ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রবীন্দ্র মানসে বাউল দর্শন

প্রকাশিত: ১২:০২, ৮ মে ২০১৯

রবীন্দ্র মানসে বাউল দর্শন

শুধু বাংলা নয়, বিশ্বসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গীত, কবিতা, গল্প উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক প্রভৃতি থেকে কালোত্তীর্ণকালে নতুন নতুন দর্শন আবিষ্কৃত হচ্ছে। এ যুগেও কবিতা, সাহিত্য, গান, রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি প্রভৃতি ভাবনার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ যেন বাঙালীর দৃশ্যমান। গীতাঞ্জলিসহ রবীন্দ্র কাব্য-সাহিত্যের রশ্মিময় স্তরগুলোর অধিকাংশ সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশের নিভৃত জনপদে অবস্থানকালে। এর মধ্যে বাউল দর্শন তাঁর সৃষ্ট লোকায়ত শিল্প-সাহিত্যকর্মে বিশাল একটি জগত সৃষ্টি হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীত, কাব্য-সাহিত্যের অনেকাংশ বিশেষ করে গীতাঞ্জলির অধিকাংশ গানে তাঁর অধরা জীবন দেবতার পরশ পরতে পরতে মিশে আছে। বাউল দর্শন ও বাউল ভাবনার অবয়বগুলো তাঁর বিভিন্ন প্রবন্ধ এবং গানের সুরের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। লালন, গগন, সর্বাক্ষেপী বষ্টোমীসহ বহু বাউল সাধকের ও অন্যান্য লোকজ গানের সুর রবীন্দ্র গানের মধ্যে নিবন্ধিত রয়েছে। শিলাইদহ (কুঠিবাড়ী) পোস্ট অফিসের ডাক হরকরা গগন রবীন্দ্র চেতনায় বেশ সমুজ্জ্বল। গগন হরকরা একজন অতি সাধারণ গ্রাম্য মরমী সঙ্গীত সাধক। তাঁর গাওয়া ‘আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যেরে’ গানটির মধ্যে ‘মনের মানুষ সন্ধানে’র আর্তির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের জীবন দেবতা খোঁজার একটি সাযুজ্য পাওয়া যায়। ওই গানের বাণী ও সুর রবীন্দ্র মানসে বাউল দর্শনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। বর্তমান নগরসংস্কৃতির শিকড় পল্লী জীবনধারার মর্মমূলে গ্রথিত। গ্রামীণ মানুষের দৈনন্দিন চলনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে নদী, নারী, সবুজ বৃক্ষরাজি, মেঠোপথ, বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ, সুখ, দুঃখ, হাসি-কান্না ও সমাজ জীবন। এই বিচিত্র বিষয়ের মধ্যেই বাংলার লোকজ সংস্কৃতি প্রবাহমান। আউল-বাউল, ভাব, অষ্টক, কীর্তন, টপ্পা, জব, জারি-সারি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, ভাসান, গম্ভীরা, মালসি, বারমাসি, মুর্শিদী, মারফতি, গাজীর গীত, বন বিবির গীত, পালা-পুঁথি, মেয়েলি গীত, বিচিত্র ধরনের খেলাধুলা লোক লৌকিকতা প্রভৃতির ভেতর দিয়ে লৌকিক সমাজ জীবনের উন্মেষ ঘটেছে। কবিগুরু, লোকসাহিত্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘গ্রাম্য সাহিত্য বাংলার গ্রামের ছবি, গ্রামের স্মৃতির অপেক্ষা রাখে’। বাঙালী সংস্কৃতি বাউল সুরের সঙ্গীত লোকজ সাহিত্য ও সঙ্গীতের একটি শক্তিশালী ধারা। কয়েক শতক ধরে এই ধারা গ্রাম-বাংলার মানুষের চিত্তবিনোদন ও আধ্যাত্মরসের তৃষ্ণা মিটিয়ে আসছে। সঙ্গীতের মাধ্যমে ভক্তি ও ভাবরস সৃর্ষ্টি করে সাধনমার্গে সিদ্ধিলাভের চেতনায় একটি বিশেষ গোষ্ঠী মরমী এই বাউল ধারার সঙ্গীত লালন করে চলেছেন। বৌদ্ধ সহজিয়া, বৈষ্ণব পদাবলী, ইসলামের সুফিবাদ ও অন্যান্য অনুষঙ্গের সংমিশ্রণে বাউল মতের উদ্ভব হয়েছে বলে প-িতগণের ধারণা। তবে মধ্য যুগে বৈষ্ণব সাহিত্যে চৈতন্যপ্রেম ধারায় ভক্তিগীতি সুধা বাঙালী মানসপটে বাঙালিত্ব, ভাষার স্বাতন্ত্রতা, বাংলাগান ও মরমী ভক্তিধারায় জাগরণ সৃষ্টি করেছিল এ কথা বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলা যায়। বাউলদের বিশ্বাস দেহের মধ্যে বিরাজ করে ‘মনের মানুষ’। যাকে তাঁদের ভাষায় বলা হয় অটল মানুষ, রসের মানুষ, মনমনুয়া, ভাবের মানুষ, অধরা, গোপানবাসী, সাইজী প্রভৃতি। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘মানুষের দেবতা মানুষের মনের মানুষ; জ্ঞানে, কর্মে ভাবে যে পরিমাণে সত্য হই, সেই পরিমাণেই সেই মনের মান্যুষকে পাই- অন্তরে বিকার ঘটিলে সেই আমার আপন মনের মানুষকে মনের মধ্যে দেখতে পাইনে।’ রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য সাধনা ও বর্ণাঢ্যময় কর্মজীবনে বাউল দর্শন ও বাউল তত্ত্বে শুধু মুগ্ধই হননি, তিনি তাঁর লেখা সঙ্গীত, গল্প, কবিতা, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ, অভিভাষণে যেমন বাউলের প্রসঙ্গ এনেছেন, তেমনি তাঁর বেশভূষা ও দেহাবয়বেও বাউলের ছাপ পড়েছে। তাঁর স্ব-যতন আহ্বান, ‘সাহিত্যের ঐকতান সঙ্গীত সভায় একতারা যাহার তারাও সম্মান যেন পায়’ (ঐকতান)। রবীন্দ্রনাথ নবীন বয়সেই বাউলদের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের ‘হারামণি’র আর্শীবাণীতে তিনি বলেছেন, ‘আমার মনে আছে তখন আমার নবীন বয়স, শিলাইদহ অঞ্চলের এক বাউল কলকাতায় একতারা বাজিয়ে গেয়েছেন। ‘কোথায় পাব তারে/আমার মনের মানুষ যেরে/হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশ্যে/দেশ-বিদেশে বেড়াই ঘুরে।’ কথা নিতান্ত সহজ কিন্তু সুরের যোগে এর অর্থ জ্যোতিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রমানসে বাউল চেতনার উদ্বৃতি দিতে গিয়ে সুকুমার সেন বলেছেন, ‘বাউল গানের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় কিশোর বয়স হইতে, একটি আধুনিক বাউল গানের সংকলন গ্রন্থ উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ বাউলের গান প্রবন্ধে (ভারতী-১২৯০) লিখিয়াছিলেন, বাউল গানের সাদাসিধে ভাষা ও সরল গভীর ভাব বাংলা সাহিত্যের অন্যত্র নাই বলিয়া তাঁকে মুগ্ধ করিয়াছিল। তখনও তাঁর কাব্যে আধ্যাত্মিকতার রং ধরে নাই, তবুও রবীন্দ্রনাথ বাউল গানের মধ্যে প্রেম গভীরতা অনুভব করিয়াছিলেন, যাহা আধ্যাত্মিক অর্থেও প্রেম। বাউল গান রবীন্দ্রনাথকে প্রীত করিয়াছিল, কেননা তিনি তাহার মধ্যে নিজের সুরের মিল খুঁজিয়া পাইয়াছিলেন।’ শিলাইদহ, শাহজাদপুর, পতিসরের জমিদারি দেখাশোনার জন্য ঠাকুর পরিবারের রবি কবির বাংলাদেশের এ অঞ্চলে যাওয়া-আসা ও অবস্থান। বৃহত্তর নদীয়া, পাবনা, যশোর জেলা, বাউল বৈষ্ণব, ফকির দরবেশ অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। শত শত বছর পূর্ব থেকে এসব অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বৈষ্ণব-বাউল, দরবেশ ফকিরের আগমণ ও জন্ম হয়েছে বলে প্রমাণ মেলে। পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকের শেষে আদি যশোহর রাজ্যের যবন হরিদাস, গোবিন্দদাস, রায়বসন্ত, কমলনয়ন তর্ক পঞ্চানন, অবিলম্ব সরস্বতী, ডিম ডিম সরস্বতী প্রমুখ বৈষ্ণব, শাক্ত কবি তার্কিকের ভক্তিধারার পদে মুখরিত হয়েছিল এ অঞ্চল। বাংলা ভাষার স্বাতন্ত্র্যের মূলে রয়েছে চর্যা-পদাশ্রয়ি বাংলাগান, বৈষ্ণব পদাবলী, কীর্তন, বাউল, কবি, জারি-সারির প্রভাবে বাংলা ভাষার উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে। এদিক দিয়ে বিবেচনা করলে এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যেÑ ভারত উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশে বাউল গানসহ অন্যান্য ধারার লোকজসঙ্গীত উৎপত্তির সূতিকাগার মধ্যযুগীয় যশোর রাজ্যের বর্তমান সাতক্ষীরা, কালিগঞ্জ, শ্যামনগর, বেদকাশিসহ সংলগ্ন অঞ্চল। শিলাইদহ সংলগ্ন আশপাশের গ্রামগুলো নিভৃত পল্লী হলেও একদা আনন্দঘন পরিবেশ ছিল। রবীন্দ্রনাথের বাউল চেতনা ও বাউল প্রভাবের মূলে রয়েছে শিলাইদহ সংলগ্ন সহজ সরল বাউল, বৈষ্ণব, বৈষ্ণবী, ফকির, কবি শিল্পীদের আচার অনুষ্ঠান। এই অঞ্চলে এক সময় ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় (কায়স্থ), কামার, কুমার, তাঁতি, জেলে সূত্রধর প্রভৃতি হিন্দু ও মুসলমানদের বাস ছিল বলে জানা গেছে। সেকালের খোরশেদ ফকিরের দরগা, গোপিনাথ দেবের মন্দির, রবীন্দ্রনাথের কাছারিবাড়ী, পোস্ট অফিস আজও কালের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। রবীন্দ্রনাথ গগণের ‘আমি কোথায় পাব তারে’ বাউল সুরের এই মরমী গানটির প্রতি দারুণভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। যার ফলে তাঁর স্বদেশী যুগে রচিত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটির সুর গগণের উল্লেখিত গান থেকে গ্রহণ করেছিলেন, যা বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃত। রবীন্দ্রনাথ এই গ্রাম্য অপ-িত সুর সাধক গগন হরকরাকে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বক্তৃতা অভিভাষণের মাধ্যমে শিক্ষিত ও সুধী সমাজে পরিচয় করিয়ে দিয়ে মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন। বাউলগানের ভাষার সরলতা, কাব্যরস, তত্ত্বজ্ঞানের গভীরতা, ভক্তিরসের ধারা রবীন্দ্রমানসে ভাব চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছিল তাই তিনি বাংলার মরমী ভাব-সম্রাট ফকির লালন সাঁই, গগণ হরকরা সর্বাক্ষেপী বোষ্টমী ও অন্যান্য বাউল, বৈষ্ণব ফকিরদের উচ্চসিত প্রশংসা করেছেন লেখনীর মাধ্যমে। এ প্রসঙ্গে একটি উক্তি, ‘রবীন্দ্রনাথের উপর বাউল সঙ্গীতের প্রভাব জীবন্ত ছিল। তিনি বাউলের সুরের গান শুধু রচনা করেন নাই, বাউল গানের কিছু কিছু ইংরেজী অনুবাদ করিয়া তাঁহার ইংরেজী গ্রন্থে স্থান দিয়েছেন’। রবীন্দ্রনাথ বাউল বৈষ্ণবের গানের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে নিজে যেমন এর রস আস্বাদন করেছেন তেমনি অন্যকেও তাঁদের সম্পর্কে সাহিত্য সভায় তুলে ধরার জন্য অনুপ্রাণিত করেছেন। একতারা হাতে বাউলের সাধন, গানের মাধ্যমে মনের মানুষের সন্ধান শিলাইদহ ও তৎসংলগ্ন এলাকার চলমান বাউল বৈষ্ণবের অন্তরঙ্গ সাহচর্য, অতি সাধারণ জীবন যাপন, সাদাসিধে মনোভাব রবীন্দ্র মানসে বাউলতত্ত্ব দর্শন ও সুর সাধনার ক্ষেত্র গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। তাই তো রবীন্দ্রনাথ গ্রামের অবহেলিত ও অপরিচিত কবির প্রতি অকৃত্রিম দরদ মাখানো ভালবাসা নিবেদন করে বলেছেন, ‘সাহিত্যের আনন্দ ভোজে নিজে যা পারিনি দিতে, নিত্য আমি থাকি তারই খোঁজে। যে আছে মাটির কাছাকাছি সে কবির বাণী লাগি কান পেতে আছি’। (ঐকতান) বাউলের সান্নিধ্যলাভ ও বাউল গান সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘শিলাইদহে যখন ছিলাম বাউলদের সঙ্গে আমার সর্বদাই দেখা সাক্ষাৎ ও আলাপ-আলোচনা হতো। আমার অনেক গানে আমি বাউলের সুর গ্রহণ করেছি এবং অনেক গানে অন্য রাগরাগিনীর সঙ্গে আমার জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাউল সুরের মিল ঘটেছে। এর থেকে বোঝা যাবে, বাউলের সুর ও বাণী কোন এক সময়ে আমার মনের মধ্যে সহজ হয়ে মিশে গেছে।’ জীবনদেবতা অনুরাগী কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ আজীবন হৃদয়ধর্ম দ্বারা পরিচালিত হয়েছেন। বাউলের সুর, বাণী ধর্ম চিন্তার মধ্যে তাঁর চিন্তা চেতনার সাযুজ্য খুঁজে পেয়েছিলেন। পদ্মা গড়াই বিধৌত শিলাইদহ নিভৃত পল্লী তাই একদা পরিণত হয়েছিল কবিতীর্থে। তার সাহচর্য ও সরল উদার চিন্তানলে দগ্ধ হয়ে গগনসহ কত অখ্যাত, অজ্ঞাত বাউল কবি, শিল্পী, গল্পকার, সাধারণ মানুষ বিদগ্ধ হয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। কারণ, তাঁর যে একান্ত ইচ্ছা ‘যে আছে মাটির কাছাকাছি সে কবির বাণী লাগি কান পেতে আছি’। লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক
×