ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এরাবিয়ান হর্স কোহিনুর রহমান

প্রকাশিত: ১২:৪০, ৮ মে ২০১৯

এরাবিয়ান হর্স কোহিনুর রহমান

পাবনার বিরুদ্ধে রংপুর জেলা দলের ৩-০ গোলে জয়লাভ। সালটা হবে হয়ত ১৯৭৪। খেলা শেষে স্কুল কলেজ আর রেস্টুরেন্টে আলোচনা একটাই, ছেলেটা দারুণ খেলেছে। খেলোয়াড়টির নাম সবার জানা না থাকলেও তখন পরিচিতি বহন করেছিল ‘লাল প্যান্ট ওয়ালা’ খেলোয়াড় হিসেবে। রংপুর জেলা দলের হয়ে খেলেছিলেন তিনি। পরনে ছিল লাল প্যান্ট। দুর্দান্ত গতি, দারুণ ছন্দ, স্কিল আর শূটিং পাওয়ার দিয়ে যিনি ফুটবল সমর্থকদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন তিনি কোহিনুর রহমান। জন্ম মঙ্গাপীড়িত এলাকা কুড়িগ্রামে ১৯৫৯ সালের ১১ মার্চ। ১৪ ভাই-বোনের সংসারে তার অবস্থান চতুর্থ। বাবা-চাচাসহ পরিবারের সবাই খেলাধুলার সঙ্গে জড়িত। মঙ্গাপীড়িত এলাকা কুড়িগ্রামে যেন আশার আলো এই কোহিনুর পরিবার। কোহিনুর পরিবার যেন খেলাধুলা দিয়েই মঙ্গাকে জয় করেছিলেন । সেই সূত্রে পিতা-মাতার চতুর্থ ছেলে কোহিনুরের খেলার প্রতি ঝোঁক থাকাটা স্বাভাবিক। বড় ভাই মুক্তিযোদ্ধা আমিনুর রহমানের অনুপ্রেরণাতে ফুটবলের প্রতি আসক্তিটা যেন বেড়ে যায় । বাড়ির সামনে গওহর পার্ক মাঠ। সেই মাঠেই ফুটবল নিয়ে চলত সকাল বিকেল অনুশীলন কুড়িগ্রাম পুরন শহরের স্কুল রিভার ভিউ। মূলত এই রিভার ভিউ স্কুল থেকেই ফুটবলের হাতে খড়ি কোহিনুরের। স্কুল ফুটবল থেকেই কোহিনুর ফুটবল কারিশমা দেখাতে থাকেন। দ্রুত গতিতে বল নিয়ে ছুটে বিপক্ষ দলের রক্ষন ভাগকে তছনছ করে বল জড়াতেন জালে। ফুটবল বোদ্ধারা তখন থেকেই ধরে নিয়েছিলেন কোহিনুর বড় হয়ে মাঠ কাঁপাবেন। ১৯৭৪ সালে ঢাকায় বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসে ঢাকা স্টেডিয়ামে ফুটবল খেলা দেখতে ছুটে যান। সেখানেই খবর পান পরের দিন সাধারন বীমা দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল দলের বাছায় অনুশীলন। বাছায় অনুশীলনে পায়ে বুট দরকার। নিজের কাছে বুট কেনার মতো অর্থ নেই। বোনের টানাপোড়েনের সংসারে তখন বুট কেনাটা একটু কস্টেরই ছিল। তথাপি বাছায় অনুশীলনের জন্য কোহিনুরের বোন খুব কষ্ট করে এক জোড়া স্পাইকবিহীন বুট জোগাড় করে দেন। সেই বুট পায়ে দিয়ে যোগদান করেন সাধারণ বীমা দ্বিতীয় বিভাগ দলের বাছাই অনুশীলনে। মাঠে বল নিয়ে দ্রুত গতিতে ছোটাসহ তার ডজ দেখে সাধারণ বীমার অফিসিয়াল, কোচ অবাক। অবশেষে এক নম্বর বাছাই হিসেবে কোহিনুরকে নির্বাচিত করেন তারা। খেলা শুরু করেন বীমার জার্সি গায়ে ১৯৭৫ সালে। সেই থেকেই ঢাকা ফুটবলের যাত্রা শুরু কোহিনুর রহমানের। পরিবার নিয়ে ক্যালিফর্নিয়ায় অবস্থান করা কোহিনুর রহমানের সঙ্গে মুঠোফোনে ফুটবল নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আলোচনায় উঠে এসেছে তার খেলোয়াড়ি জীবনের কথা, উঠে এসেছে বাংলাদেশ ফুটবল নিয়ে অনেক কথা। বাংলাদেশ ফুটবলের এমন চেহারা কেন সেটা জানতে চাইলে কোহিনুর জানান ভুল প্ল্যানিং। এখন ফুটবল হয়ে গেছে ঢাকাকেন্দ্রিক। ঢাকা ছাড়া কোথাও ফুটবল খেলা হয় না। অথচ ঢাকার বাইরে ফুটবলের জনপ্রিয়তা সব চাইতে বেশি। ঢাকার বাইরে যেদিন ফুটবলকে ছড়িয়ে দেয়া যাবে সেদিন বাংলাদেশ ফুটবল আবারও চাঙ্গা হয়ে উঠবে। তিনি উল্লেখ করেন জেলা এবং স্কুল/কলেজভিত্তিক ফুটবল প্রতিবছর চালু রাখা প্রয়োজন। গোড়া থেকে যদি ফুটবলার না তৈরি হয় তবে গলদটা গোড়তেই থেকে যাবে। আমাদের দেশে এই দশা। হঠাৎ হঠাৎ টুর্নামেন্ট করে ফুটবলের উন্নতি করা যাবে না। কোহিনুর জানান ফুটবলের জোয়ার এবং উন্নতি করতে হলে অবশ্যই জেলা লীগ প্রতিবছর চালু করা অত্যন্ত জরুরী। কোহিনুর রহমান ১৯৭৫ সালে দ্বিতীয় বিভাগ দল সাধারণ বীমার হয়ে খেলা শুরু করেন। পরের বছর যোগদেন প্রথম বিভাগের দিল শান্তিবগর ক্লাবে। শান্তিনগর ক্লাবের হয়ে ১৯৭৬ সালে আগাখান গোল্ড কাপে থাইল্যান্ডের রাজবিথী ক্লাবের বিপক্ষে দ্রুতগতিতে দারুণ এক গোল করেন। দ্রুট গতির কারণে রাজবিথীর গোল রক্ষকের সঙ্গে সংঘর্ষে গালরক্ষকের দাঁত ভেঙ্গে যায়। সমর্থকরা এই দ্রুত গতির কারণে তার নাম দেন ‘এরাবিয়ান হর্স।’ মাঠে অনেক সময় মাথা গরম করে খেলতেন। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে সঠিক সিদ্ধান্তের হেরফের হলে তিনি উত্তেজিত হয়ে যেতেন। এই কারণে মোহামেডান সমর্থকরা ভালবেসে তাকে ‘হটপেটিস’ বলে সম্বোধন করতেন। মাঠে যাই ছিলেন মাঠের বাইরে তিনি একজন খুবই সাধারণ মানুষ। পরের বছর ১৯৭৭ সালে খেলেন তৎকালীন ঢাকা ফুটবলের আরেক নামী দল ওয়াপদার হয়ে। সে বছর ওয়াপদার হয়ে আগাখান ফুটবলে তিনি অনেক প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন। ১৯৭৭ সালে ঢাকা ফুটবল লীগে তার পা-তে আট গোল এসেছিল যার মধ্যে দিলকুশার বিরুদ্ধে একটি ম্যাচে হ্যাটট্রিক করেছিলেন। সে বছরেই শেরে বাংলা জাতীয় ফুটবল টুর্নামেন্টে সেমিফাইনালে রংপুরের হয়ে টাঙ্গাইলের বিরুদ্ধে গোল করে রংপুরকে ফাইনালে নিয়ে যান। ফাইনালে বরিশালের সঙ্গে ২-১ গোলে হেরে যায় রংপুর। তবে সমর্থকরা কোহিনুরের খেলা দেখে বুঝতে পেরেছিলেন তিনি ঢাকা মাঠ মাতাবেন। ১৯৭৯ সালে কোহিনুর যোগ দেন ঐতিহ্যবাহী সাদা-কালোখ্যাত ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে। জার্সি নম্ব^র ১১। সে লীগে প্রথম ম্যাচেই ধানম-ির সঙ্গে খেলায় প্রথম একটা গোল করেই সমর্থকদের জানান দেন। ১৯৮০ সালে মোহামেডানে যোগ দেন লেফট উইঙ্গার আব্দুল গাফ্ফার। রাইট উইং কোহিনুর আর লেফট উইং গাফফার। মোহামেডান যেন অপ্রতিরোধ্য একটা দলে পরিনত হয়ে ওঠে। তা ছাড়া এই দুই জনের জুটি ছিল ঢাকার মাঠে সেরা। এই গাফ্ফার যখন ১৯৮৩ সালে মোহামেডান ছেড়ে আবাহনীতে যোগ দেন তখন মোহামেডান ক্লাব হতবাক হয়ে যায়। কোহিনুর সেদিন তার আবেগ ধরে রাখতে পারেনি। গাফ্ফার চলে যাবার সময় জানালার গ্রীল ধরে কোহিনুরের কান্না আজও গাফ্ফারের কানে বাজে। এ প্রসঙ্গে গাফ্ফার আর কোহিনুরের মন্তব্য একই রকম। সে সময় ক্লাবগুলোর সব খেলোয়াড়রা ছিলেন এক পরিবারের মতো। আত্মীয়ের বন্ধনে যেন আবদ্ধ হয়ে থাকতেন সবাই। ফুটবলের স্মরণীয় মুহূর্তের বিষয়ে কোহিনুর জানান ১৯৮২ সালে মোহামেডানের চ্যাম্পিয়নের মুহূর্তটি তার জীবনের সব চাইতে স্মরণীয় হয়ে আছে। আনন্দ এবং বেদনা দুই-ই আছে। সে বছর সালাম মুর্শেদির রেকর্ড ২৭ গোলের অবদান বাদল গাফ্ফারসহ অন্য খেলোয়াড়দের সঙ্গে কোহিনুরের নাম উল্লখযোগ্য। কোহিনুর উল্লেখ করেন লীগের শেষ ম্যাচ মোহামেডান আবাহনী। তার এক গোলে মোহামেডান এগিয়ে। খেলার দ্বিতিয়ার্ধের উনত্রিশ মিনিটে আবাহনীর আনোয়ারের শট মোহামেডানের গোলরক্ষক মোহাম্মদ মহসিন ফ্লাই করে বল গ্রিব করেন। রেফারি গোল কিকের বাঁশি বাজান কিন্তু আবাহনীর খেলোয়াড়রা সেটা গোল দাবি করেন। তাদের বক্তব্য ছিল বল ক্রশবার ক্রশ করেছে। এই নিয়ে হাঙ্গামা শুরু হলে গ্যালারিতে টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করা হয়। সমর্থক, পুলিশ এবং খেলোয়াড়দের মাঝে রক্তক্ষয়ী সংঘর্শ বাধে। অবশেষে আবাহনীর চারজন খেলোয়াড়কে জেল হাজতে দেয়া হয়। এইটা ছিল খুবই দুঃখজনক। কোহিনুর উল্লেখ করেন এ ঘটনায় মোহামেডানের সকল খেলোয়াড় হতভম্ব হয়ে যায়। ওই ম্যাচ পন্ড হলে মোহামেডানকে ২-০ গোলে জয়ী ঘোষণা করা হয়। আরও একটি ম্যাচের কথা কোহিনুর উল্লেখ করেন। সেটা ১৯৮০ সালে রংপুর ফুটবল লীগের খেলা। নবাবগঞ্জ স্পোর্টিং ক্লাবের পক্ষে জয়সূচক গোল করে ক্লাবকে চ্যাম্পিয়ন করান কোহিনুর। সেই স্মৃতি আজো উজ্জ্বল হয়ে আছে তার কাছে। কুড়িগ্রামের ফুটবল সৈনিক জালাল হোসেন লাইজু জানান, কোহিনুর ভাইয়ের খেলা এবং তার করা অনেক গোল দেখেছি বিশেষ করে সম্ভবত ১৯৮২ সালে ওমানের সাথে বাংলাদেশ দলের একটা প্রদর্শনী ম্যাচের কথা আজও তার মনে পড়ে। সে ম্যাচ ৪-৪ গোলে ড্র হয়। কোহিনুরের একটা দুর্দান্ত গোল এখনও চোখে ভাসে। ১৯৮২ সালে ভারতের আশিস জাব্বার ফুটবল টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়। ওই সফরে কোহিনুর দারুণ খেলেন। সাফল্যের কথা বলতে গেলে মোহামেডানের হয়ে ফেডারেশন কাপ চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্য ছিলেন ৮০-৮২ সালে। লীগ চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্য ছিলে ৮০ এবং ৮২ সালে। ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ সবুজ জাতীয় দলের সদস্য ছিলেন এবং সে বছরেই জাতীয় দলের হয়ে কায়েদে আজম ট্রফি খেলতে পাকিস্তান সফর করেন। তা ছাড়া ১৯৮২ সালে দিল্লি এশিয়াডে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৮৩ সালে মারাত্মক ইনজুরিতে পড়েন কোহিনুর । তারপর থেকেই তার ফুটবল ক্যারিয়ারে ছন্দপতন শুরু হয় । ৮৫ সাল পর্যন্ত ঢাকা ফুটলের সঙ্গে জড়িত ছিলেন । ১৯৮৬ সালে শেরেবাংলা কাপ জাতীয় ফুটবল দলে কুড়িগ্রাম জেলা দলকে সেমিফাইনাল পর্যন্ত নিয়ে আসার পেছনে কোহিনুর বিশেষ ভূমিকা পালন করেন এবং সে বছরেই ফুটবল থেকে অবসর গ্রহণ করে পরিবার পরিজনসহ স্থায়ীভাবে আমেরিকা পাড়ি জমান । দেশের বাইরে থাকলেও বাংলাদেশের ফুটবলের খবর ঠিকই রাখেন। এবারের লীগে ঢাকা মোহামেডান প্রথম পর্বের লীগে ১২ ম্যাচে মাত্র একটি জয় আর তিনটি ড্র করে মাত্র ৬ পয়েন্ট লাভ করেছে , যা মোহামেডানের এক সময়ের খেলোয়াড় হিসেবে খুবই লজ্জিত মনে করেন। পত্রপত্রিকায় যখন পড়েন মোহামেডান আবাহনী ম্যাচে মাত্র হাজারখানেক সমর্থক তখন বুঝতে আর বাকি থাকে না বাংলাদেশ ফুটবলের অবস্থান কোথায়। খেলার বাইরে তিনি খুবই সাধারণ একজন মানুষ। সবার সঙ্গেই তার খুব ভাল সম্পর্ক। ফুটবলার ছাড়াও ক্রিকেটারদের সঙ্গে কোহিনুরের সখ্য অনেক। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়াতে গেলে ফুটবলার এবং ক্রিকেটার সকলেই কোহিনুরের অতিথিয়েতা গ্রহণ করেন। কোহিনুর আগ্রহের সঙ্গে সবাইকে তার বাস ভবনে আমন্ত্রণ জানান। ফুটবল নিয়ে কুড়িগ্রামে যে জোয়ার শুরু হয়েছে সে জোয়ারকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কোহিনুর বদ্ধপরিকর। তিনি চান বাংলাদেশ ফুটবলের বিপ্লব শুরু হউক কুড়িগ্রাম থেকেই। কুড়িগ্রামকে বাংলাদেশে নতুনভাবে পরিচয় করিয়ে দিতে চান ফুটবলের মাধ্যমেই। ফুটবলের জন্য যা করা প্রয়োজন তা তিনি করবেন। তিনি আশা করেন এভাবে যদি বাংলাদেশের সব জেলাতে কারও মাধ্যমে ফুটবলের জোয়ার শুরু হয় তবে নিশ্চিত বাংলাদেশে ফুটবল নতুন করে জেগে উঠবে খুব দ্রুতই। কোহিনুর রহমান স্কুল থেকে খেলোয়াড়ি জীবন পর্যন্ত বহু পুরস্কার করায়ত্ত করেছেন। অর্থ, জস আর খ্যাতির আজ কোনটার কোন কমতি নেই। ফুটবলের অনেক স্মৃতি, অনেক সাফল্যে আবেগে আপ্লুত হয়েছেন কিন্তু ফুটবল জীবন শুরুতেই কষ্ট করে বোনের স্পাইক বিহীন বুটের যোগাড় করে দেয়ার সেই মুহূর্তের কথা আজও ভুলতে পারেন না। মনে হলে মুহূর্তেই দু’চোখে আনন্দাশ্রু জমা হয়ে যায়। এ পৃথিবীতে এর চাইতে বড় পুরস্কার আর আবেগময় স্মৃতি কি হতে পারে।
×