেবে শুধু জেট এয়ারওয়েজ নয়- প্রতিটি এয়ারলাইন্সকেই তাদের কার্যক্রম পরিচালনায় সহায়তা করে। সেই শর্তেই তাদের অনুমতি দেয়া হয় ব্যবসা করার জন্য। এখন কোন এয়ারলাইন্স কার সঙ্গে কিভাবে লেনদেন করবে সেটা তাদের একান্তই নিজস্ব বিষয়। তারপরও যদি কেউ ভিকটিম হয়ে থাকে সেই টাকা আদায়ে যে নিয়ম রয়েছে সেটাই অনুসরণ করা হবে। গত মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আকস্মিক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন প্রতিদিনই বাড়ছে পাওনাদের চাপ। ঢাকা থেকে দিল্লী সর্বত্র তাদের দৌড়ঝাঁপ। হাজার হাজার লগ্নিকারীর অভিযোগ- অন্য কিছু না হলেও টিকেট কেটে যারা ভ্রমণ করতে পারছেন না অন্তত তাদের টাকাটা ফেরত দেয়া সম্ভব। শুধু ঢাকাতেই কয়েক শ’ লোক টিকেট কেটেছেন অগ্রিম- সেগুলো ফেরত দেয়ার লক্ষণ নেই। ঢাকায় জেট এয়ারের জেনারেল সেলস এজেন্সি (জিএসএ) বেঙ্গল এভিয়েশনের পক্ষ থেকেও পাওনাদের টাকা কবে নাগাদ পরিশোধ করা হবে সে নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। টিকেট ছাড়াও অন্য বিনিয়োগকারীদের মাঝে নেমে এসেছে চরম হতাশা। এছাড়া সিভিল এভিয়েশনেরও পাওনা রয়েছে প্রায় বিশ কোটি টাকার মতো। বিভিন্ন এরোনটিক্যাল চার্জের বিপরীতে ভ্যাট বাবদ এ পাওনা। ২০০৯ সাল থেকে জেট এয়ারওয়েজ কোন ভ্যাট পরিশোধ করছে না। এ টাকাও সহসা আদায়ের কোন লক্ষণ নেই বলে জানিয়েছেন হিসাব বিভাগের একটি সূত্র। এ বিষয়ে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ আশিষ রায় চৌধুরী বলেছেন, সাধারণত এ পরিস্থিতিতে জেট এয়ারের জিএসএ-কেই হয় টিকেট রিইস্যু করে দিতে হবে। নইলে টাকা ফেরত দিতে হবে। যাত্রীর প্রথম ইচ্ছা অনিচ্ছাকেই এখানে প্রাধান্য দিতে হবে। অনেক যাত্রী আগেই আমেরিকা যাওয়ার টিকেট কিনে রেখেছেন। এখন যদি যাত্রী আমেরিকা যেতেই চায় তাহলে জেট এয়ারকেই অন্য এয়ারলাইন্সের মাধ্যমে হলেও এনডোরস করে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। না হলে যাত্রীকে সরাসরি টাকা দিতে হবে সংশ্লিষ্ট ট্রাভেলস এজেন্টসের মাধ্যমে। তিনি বলেন, জিএমজি যখন বন্ধ হয়ে যায় তখন- একই পদ্ধতিতে ৬ কোটি টাকার দায় মেটানো হয়েছে এ পদ্ধতিতে। জেট এয়ারের জিএসএ-কেও তাই করতে হবে। এর বাইরে অন্যান্য লগ্নিকারী বা বিনিয়োগকারীর দাবি জেট সরাসরি নিষ্পত্তি করতে বাধ্য। এ বিষয়ে বিমানের সাবেক পরিচালক আলী আহসান বাবু বলেন, প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে এখন জেটএয়ারের সেই অবস্থা নেই। দেশী-বিদেশী পাওনাদাররা কবে কি পাবেন সেটা জেট এয়ারের পক্ষেও বলা মুশকিল। তবে এসব অভিযোগ সম্পর্কে ঢাকায় জেটএয়ারের কান্ট্রি ম্যানেজার রাজকুমার বলেছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেছেন, ঢাকায় তেমন কোন পাওনাদার নেই। সবাইকে মিটিয়ে দেয়া হয়েছে। কারণ গত ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকায় জেটএয়ারের সব টিকেট বিক্রি বন্ধ করে দেয়া হয়। ৩১ মার্চ পর্যন্ত সময়সীমার মধ্যে সবার টাকা ফেরত বা রিলোড করে দেয়া হয়েছে। ঢাকায় সাধারণত এক মাসের বেশি অগ্রিম টিকেট কাটে না। সে হিসেবেই বলা যায়, পাওনদার নেই। কিছু পাওনাদার এখনও বিভিন্ন এজেন্টস অফিসে গিয়ে ধর্ণা দিচ্ছেন কেন প্রশ্ন করা হলে রাজকুমার বলেন, হ্যাঁ কিছু ক্লায়েন্ট হয় তো থাকতে পারে। আমি মনে করি সেটা কিছুতেই দুই শ’র বেশি হবে না। ওই টাকা পরিশোধ করা হবে আইএটিএ-এর মাধ্যমে। আইএটিএ-এর বিলিং সেটেলমেন্ট সিস্টেম (বিএসপি) অনুসরণ করেই টাকা দেয়া হবে। এটা সময় সাপেক্ষ। যারা ওই প্রক্রিয়ায় আবেদন করেছেন তাদেরটা দেয়া হবে। এ নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই। সিভিল এভিয়েশনের ভ্যাট পাওনা সম্পর্কে রাজকুমার বলেন, এটা অন্য একটা ব্যাপার। এ পাওনা শুধু জেট নয়- সবারই কাছে পাবে সিভিল এভিয়েশন। এনিয়ে একটা বড় সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে। কবে নাগাদ জেট সঙ্কট কাটবে জানতে চাইলে রাজকুমার বলেন, এটা সাময়িক। আমি তো এখনও ঢাকায় আছি। আশায় আছি দিল্লী থেকে একটা ভাল খবর আসবে। সঙ্কট কেটে ওঠার চেষ্টা চলছে। খুব শীঘ্রই এ সঙ্কট কেটে গেলে আবারও ঢাকা থেকে চালু হবে জেটএয়ার। উল্লেখ ভারতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিমান পরিষেবা সংস্থা জেটএয়ারওয়েজের সব ফ্লাইট বন্ধ ঘোষণা করা হয় গত মাসের মাঝামাঝি। গত ১৭ এপ্রিল এয়ারলাইন্সটির কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিয়েছে, তারা বিমানসংস্থাটি আর চালাতে পারছে না। বর্তমানে জেট এয়ারওয়েজের দেনার পরিমাণ ৮ হাজার কোটি টাকারও বেশি। বেশ কিছুদিন ধরেই জেট এয়ারের আর্থিক অবস্থা খারাপ যাচ্ছিল। এক পর্যায়ে শোনা যাচ্ছিল টাটা কিনে নিচ্ছে এয়ারলাইন্সটি। এ নিয়ে কথাবার্তাও যে হয়নি তা নয়। তবে এর শেষ পরিণতি পেল এটি বন্ধের মধ্য দিয়ে। ২৫ বছর আগে যাত্রা শুরু করা এয়ারলাইন্সটি বন্ধ হয়ে গেল একটিমাত্র নোটিসেই। এমন দুনিয়াব্যাপী একটাই প্রশ্ন- কেন বন্ধ হলো এয়ারলাইন্সটি। এ সম্পর্কে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ বিমানের সাবেক এমডি এয়ার কমডোর জাকিউল ইসলাম বলেন, অপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনায় চরম ধরা খেয়েছে এটি। দেনা-পাওনার জর্র্জরিত হয়ে খাদে পড়ে জেট। এই মুহূর্তে এয়ার ইন্ডিয়া প্রায় ৫০ হাজার কোটি রুপী দেনাগ্রস্ত। মূলত ব্যাংকসমূহ থেকে জেট এয়ারওয়েজকে কেউ ঋণ দিতে রাজি না হওয়াতেই এয়ারলাইন্সটি বন্ধ হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ। যদিও জেট থেকে বলা হচ্ছে- অনেক চেষ্টা, তদবির করেই এয়ারলাইন্সটি বন্ধ করা ছাড়া আর কোন বিকল্প রাস্তা খুঁজে পায়নি। এয়ারলাইন্সটিকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রায় মাস খানেক ধরেই তাদের ফ্লাইট সংখ্যা অনেক কমিয়ে দিয়েছিল। অথচ বছর খানেক আগেও জেটের বহরে ছিল ১২০টি উড়োজাহাজ। জেট এয়ারওয়েজ বন্ধ হওয়ার আরেকটি কারণ হলো- সম্প্রতি ইউএস ডলারের তুলনায় রুপীর দাম অনেক কমে গেছে। এতে সঙ্কটে থাকা সংস্থাটি উড়োজাহাজের পার্টস থেকে শুরু করে জ্বালানি তেল ক্রয়ের ক্ষেত্রে বাড়তি রুপী গুনতে হয়েছে। এছাড়া অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ডলারে বেতন দেয়ার ক্ষেত্রেও তাদের এ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। তবে ব্যাংক ঋণ না পাওয়াই কিংবা রুপীর দাম কমা এয়ারলাইন্স বন্ধের প্রধান কারণ নয়। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণেই বিপদে পড়ে এয়ারলাইন্সটি। এসবিআইসহ অন্য ব্যাংকসমূহের কথা ছিল একটাই, আগে তাদের ঋণ শোধ করতে হবে। নতুবা নতুন কোন ঋণ নয়। জ্বালানি তেলের দাম বাড়াতে নিজেদের ব্যয় সমন্বয় করার উপায় ছিল একটিই। আর তা হলে এয়ার টিকেটের দাম বাড়িয়ে দেয়া। কিন্তু ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে টিকেটের দাম বৃদ্ধি করে টিকে থাকাটাও একটি কঠিন কাজ।
×