ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মাদুরো-গুয়েইদোর দ্বন্দ্বে অচল ভেনিজুয়েলা

প্রকাশিত: ১২:৪৩, ৮ মে ২০১৯

মাদুরো-গুয়েইদোর দ্বন্দ্বে  অচল ভেনিজুয়েলা

ভেনিজুয়েলার বিরোধী নেতা হুয়ান গুয়েইদো ৩০ এপ্রিল নিকোলাস মাদুরোর সরকারের বিরুদ্ধে জনগণকে রাস্তায় নেমে আসার আহ্বান জানান। তার এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে রাজধানী কারাকাসের রাজপথে হাজার মানুষের ঢল নামে। অনেক জায়গায় নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে তাদের সংঘর্ষও হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার ওই আহ্বান সফল গণঅভ্যুত্থানের রূপ নিতে পারেনি। ধারণা করা হয়েছিল মাদুরোর শাসনের শেষ অধ্যায়টি শুরু হয়ে গেছে। তার বিরুদ্ধে এক বছরের বেশি সময় ধরে বিরোধীরা সক্রিয়। এ সময়ের মধ্যে তারা শক্তি সঞ্চয় করেছে। ৩৫ বছর বয়সী গুয়েইদো চলতি বছর ২৩ জানুয়ারি নিজেকে ভেনিজুয়েলার অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা দেন। যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের অনেকগুলো দেশ তার নেতৃত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এরপর তিন মাস পেরিয়ে গেলেও ক্ষমতার দৃশ্যপটে কোন পরিবর্তন দেখা যায়নি। ৩০ এপ্রিল তিনি যে অভ্যুত্থানের ডাক দেন সেটি যেমন ছিল তার এ পর্যন্ত সবচেয়ে সাহসী সিদ্ধান্ত তেমনি তা ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। যদিও তার এ উদ্যোগ সফল হয়নি, তবে বিশ্লেষকরা বলছেন বিরোধীরা একেবারে পরাজিতও হয়নি। চার মাস ধরে রাজনৈতিক অচলাবস্থা চলছে। মাদুরো ও গুয়েইদো উভয়পক্ষে শক্তিমত্তা প্রায় সমান সমান। যে কারণে কোন পক্ষই খুব বেশি সুবিধা করতে পারছে না। নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। রয়েছে কিউবার মতো প্রতিবেশী দেশও। ভেনিজুয়েলার ন্যাশনাল এ্যাসেম্বলির নিয়ন্ত্রণ বিরোধীদের হাতে। গুয়েইদো ৩০ এপ্রিল কারাকাসের একটি সামরিক ঘাঁটির পাশে দাঁড়িয়ে মাদুরোকে উৎখাত করার জন্য সৈন্যদের ডাক দেন। তিনি একইসঙ্গে জনতাকেও রাস্তায় নেমে আসার আহ্বান জানান। আগেই বলা হয়েছে তার এ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। সেনাবাহিনী প্রধান আবারও মাদুরোর প্রতি তার আনুগত্যের কথা জানান। সেনা জনতা সংঘর্ষে চারজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। সেনাবাহিনীর ছোট একটি কন্টিনজেন্ট গুয়েইদোর বাহিনীর প্রতি একাত্মতা জানালেও সবমিলিয়ে পরিস্থিতি অনুকূলে আসেনি। মে মাসের প্রথম সপ্তাহেই দেখা গেল কারাকাসের রাজপথগুলো শান্ত হয়ে এসেছে। ভেনিজুয়েলার সেনাবাহিনী গত দুই দশক ধরে ব্যাপকভাবে অস্ত্র ও সরঞ্জামাদিতে সজ্জিত হয়েছে। পশ্চিম গোলার্ধে যে কয়টি দেশ প্রতিরক্ষা শক্তিতে এগিয়ে তার মধ্যে ভেনিজুয়েলা অন্যতম। সরকার ও বিরোধীদের দ্বন্দ্বের জেরে দেশটি কোন বিশৃঙ্খলার পাঁকে হারিয়ে গেলে সামরিক অস্ত্রভা-ার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। সেটি হলে পুরো আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা অনিশ্চিয়তার কবলে পড়বে। দেশটিতে রাশিয়া ও কিউবার সরাসরি স্বার্থ রয়েছে। কারণ এটি ঐতিহাসিকভাবে একই ব্লকের অংশ। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র এখনও দেশটির বিষয়ে কোন পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে উঠতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই ভেনিজুয়েলার তেল শিল্প ও মাদুরো সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে। ভেনিজুয়েলার অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই নাজুক। গত কয়েক বছরে এক দশমাংশ মানুষ দেশ ছেড়েছে। এটি মধ্য আমেরিকান অভিবাসী সঙ্কটকে আরও তীব্রতর করেছে। ভেনিজুয়েলার বিরুদ্ধে তেল নিষেধাজ্ঞাকেই যুক্তরাষ্ট্র এখনও পর্যন্ত কার্যকর উপায় করছে। যদিও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের কেউ কেউ দেশটিতে সামরিক হস্তক্ষেপের কথাও বলেছেন, তবে সে সম্ভাবনা খুবই কম। বুধবার ফক্স বিজনেস নেটওয়ার্ককে দেয়া এক সাক্ষাতকারে ট্রাম্প বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র এখনই ভেনিজুয়েলায় সামরিক হস্তক্ষেপের কথা বিবেচনা করছে না। তিনি বলেন, ‘আমাদের সামনে এখনও অনেক বিকল্প খোলা আছে।’ মধ্যপ্রাচ্য ছাড়া যে কয়টি দেশে খনিজ তেলের বিশাল মজুদ আছে ভেনিজুয়েলা তার অন্যতম। তেলের বদৌলতে ১৯৬০ এর দশক থেকেই দেশটির অর্থনীতি মোটামুটি সচ্ছল ছিল। তখন থেকে পশ্চিমা বৃহৎ তেল কোম্পানিগুলো দেশটির তেল খাত নিয়ন্ত্রণ করছিল। বিশ্বের মোট উত্তোলিত অশোধিত তেলের ১০ শতাংশ সরববরাহ করে এসেছে ভেনিজুয়েলা। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকায় ৭০ এবং ৮০ এর দশকে দেশটি অর্থনৈতিকভাবে আরও এগিয়ে যায়। বলা যায়, লাতিন আমেরিকার জন্য হয়ে উঠেছিল একটি মডেল। সম্প্রতি দেশটির তেল রাজস্ব নাটকীয়ভাবে কমে যায়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় সরকারের অব্যবস্থাপনা। ১৯৭৬ সালে দেশটির তেল খাত জাতীয়করণ হয়। ১৯৯০-এর দশকে শেভরন এবং কনকো ফিলিপসের মতো কোম্পানিগুলো দেশটিতে আবার ফিরে যায়। ১৯৯৮ সালে সেখানে তেলের দর আবারও পতন ঘটে। মুদ্রাস্ফীতির দেশটির মুদ্রার এত অবমূল্যায়ন ঘটে যে সেটা দিয়ে আর কিছু কেনাকাটা করা যায় না। দোকানে ওষুধ বা খাবার কিছুই নেই। ইকোনমিস্ট বলছে, ২০১৭ সালের এক জরিপে দেখা যায়, দেশটিতে ১৮-২৯ বছর বয়সী জনসংখ্যার অর্ধেক ছেড়ে চলে যেতে চান জন্মভূমি। পিছিয়ে নেই মধ্যবিত্ত শ্রেণীও, তাদের ৫৫ শতাংশ ছাড়তে চান স্বদেশ। কারণ হিসেবে দেশের অর্থনীতিকেই দুষছেন দেশ ছাড়তে চাওয়া মানুষের তিন ভাগের দুই ভাগ।
×