ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

হ-য-ব-র-ল অবস্থা জাপায়

প্রকাশিত: ০৯:৪৮, ৯ মে ২০১৯

 হ-য-ব-র-ল  অবস্থা জাপায়

রাজন ভট্টাচার্য ॥ টানা দুই বারের বিরোধী দল এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি। পার্টির নেতাকর্মীরা বলেন, রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমতাচ্যুতির পর আওয়ামী লীগের সঙ্গে মহাজোট গঠনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সুসময় পার করছেন এরশাদ। সব মিলিয়ে ২০০৮ সালের পর থেকেই জাতীয় পার্টির রাজনীতি একবারেই নিরাপদ বলা চলে। কিন্তু ১০ বছরের বেশি সময়ে জাপার রাজনৈতিক উত্থান একেবারেই হয়নি। বরং সাংগঠনিক দুর্বলতা বেড়েছে। আর ২০১৯ সালে এতে জাপার অবস্থা একেবারেই হ-য-ব-র-ল। এক কথায় বললে, এরশাদের অবর্তমানে পার্টি অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়তে পারে। যার আলামত এখনই স্পষ্ট হয়েছে। বেড়েছে নেতৃত্বের কোন্দল। প্রকাশ্যে সবাই এক থাকলেও মূলত চারটি ধারায় ভাগ হয়েছে এরশাদের জাপা। জাপার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দল প্রধান জিএম কাদেরকে দায়িত্ব দিয়েছেন। এরশাদের সর্বশেষ এই সিদ্ধান্ত কতটুকু বহাল থাকবে তাই এখন দেখার বিষয়। জাপার শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দলটির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা মনে করে ভবিষ্যত উত্তরসূরি হিসেবে জিএম কাদেরের কোন বিকল্প নেই। কিন্তু শীর্ষ নেতাদের একটা বড় অংশ তা মানতে নারাজ। তারা মনে করেন, অবশ্যই সিদ্ধান্ত পাল্টাবেন এরশাদ। দল চেয়ারম্যানের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী যে কোন মুহূর্তে তা বদলাতে পারেন। এর মধ্যে একটি পক্ষ চায় দলের ভবিষ্যত নেতৃত্ব আসুক রওশনের হাতে। অন্য পক্ষ চায় কোন্দলের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা যাক অন্য কারও হাতে। তৃতীয় পক্ষের হাতে ক্ষমতা গেলে নেতৃত্ব নিয়ে কাড়াকাড়ি কমবে। দলের একটি পক্ষ বলছে, দেড় মাসের ব্যবধানে ছোট ভাই গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদেরকে দ্বিতীয় দফায় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান পদে নিযুক্ত করেছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তার এই ‘হঠাৎ’ সিদ্ধান্তে এবার নাখোশ রওশনপন্থীরা। তবে অতীতের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী এ সিদ্ধান্তকেই শেষ বলে মানছেন না তারা। তাদের আশা, আবারও এরশাদের মতের পরিবর্তন হবে। জিএম কাদেরকে সরিয়ে রওশনকে দলের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে বসাবেন দলটির চেয়ারম্যান। তবে, জাতীয় পার্টির মধ্যপন্থীরা বলছেন ভিন্ন কথা। জীবনের প্রায় শেষ সময়ে অসুস্থ এরশাদ নতুন কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়ে আর চিন্তা করবেন কিনা তা নিয়ে তাদের সংশয় রয়েছে। অতীতের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে জাতীয় পার্টির রওশনপন্থী নেতারা বলছেন, এরশাদ কখনই নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারেননি। বিভিন্ন ঘটনা ও সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিজের দেয়া সিদ্ধান্ত নিজেই পরিবর্তন করেছেন অহরহ। সেই ধারাবাহিকতায় জিএম কাদেরকে নিয়ে এরশাদ যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেখানে পরিবর্তন এলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। অবশ্য যদি কোন কারণে তিনি নতুন করে কোন সিদ্ধান্ত দিতে না পারেন, সেই ক্ষেত্রে তাদের দলের আগামী কাউন্সিল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। বুধবার ছাত্র সমাজের দু’গ্রুপের মধ্যে জাপার বনানী কার্যালয়ে ধাওয়া পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। একটি পক্ষ দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানাতে আসলে আরেক পক্ষের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। ছাত্র সমাজের একাধিক নেতা জানান, রওশনপন্থী আর কাদের পন্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। মূলত জিএম কাদেরকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান পদে মেনে নেয়া না নেয়ার প্রশ্নে এই সংঘর্ষ হয়। এরশাদের স্ত্রী ও পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশন বলেছেন, নতুন নেতৃত্বের জন্য কাউন্সিল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আমরা আশাবাদী দ্রুত সময়ে দলের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হবে। জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য আবু হোসেন বাবলা বলেছেন, চলতি বছরের মধ্যেই দলের কাউন্সিল হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কাউন্সিলেই নতুন নেতৃত্ব ঠিক হবে। রওশনপন্থীদের দাবি, দলে তাদের অবস্থান দৃঢ় এবং নেতাকর্মীর বেশিরভাগই তাদের সঙ্গে রয়েছেন। ফলে কাউন্সিল হলে জিএম কাদেরের পক্ষে চেয়ারম্যান হওয়া সম্ভব নয়। তবে তৃণমূলের বেশিরভাগ নেতাকর্মী জিএম কাদেরের পক্ষে। সম্প্রতি কাদেরকে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে এরশাদ সরিয়ে দিলে গণপদত্যাগের হুমকি আসে জাপার ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত রংপুরের নেতাকর্মীদের থেকে। মূলত সাংগঠনিক চাপের মুখেই এরশাদ নত হয়ে ভাইয়ের বিরুদ্ধে নেয়া সকল সিদ্ধান্ত বাতিল করতে বাধ্য হন। জিএম কাদেরকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করার বিষয়ে জানতে চাইলে দলের সাংগঠনিক সম্পাদক মনিরুল ইসলাম মিলন বলেন, পার্টির চেয়ারম্যান যে সিদ্ধান্ত নেবেন তার সঙ্গে সারাদেশের নেতাকর্মীরা আছেন, তা আমি বিশ^াস করি। আমাদের প্রত্যাশা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে জিএম কাদের দলকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে জিএম কাদের বলেন, মানুষ চায় জাপার ভবিষ্যত নেতৃত্ব রংপুর থেকেই আসুক। আশাকরি পার্টির চেয়ারম্যান বিষয়টি উপলব্ধি করেই সিদ্ধান্ত নেবেন। রওশনপন্থী জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ফখরুল ইমাম বলেন, আমাদের খটকা লেগেছে এত রাতে কেন কাউকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করার ঘোষণা দিতে হবে। স্যার (এরশাদ) চাইলে এটা সকালবেলাও করতে পারতেন। উনাকে আমরা দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী যে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা দিয়েছি। সেই ক্ষমতাবলে তিনি জিএম কাদেরকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করেছেন। তাছাড়া স্যার এখনও তো চেয়ারম্যান আছেন, বিরোধীদলীয় নেতা আছেন। এক প্রশ্নের জবাবে জাতীয় পার্টির এই সংসদ সদস্য বলেন, জিএম কাদেরকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা দলের জন্য ভাল নাকি মন্দ তা সময় বলে দেবে। কারণ, দলের ৩২ বছরের ইতিহাসে অনেক মহাসচিব বদল হয়েছে, যা অন্য কোন দলে হয়নি। এটাও তারই ধারাবাহিকতা। তিনি আরও বলেন, আমাদের কাউন্সিলের দুই বছর হয়ে গেছে। এই বছরের শেষের দিকে আরেকটা কাউন্সিল হওয়ার কথা রয়েছে। কাউন্সিলের মাধ্যমে জিএম কাদেরের চেয়ারম্যান হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু জানতে চাইলে ফখরুল ইমাম বলেন, এটা তো বলা মুশকিল। কারণ, আমাদের দলে যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি অনেকে আছেন। স্যার যখন কাউন্সিলে চেয়ারম্যানের পদ উন্মুক্ত করে দেবেন, তখন তো অনেকে চেয়ারম্যান হওয়ার জন্য প্রার্থী হবেন। দলের প্রায় ১৪ হাজার কাউন্সিলর আছেন। তারা কাকে ভোট দিয়ে চেয়ারম্যান করবেন সেটা তো এখন বলা মুশকিল। রওশনপন্থী দলটির আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য এসএম ফয়সল চিশতী বলেন, এই বিষয় নিয়ে মন্তব্য করার এখনও সময় আসেনি। জাপার কল্যাণ চান এমন নেতৃস্থানীয় কয়েকজন জানিয়েছেন, দলে এখন নানামুখি খেলা চলছে। পার্টির চেয়ারম্যানের অসুস্থতার কারণে এ খেলা দিন দিন আরও জমছে। যে যার মতো করে ব্যক্তিগত স্বার্থে দলকে কাজে লাগানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাছাড়া দলের অনেক নেতাই এখন কাউকে মানেন না। তারা নিজেদের মতো করে চলেন। কোন জবাবদিহিতা নেই। তাই সঙ্কট বাড়ছে। জিএম কাদেরের ঘনিষ্ঠ জাতীয় পার্টির একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে এরশাদ সবাইকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের নির্দেশ দিলেও অনেকে তা অমান্য করেন। কিন্তু জিএম কাদের তার নির্দেশ মতো মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন এবং নির্বাচন করেননি। সে কারণে এখন তাকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করে আমাদের নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পুরস্কার দিয়েছেন বলে মনে করি। গত জানুয়ারি মাসে জিএম কাদেরকে নিজের অবর্তমানে দলের দায়িত্ব পালনের সিদ্ধান্ত দেয়ার পর গত ২২ মার্চ আবারও তাকে সরিয়ে দেন এরশাদ। একইসঙ্গে সংসদের উপনেতার পদ থেকেও তাকে সরিয়ে দেয়া হয়। এই ঘটনা তুলে ধরে ওই দলটির নেতারা বলেন, ওই সময় দলের একটি অংশ এরশাদ সাহেবকে ভুল বুঝিয়ে ওই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছিলেন। পরে ভুল বুঝতে পেরে তাকে কো-চেয়ারম্যানের পদ ফেরত দেন। এখন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করে আস্থাকে আরও দৃঢ় করেছেন। জাপার একটি সূত্র জানায়, এরশাদের অবর্তমানে জিএম কাদেরকে যারা চেয়ার‌্যান হিসেবে মেনে নিতে চাইবেন তারা সংখ্যায় খুব বেশি নন। সরকারপক্ষ তাদের যদি সহযোগিতা করে তাহলে শেষ পর্যন্ত তিনি এই দলের চেয়ারম্যান থাকবেন। জিএম কাদেরকে জাপা’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ার‌্যান করার যে ঘোষণা দিয়েছেন এরশাদ, সেই সিদ্ধান্ত আবার পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা জানতে চাইলে জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক সেনা কর্মকর্তা মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, এই বিষয়ে তো বলা মুশকিল। এর আগেও জিএম কাদের এই দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে স্যার (এরশাদ) তাকে সরিয়ে দেন। এখন আবার সেই দায়িত্ব দিয়েছেন। এরশাদের এই সিদ্ধান্তে রওশনপন্থীরা যে মনোকষ্টে তা স্বীকার করে মাসুদ উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, সবাই পার্টির চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য। কারও কোন আপত্তি থাকলেও পার্টির স্বার্থে তা ভুলে গিয়ে চেয়ারম্যানের দেয়া সিদ্ধান্ত মেনে নেয়া ভাল হবে। আর কাউন্সিলে কী হবে সেটা এখন বলা সম্ভব নয়। জাতীয় পার্টির মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, জাতীয় পার্টি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের দল। উনি যতদিন থাকবেন তার সিদ্ধান্ত সবাই মেনে নিতে বাধ্য। সেটাই হলো দল। এটা নিয়ে বাইরে কথা বলার কিছু নেই। তবে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে ষড়যন্ত্র থেমে নেই। রওশনপন্থীদের সঙ্গে আছেন সাবেক কয়েকজন মন্ত্রী ও সাংসদ। তারা নানাভাবে এরশাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে বাধ্য করান। সম্প্রতি দেখা গেল, এরশাদ যখন জিএম কাদেরের সব পদ পদবি ফিরিয়ে দিলেন তখন তার বাসার সামনে নেতাকর্মীরা অন্তত তিনদিন পাহাড়া দেন। তারা বলেন, দলের চেয়ারম্যানকে ভুল বুঝিয়ে আবারও সিদ্ধান্ত বদলে দিতে পারেন রওশনের অনুসারীরা। তাই পাহাড়া দেয়া হচ্ছে।
×