ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিজ্ঞানমনস্ক রবীন্দ্রনাথ

প্রকাশিত: ১২:০১, ৮ মে ২০১৯

বিজ্ঞানমনস্ক রবীন্দ্রনাথ

সাহিত্যের বহুমাত্রিক আঙিনায় বিচরণ করা রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞান ভাবনাও ছিল এক আলোকিত আধুনিক জগৎ। মননশীলতার ভাবনা এবং বস্তু দুটোই সমানভাবে কবিকে মনোযোগী করে তোলে। গভীর চৈতন্যে এর প্রতি দায়বদ্ধতাও বাড়ে। বিজ্ঞান চেতনা কবির চিন্তাশীলতার বলয়ে যে মাত্রায় দ্যুতি ছড়ায় সেটা যুক্তিশীল মতামতের এক অবিস্মরণীয় কীর্তি। তাঁর বস্তুনিষ্ঠ বৈজ্ঞানিক চিন্তার সম্পূরক হিসেবে বিশ্বখ্যাত বহু বিজ্ঞানীর সঙ্গে হৃদ্যতা, একাত্মতা এবং প্রীতির যে বন্ধন তৈরি হয় তা আজও মুগ্ধতার বিষয়। ভাবুক, আবেগপ্রবণ কবি যখন যৌক্তিক বিশ্লেষণে বৈজ্ঞানিক বিষয়বস্তুর সঙ্গে নিজেকে অবিচ্ছিন্ন করেন তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না সৃজন দ্যোতনার সঙ্গে বিজ্ঞানমনষ্কতা কিভাবে পারস্পরিক সৌধ নির্মাণে এক অবিস্মরণীয় কীর্তির অনুবর্তী হয়। বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় কিংবা সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের অকৃত্রিম ঘনিষ্ঠতা, বন্ধুত্ব এবং নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ সব সময়ই বজায় ছিল। শুধু হৃদয়ের সম্পর্কই নয়, বিষয়গত ভাবেও বিজ্ঞানের এই তিন দিকপালের সঙ্গে কবির চিরস্থায়ী বাঁধন তার বিজ্ঞান প্রীতি আমাদের সামনে সুস্পষ্ট করে। রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তির এক দশক আগে জগদীশ চন্দ্রের খ্যাতি সারা বিশ্বকে অবাক করে দিলে কবি নিজেও এই যশস্বী বিজ্ঞানীর প্রতি আকৃষ্ট হন। দুই বন্ধুর অসংখ্য চিঠিতে এমন অন্তরঙ্গতার অনুভব আজও ভাস্বর হয়ে আছে। শুধু তাই নয়, চিন্তায়, অর্থে, সাহচর্যে যেভাবে বিজ্ঞানের এই সাধককে ঘিরে রাখেন তিনি তা থেকেও অনুমেয় বিশ্ববরেণ্য এই কবির বিজ্ঞানের প্রতি অবিচল বোধ আর নিষ্ঠা। প্রফুল্ল চন্দ্রও ছিলেন তাঁর অকৃত্রিম বন্ধু আর আজীবন সৃহৃদ। আর এক বিশ্বসমাদৃত বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে তাঁর ‘বিশ্বপরিচয়’ বইটি উৎসর্গই করলেন। খ্যাতিমান পরিসংখ্যানবিদ প্রশান্ত মহালনবিসের সঙ্গেও ছিল এক সুগভীর সম্পর্ক। কৃতী এই বিজ্ঞানী কবির ভ্রমণেও তাঁর সফর সঙ্গী হতেন প্রায়ই। বেহালাবাদক বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের সঙ্গে কবির যে হৃদ্যতার বাঁধন সেটাও কারও অজানা নয়। প্রতিদিনের জীবন আর শিক্ষার সঙ্গে বিজ্ঞানের যে নিগৃঢ় সম্পর্ক, অচ্ছেদ্য মেল-বন্ধন সেটা কবি ছোট বয়স থেকেই ভাবতেন। ঠাকুরবাড়িতে নিয়মিত আসা সীতানাথ দত্তই ছিলেন তাঁর আদি গুরু এবং অকৃত্রিম শিক্ষক। পিতা মহর্ষীও তাঁকে ডালহৌসি পাহাড়ের ডাকবাংলোয় বসিয়ে তারা-গ্রহ-নক্ষত্রের সঙ্গে পরিচয় করাতেন। ‘বিশ্ব পরিচয়’ গ্রন্থের ভূমিকায় সেই স্মৃতি স্মরণ করে লিখলেনÑ ‘সন্ধ্যা বেলায় গিরিগৃঙ্গের বেড়া দেয়া নিবিড় নীল আকাশের স্বচ্ছ অন্ধকারে তারাগুলো যেন কাছে নেমে আসত। তিনি আমাকে নক্ষত্র চিনিয়ে দিতেন। তারা চিনিয়ে দিতেন। শুধু চিনিয়ে দেয়া নয়, সূর্য থেকে তাদের কক্ষচক্রের দূরত্বমাত্রা, প্রদক্ষিণের সময় এবং অন্যান্য বিবরণ আমাকে শুনিয়ে যেতেন। তিনি যা বলে যেতেন তাই মনে করে অখনকার কাঁচা হাতে আমি একটি বড় প্রবন্ধ লিখেছি। জীবনে এই আমার ধারাবাহিক রচনা, আর সেটা বৈজ্ঞানিক সংবাদ নিয়ে।’ কবির ‘বিশ্ব পরিচয়’ বইটিও পরমাণুলোক, নক্ষত্রলোক, সৌরজগৎ, ভূলোক, বিশ্ব জগতের বৈজ্ঞানিক আবর্তনের মধ্যেই আবর্তিত। বিজ্ঞান শুধু জানার, বোঝার কিংবা দেখার বিষয় নয়, তাকে নিজের আয়ত্তে এনে প্রতিদিনের কর্মকা-ের সঙ্গে যুক্ত করাটাই সত্যিকারের বিজ্ঞান ভাবনা এবং শিক্ষার মাধ্যমে এই বিজ্ঞানকে প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে মেলাতে হবে। সেই যৌক্তিক বাণী বেরিয়ে আসে আলোচিত গ্রন্থের শুরুতে। ‘শিক্ষা যারা আরম্ভ করেছে, গোড়া থেকে বিজ্ঞানের ভা-ারে না হোক বিজ্ঞানের আঙিনায় তাদের প্রবেশ করা অত্যাবশ্যক। এই জায়গায় বিজ্ঞানের সেই প্রথম পরিচয় ঘটিয়ে দেবার কাজে সাহিত্যের সহযোগিতা স্বীকার করলে তাতে অগৌরব নেই। সেই দায়িত্ব নিয়েই আমি এ কাজ শুরু করেছি। কিন্তু এর জবাবদিহি একা কেবল সাহিত্যের কাছেই নয়, বিজ্ঞানের কাছেও বটে।’ শান্তি নিকেতনের অধ্যাপক প্রমথনাথ সেনগুপ্তের লেখা পা-ুলিপিটি ভাষায়, আমূল পরিবর্তন করে ‘বিশ্ব পরিচয়’ গ্রন্থটি কবি নিজের ভাবনা আর অনুভূতিতে সাজান। জ্যোতির্বিদ্যার ওপরও রবীন্দ্রনাথের ছিল অগাধ পা-িত্য । ১৯৩৭ সালে লেখা এই বইটি সারা জীবনের বিজ্ঞানভিত্তিক পড়াশোনা, চিন্তা-চেতনার অনবদ্য স্বাক্ষর। কৈশোর বয়স থেকেই বিজ্ঞানের প্রতি এমন মনোযোগ, দরদ, আগ্রহই এই বিশেষ জ্ঞানের ওপর কবির প্রতিনিয়ত চর্চা তাঁকে এমন বিষয়ে উৎসাহী করে তোলে। শুধু তাই নয় বিজ্ঞান সমৃদ্ধ ভা-ার নিয়ে ‘বিশ্ব পরিচয়’ লিখতেও অনুপ্রাণিত করে। ৫৫ বছর বয়সে ১৯১৬ সালে যখন তিনি জাপান ভ্রমণে যান তখন শিল্পের অগ্রগামী দেশ হিসেবে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। ‘জাপান যাত্রী’ প্রবন্ধে কবির অনুভূতিÑ ‘কাজের শক্তি, কাজের নৈপুণ্য এবং কাজের আনন্দকে এমন পুঞ্জীভূতভাবে একত্র দেখতে পেয়ে আমি মনে মনে বুঝতে পারলাম, এই বৃহৎ জাতির মধ্যে কতখানি ক্ষমতা আছে। এই এত বড় একটা শক্তি যখন আপনার আধুনিক কালের বাহনকে পাবে অর্থাৎ বিজ্ঞান যখন তার আয়ত্ত হবে, তখন পৃথিবীতে তাকে বাধা দিতে পারে এমন কোন শক্তি আছে? তখন তার কর্মের প্রতিভার সঙ্গে তার উপকরণের যোগসাধন হবে।’ অর্থাৎ নিরন্তর কর্মযোগের সঙ্গে অব্যাহত যন্ত্রশক্তির সফল মিলন একটি জাতি তার কাক্সিক্ষত স্বপ্নে পৌঁছে যাবে। জাপানীরা মাতৃভাষাকে শিক্ষার সর্বত্র ছড়িয়ে দিচ্ছে দেখে কবি আনন্দিত হন। প্রত্যাশিত ফললাভেও তারা ব্যর্থ হচ্ছে না। কবি মনে করতেন নিজস্ব ভাষা, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিকে ধারণ করে আধুনিক বিজ্ঞান ও জ্ঞানের মহাসম্মিলন ঘটাতে হবে। বিশ্ব সভ্যতার যা কিছু কল্যাণকর ও মঙ্গল তার সঙ্গে সমন্বিত করতে হবে নিজস্ব ঐতিহ্যিক ভা-ারকে। আমাদের আপন অস্তিত্ব যা যুগ যুগ ধরে আবহমান বাংলাকে সমৃদ্ধির পথ দেখায়। সেখান থেকেও কোনভাবে পিছু হটা যাবে না। নব নব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সঙ্গে প্রতিদিনের কর্মযজ্ঞের সেতুবন্ধন তৈরি না করলে জাতি হিসেবে আমরা পিছিয়ে পড়ব এবং সেটাই এখন আমাদের লড়াই। এমন সব বাস্তব চেতনাকে ধারণ করে তিনি তার কৃষিনির্ভর জামিদারি এলাকায় আধুনিকায়নের যে বৃহৎ কর্মসূচী নিয়েছিলেন তা আজও নজির হিসেবে উল্লেখ্য। পুত্র রথীন্দ্রনাথকে কৃষি অর্থনীতির ওপর নতুন জ্ঞান অর্জনের জন্য সুদূর আমেরিকায় পাঠান। চাষাবাদে উন্নত প্রযুক্তি প্রয়োগ করে এর সফলতাকে জনগণের দ্বারে পৌঁছে দিতে কার্পণ্য করেননি। সঙ্গে মাতৃভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষার ওপর তার গভীর মনোযোগ তথ্যপ্রযুক্তিকে সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে নিতে যুগান্তকারী ভূমিকাও পালন করে। তাঁর মতে চাষের লাঙ্গল সেও এক প্রকার যন্ত্র কিন্তু বহু পুরনো। আধুনিক উদ্ভাবনী শক্তি এই গতানুগতিক শ্রমের উপকরণকে পরাভূত করে কৃষি অর্থনীতিকে সময়ের গতি প্রবাহে এগিয়ে দেবে। ব্যক্তিগত উদ্যোগ আর উদ্যমে হতদরিদ্র জনগণের সার্বিক উন্নয়নে যা করার চেষ্টা করেন সেটা আজও স্মরণীয়। আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার ও প্রয়োগ সম্পর্কে তাঁর ধারণা যখন বদ্ধমূল তখন তিনি যান বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায়। সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার শুধু যান্ত্রিক বিকাশই নয় সম্পদের সুষম বণ্টনও কবিকে মুগ্ধ করে। বার বার উপলব্ধিতে আসে শিক্ষাই মূল শক্তি এবং অবশ্যই তা সকলের জন্য। বিশ্ব ব্রহ্মা-ের সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, তারার যৌক্তিক আলোচনা কিংবা বিজ্ঞান চেতনাই নয়, সমাজ নিরীক্ষণের ভূমিকায়ও নামেন একজন দক্ষ সমাজবিজ্ঞানীর মতো। বিদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতালব্ধ ধ্যান-ধারণা, সম্পদ, জনবল, সর্বজনীন শিক্ষা সর্বোপরি কর্মশক্তিকে অপরিহার্য করে দেশের মঙ্গল, জনগোষ্ঠীর কল্যাণ সাধনে আজীবন নিজেকে সম্পৃক্ত রাখেন। পৈতৃক জমিদারী এলাকায় পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য তাঁর বিজ্ঞান সম্মত কর্মপরিধিকে যেভাবে সার্বজনীন করতে চেয়েছিলেন, সেটা কোন জমিদারের কাজ ছিল না। বরং একজন বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ নিজস্ব ঐতিহ্যের বেড়াজালে সময়ের গতি প্রবাহকে যে মাত্রায় একীভূত করতে চেয়েছিলেন, সেখানে নিজের তুলনা তিনি নিজেই। শান্তিনিকেতনে বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষা কর্মসূচী যা দেশীয় সংস্কৃতিকে নানা মাত্রিকে মেলাবে সেখানেও কবির অভাবনীয় কর্মযোগ আজও সময়ের নিরবচ্ছিন্ন অগ্রযাত্রায় যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। শ্রী নিকেতনেও কৃষি অর্থনীতি ও আধুনিক প্রযুক্তিকে সমন্বয় করে যে সমবায় ব্যবস্থাপনাকে একীভূত করা হয়, তাও প্রজামঙ্গলের এক অনন্য নজির। শুধু চিন্তায় কিংবা সুজনে নয় ব্যবহারিক জীবনেও বিজ্ঞানের অভিগামিতা যে মাত্রায় অনুধাবন করেছিলেন তিনি। সে দৃষ্টান্তও অনন্যসাধারণ। লেখক : সাংবাদিক
×