ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মানবিক বিশ্ব বিনির্মাণে রবীন্দ্র ভাবনায় একাত্মতা জানাল জাতি

প্রকাশিত: ০৯:৩৯, ৯ মে ২০১৯

 মানবিক বিশ্ব বিনির্মাণে রবীন্দ্র ভাবনায় একাত্মতা জানাল জাতি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ নিজের সৃষ্টির আলোয় উদ্ভাসিত হলেন রবীন্দ্রনাথ। বাঙালীকে দু’হাত ভরে দিয়েছিলেন। কালজয়ী কবিতায়, প্রিয় সঙ্গীতে নতুন করে মূর্ত হলেন তিনি। বাঙালীর প্রতিটি আবেগ আর সূক্ষ্ম অনুভূতিকে স্পর্শ করে থাকা মহামানবের মাঝে যেন নিজেকেই খুঁজে নিলেন ভক্ত অনুরাগীরা। কৃতজ্ঞচিত্তে তাকে স্মরণ করলেন। শ্রদ্ধা জানালেন। এভাবে বুধবার ২৫ বৈশাখ জাতীয়ভাবে উদ্যাপিত হলো বিশ্বকবির ১৫৮তম জন্মবার্ষিকী। রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে রাজধানী ঢাকাসহ কবির স্মৃতিবিজড়িত আরও পাঁচটি স্থানে বিশেষ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়। এবার মানবিক বিশ্ব বিনির্মাণে রবীন্দ্রনাথের যে ভূমিকা, তা বিশেষভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়। সে লক্ষ্যে জাতীয় আয়োজনের প্রতিপাদ্য ছিল ‘মানবিক বিশ্ব বিনির্মাণে রবীন্দ্রনাথ।’ জাতীয়ভাবে রবীন্দ্রজয়ন্তী উদ্যাপনের মূল আনুষ্ঠানিকতা ছিল ঢাকার শিল্পকলা একাডেমিতে। বুধবার জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে বিশেষ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। এতে বিশেষ বক্তৃতা করেন ছায়ানট সভাপতি সন্জীদা খাতুন ও জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জমান। স্মারক বক্তৃতা করেন প্রাবন্ধিক মফিদুল হক। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন শিক্ষা মন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি। সভাপতিত্ব করেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। প্রধান অতিথির বক্তৃতায় ডাঃ দীপু মনি বলেন, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৫৮ বছর আগে এবং প্রয়াতও হয়েছিলেন প্রায় ৮০ বছর আগে। তারপরও আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে তিনি ভীষণ প্রাসঙ্গিক। আমাদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-অনুভূতিতে তিনি নিত্য বিরাজমান। সাহিত্যের এমন কোন শাখা নেই যেখানে রবীন্দ্রনাথের পদচারণা ছিল না। রবীন্দ্রনাথ তিন হাজারের বেশি গান রচনা করেছেন। এঁকেছেন দুই হাজারের বেশি চিত্রকর্ম। সৃষ্টি প্রয়াসে তিনি নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী। রবীন্দ্রনাথ বাঙালী সংস্কৃতির চিরায়ত রূপকার। মন্ত্রী বলেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্যাসিবাদের ক্রমাগত ঔদ্ধত্যে রবীন্দ্রচিত্তে আলোড়ন তুলেছিল। রবীন্দ্রনাথ সাম্প্রদায়িকতা, সংকীর্ণতা ও উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার। তিনি ছিলেন মানবতার অগ্রপথিক। মন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গত শতকের পঞ্চাশের দশকে রবীন্দ্রনাথ রচিত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানকে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত করার স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তা বাস্তবায়ন করা হয়। তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথের সমাজ ভাবনা, পল্লী উন্নয়ন, ক্ষুদ্র ঋণ, কৃষি ভাবনা প্রভৃতি থেকেও আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত যা এ যুগেও সমানভাবে প্রযোজ্য। সভাপতির বক্তব্যে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী বলেন, বরেণ্য ব্যক্তিদের জীবনে কমবেশি অভিমান থাকে। মায়ের সান্নিধ্য তেমন পাননি বলে রবীন্দ্রনাথের একটি অভিমান ছিল। কেননা তখন ঠাকুরবাড়ির রেওয়াজ ছিল ধাত্রীদের মাধ্যমে সন্তানদের লালন-পালন। এদিন সকালে বাংলা একাডেমিতে আয়োজন করা হয় একক বক্তৃতার। ‘রবীন্দ্রনাথের বাংলাদেশ : শিক্ষা ও স্বদেশ ভাবনা’ শীর্ষক বক্তৃতা প্রদান করেন অধ্যাপক আনোয়ারুল করীম। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। নাতিদীর্ঘ বক্তৃতায় অধ্যাপক আনোয়ারুল করীম বলেন, রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা ও স্বদেশ ভাবনা অনন্যতার দাবি রাখে। তার শিক্ষা ভাবনা ছিল প্রায়োগিক এবং বৈজ্ঞানিক। তিনি পূর্ববাংলায় জমিদারির দায়িত্ব নিয়ে এসেছেন কিন্তু একই সঙ্গে পালন করেছেন মানবিক দায়িত্ব। বাংলার শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের জীবন মানোন্নয়নে তার ভাবনার অন্ত ছিল না। তিনি ঔপনেবেশিক শক্তির হাতে তার স্বদেশ ভূমিকে লুণ্ঠিত হতে দেখেছেন। এই লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে আত্মশক্তি জাগরণের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ স্বদেশকে নতুন করে নির্মাণের ব্রত নিয়ে আমৃত্যু সাধনা করে গেছেন। সভাপতির বক্তব্যে জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা ভাবনার মূলে ছিল আনন্দের ধারণা, যে শিক্ষা-কাঠামোয় কঠিন শাসনের পরিবর্তে ছিল উদারতার আবহ। রবীন্দ্রনাথ দেশপ্রেমে স্নাত ছিলেন তবে কোনভাবেই সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন না। তার মানব ভাবনার মূলে ছিল অসাম্প্রদায়িক বিশ্বনাগরিকের সুদৃঢ় অবস্থান। এর আগে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী। বলেন, একাডেমি পাঁচ খন্ডে রবীন্দ্রজীবন প্রকাশের কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যে তিনটি খন্ড প্রকাশিত হয়েছে। আহমদ রফিক প্রণীত ‘রবীন্দ্রজীবন’র বাকি দু’টো খন্ড অচিরেই প্রকাশ করা যাবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি। অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমি প্রবর্তিত রবীন্দ্র পুরস্কার-২০১৯ প্রদান করা হয়। এ বছর রবীন্দ্রসাহিত্যে গবেষণায় সামগ্রিক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পুরস্কার পান অধ্যাপক সফিউদ্দিন আহমদ ও অধ্যাপক বেগম আকতার কামাল। রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চার স্বীকৃতিস্বরূপ পুরস্কার পান ইকবাল আহমেদ। পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক ও শিল্পীর হাতে পুষ্পস্তবক, সনদ, সম্মাননা স্মারক ও পুরস্কারের অর্থমূল্য তুলে দেয়া হয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পর্বে সঙ্গীত পরিবেশন করেন শামা রহমান এবং ইকবাল আহমেদ। রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে আবৃত্তি করেন বাচিকশিল্পী রূপা চক্রবর্তী। ঢাকার বাইরে কবিগুরুর স্মৃতি বিজড়িত কয়েকটি স্থানে একইদিন উদ্যাপিত হয় রবীন্দ্রজয়ন্তী। শিলাইদহের আয়োজন ॥ কুষ্টিয়ার শিলাইদহে শুরু হয়েছে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা। সেখান থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, এবারের আয়োজনের মূল প্রতিপাদ্য ‘মনেরে আজ কহ যে/ভালো মন্দ যাহাই আসুক/ সত্যেরে লও সহজে।’ বুধবার সকালে কুঠিবাড়ি চত্বরে অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধন করেন কুষ্টিয়া ১ আসনের সংসদ সদস্য আ.কা.ম. সরওয়ার জাহান বাদশা। জেলা প্রশাসক মোঃ আসলাম হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন ওয়াহিদা মুসাররত অনীতা। এতে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. সরওয়ার মুর্শেদ। শাহজাদপুরের আয়োজন ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে রবীন্দ্র কাছারি বাড়িতে চলছে দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা। কবিগুরুর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এখানে সুদৃশ্য তোরণ নির্মাণ করা হয়েছে। আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয়েছে পুরো কাছারি বাড়ি। বুধবার প্রথম দিনের অনুষ্ঠানে গানে গানে কবিগুরুকে প্রণীত জানান উপজেলা শিল্পকলা একাডেমির শিল্পীরা। কবিতার ভাষায় শ্রদ্ধা নিবেদন করেন আবৃত্তি সংগঠন বর্ণমালা, অক্ষর ও উচ্চারণের সদস্যরা। এর আগে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। পতিসরের আয়োজন ॥ নওগাঁ থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা বিশ্বজিৎ মনি জানান, জেলার পতিসরে অবস্থিত কবিগুরুর কাছারি বাড়িতে বুধবার ছিল রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠানমালা। নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলার মনিয়ারী ইউনিয়নের কালীগ্রাম পরগণায় ছিল রবীন্দ্রনাথের জমিদারি। পতিসরের কাছারি বাড়ি আজও সে স্মৃতি ধরে রেখেছে। কবির জন্মোৎসব ঘিরে এখানে রবীন্দ্র ভক্তদের ঢল নামে। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় এবং নওগাঁ জেলা প্রশাসনের আয়োজনে বিভিন্ন কর্মসূচীর পালন করা হয়। দেবেন্দ্র মঞ্চে আলোচনা করেন কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক মলয় চন্দন মুখোপাধ্যায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আলমগীর, রবীন্দ্র সংগ্রাহক মতিউর রহমান মামুন প্রমুখ। বিকেলে জেলা শিল্পকলা একাডেমি, রাণীনগর ও আত্রাই উপজেলা শিল্পকলা একাডেমির নিয়মিত শিল্পীরা বিভিন্ন পরিবেশনার মধ্য দিয়ে কবিগুরুকে শ্রদ্ধা জানান। দক্ষিণডিহির আয়োজন ॥ জনকণ্ঠের খুলনা অফিস জানায়, শহরের ফুলতলা উপজেলার দক্ষিণডিহি রবীন্দ্র কমপ্লেক্সে খুলনা জেলা প্রশাসনের আয়োজনে বুধবার নানা কর্মসূচী পালন করা হয়। সকালে মৃণালিনী মঞ্চে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বসেছে মেলাও। এছাড়া রূপসা উপজেলার পিঠাভোগে রবীন্দ্র স্মৃতি সংগ্রহশালায় উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বরে রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠান আয়োজন করে আবৃত্তি সংগঠন তিতাস সাহিত্য সংস্কৃতি পরিষদ। রংপুরে জেলা শিশু একাডেমির উদ্যোগে রবীন্দ্রনাথের জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন করা হয়। খাগড়াছড়ির হাসপাতাল সড়কে অবস্থিত ঝর্ণাধারা কচিকাঁচা মেলা মিলনায়তনে কবিগুরুর জন্মদিনের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়।
×