ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্যাকেটজাত ৩১ দুধের আঠারোটিতেই পাওয়া গেছে কিডনি যকৃৎসহ নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার উপাদান ;###;দুধে এ্যান্টিবায়োটিক, দইয়ে মিলেছে সীসা ;###;হাইকোর্টে প্রতিবেদন দাখিল

দুধেও রাসায়নিক ॥ ৯৬ নমুনার তিরানব্বইতেই সীসা

প্রকাশিত: ০৯:৩৭, ৯ মে ২০১৯

দুধেও রাসায়নিক ॥ ৯৬ নমুনার তিরানব্বইতেই সীসা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ গরুর কাঁচা দুধে এ্যান্টিবায়োটিক, দইয়ে ক্ষতিকর সীসা ও গোখাদ্যেও মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকসহ ক্ষতিকর নানা রাসায়নিক পাওয়া গেছে। মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক এসব রাসায়নিকে কিডনি, যকৃৎসহ নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বাজারের ৯৬ তরল দুধের নমুনা পরীক্ষা করে তিরানব্বইটিতেই সীসাসহ মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর উপাদান পেয়েছে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। এছাড়া প্যাকেটজাত ৩১ দুধের আঠারোটিতে ক্ষতিকর উপাদান এবং কিছু কিছু দুধের নমুনায় টেট্রাসাইক্লিন ও সিপ্রোফ্লক্সাসিনের মতো এ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। বুধবার বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কে এম হাফিজুল আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চে দাখিল করা প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। এদিকে আদালত ক্ষতিকর উপাদানযুক্ত পণ্য ও প্রতিষ্ঠানের সুনির্দিষ্ট নাম না থাকায় সেগুলো উল্লেখ করে এর সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছে। শুনানির জন্য পরবর্তী দিন নির্ধারণ করা হয়েছে ১৫ মে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মোহাম্মদ ফরিদুল ইসলাম, রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক ও সহকারী এ্যাটর্নি জেনারেল হেলেনা বেগম চায়না। দুদকের পক্ষের আইনজীবী সৈয়দ মামুন মাহবুবের অসুস্থতার কারণে আইনজীবী খুরশিদ আলম খান এক সপ্তাহ সময়ের আবেদন করলে আদালত তা মঞ্জুর করে। বিএসটিআই মহাপরিচালকের পক্ষেও বুধবার ওকালতনামা দাখিল করা হয়। আদালত ১১ ফেব্রুয়ারি তিনটি পত্রিকায় দুধ-দইয়ে এ্যান্টিবায়োটিক অনুজীব, কীটনাশক, সীসা, দুধে কীটনাশক, গরুর দুধেও বিষের ভয়, শিরোনামে রিপোর্টের ভিত্তিতে স্বপ্রণোদিত হয়ে রুল দিয়েছিল। এবং তিন মাসের মধ্যে কমিটি গঠন করে ব্যবস্থা নেয়ার আদেশ দিয়েছিল। বুধবার আদালতে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের পক্ষে জানানো হয় তারা নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য মাহবুব কবিরকে আহ্বায়ক করে ১৬ সদস্যের কমিটি গঠন করে কার্যক্রম শুরু করেছে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের হয়ে আদালতে এই প্রতিবেদন দাখিল করেন আইনজীবী ফরিদুল আলম। ১৬ সদস্যের কমিটির ওই কর্ম পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে (ক) চার সপ্তাহের (গত ২৪ এপ্রিল থেকে আগামী ২২ মে) মধ্যে কাঁচা তরল ও পাস্তুরিত দুধের নমুনা সংগ্রহ, গবেষণাগারে পরীক্ষা ও ফলাফল পর্যালোচনা। (খ) পশুখাদ্যের নমুনা সংগ্রহ এবং গবেষণাগারে পরীক্ষা ও ফলাফল পর্যালোচনা (২৩ মে থেকে ২২ জুনের মধ্যে)। (গ) ২৩ মে থেকে ২২ জুলাইয়ের মধ্যে প্রাথমিক উৎপাদন ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ, ফলাফলের তুলনামূলক বিশ্লেষণ এবং যথাযথ সুপারিশ প্রণয়ন। কমিটির আহ্বায়ক স্বাক্ষরিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। কমিটির সদস্যদের নামের তালিকাও আদালতে দাখিল করা হয়। এছাড়া, ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরিতে করা পরীক্ষা নিয়ে তৈরি বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের আরেকটি প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে। (১) কাঁচা তরল দুধের ৯৬ নমুনা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তার মধ্যে অনুজৈবিক বিশ্লেষণ রিপোর্ট অনুযায়ী, ৯৩ নমুনাতে টিপিসি ও ক্ষতিকর মাত্রায় কলিফর্ম বিদ্যমান এবং একটি নমুনায় সালমোনেলা পাওয়া গেছে। রাসায়নিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ৫ নমুনাতে সীসা, তিনটিতে আফলাটক্সিন, দশটিতে টেট্রাসাইক্লিন, একটিতে সিপ্রোফ্লক্সাসিন এবং নয়টিতে পেস্টিসাইড (এ্যান্ডোসালফান) ক্ষতিকর মাত্রায় পাওয়া যায়। (২) প্যাকেটজাত তরল দুধের ৩১ নমুনার (দেশী ২১ এবং আমদানি করা ১০) মধ্যে ১৭ দেশী দুধের নমুনাতে টিপিসি ও কলিফর্ম কাউন্ট, চৌদ্দটিতে মোল্ডস এবং আমদানি করা তরল দুধের একটি নমুনাতে কাউন্ট ক্ষতিকর মাত্রায় কলিফর্ম বিদ্যমান। রাসায়নিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশী দুধের একটি নমুনাতে আফলাটক্সিন, ছয়টিতে টেট্রাসাইক্লিন এবং আমদানি দুধের তিনটিতে টেট্রাসাইক্লিন ক্ষতিকর মাত্রায় রয়েছে। (৩) দইয়ের ৩৩ নমুনার সতেরোটিতে টিপিসি, ছয়টিতে পলিফর্ম কাউন্ট, সতেরোটিতে ইস্ট/ মোল্ড এবং একটিতে সীসা ক্ষতিকর মাত্রায় বিদ্যমান। (৪) পশুখাদ্যের ত্রিশটির মধ্যে ষোলোটিতে ক্রোমিয়াম, চারটিতে আফলাটক্সিন, ২২ নমুনায় টেট্রাসাইক্লিন, ২৬টিতে এনরোফ্লক্সাসিন, ত্রিশটিতে সিফরোফ্লক্সাসিন এবং দুটিতে পেস্টিসাইড (এন্ডসালফান) ক্ষতিকর মাত্রায় পাওয়া গেছে। পত্রিকার ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দেশে পুষ্টির অন্যতম প্রধান জোগান হিসেবে বিবেচিত গরুর দুধ বা দুগ্ধজাত খাদ্যে এবার মিলেছে শরীরের জন্য ক্ষতিকর নানা উপাদান। ১০ ফেব্রুয়ারি এ তথ্য প্রকাশ পেয়েছে সরকারের জাতীয় নিরাপদ খাদ্য গবেষণাগারের প্রতিবেদনে। জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সভাকক্ষে প্রতিবেদনটি আনুষ্ঠানিক প্রকাশ করা হয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীসহ অন্য কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে। জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, গরুর খোলা দুধে অনুজীবের সহনীয় মাত্রা সর্বোচ্চ ৪ থাকার কথা থাকলেও পাওয়া গেছে ৭.৬৬ পর্যন্ত । পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনটি হাইকোর্টের নজরে আনেন আইনজীবী মামুন মাহবুব। এর পর আদালত দুধে সীসা মিশ্রণকারীদের শাস্তির আওতায় আনার ব্যর্থতা কেন বেআইনী হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছিল। এছাড়াও রুলে দুগ্ধজাত খাবারে ভেজাল প্রতিরোধে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা কেন বেআইনী ও অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। পাশাপাশি খাদ্যে ভেজালের সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে সর্বোচ্চ শাস্তির (মৃত্যুদন্ড) কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। পাশাপাশি আদালত ঢাকাসহ সারাদেশের বাজারে কোন্ কোন্ কোম্পানির দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্যপণ্যে কী পরিমাণ ব্যাকটেরিয়া, কীটনাশক এবং সীসা মেশানো রয়েছে, তা নিরূপণ করে একটি জরিপ প্রতিবেদন তৈরির নির্দেশ দেয়।
×