ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

গাইবান্ধার চরাঞ্চলের মানুষের জীবন জীবিকা;###;স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, নদী ভাঙ্গন যোগাযোগ ও পরিবহনসহ সঙ্কটের শেষ নেই

‘বাহে হামরা যারা চরোত থাকোম... দুক্কো কষ্ট থাকিয়াই যায়’

প্রকাশিত: ১১:১০, ৮ মে ২০১৯

‘বাহে হামরা যারা চরোত থাকোম... দুক্কো কষ্ট থাকিয়াই যায়’

আবু জাফর সাবু, গাইবান্ধা ॥ ‘বাহে হামরা যারা চরোত থাকোম, বান বন্যা, নদী ভাঙ্গন এবং ঝড়ঝাপটায় জেরবার হয়ায় হামার জীবন কাটে। হামার দুক্কো কষ্টের দিকে ফিরিয়াও দেখে না। নেতারা আসিয়া গালভরা নানান আশার কতা শোনায়। হামার যে দুক্কো কষ্ট তা থাকিয়াই যায়, তার আর কোন সুরাহা হয় না।’ গাইবান্ধার সদর উপজেলার নদীবেষ্টিত মোল্লারচর ইউনিয়নের হাঁসধরা গ্রামের সত্তর বছর বয়সের তোফাজ্জল বয়াতির এ কথা এ জেলার চরাঞ্চলের হতদরিদ্র সব মানুষের প্রাণের উপলব্ধির প্রতিধ্বনি। ঘাঘট, তিস্তা, করতোয়া, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীবেষ্টিত গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি, সাঘাটা, সুন্দরগঞ্জ ও সদর উপজেলার ২২ ইউনিয়নের ১৬৫ চরাঞ্চলের ৩ লাখ ৮০ হাজার ৪২৭ জনগোষ্ঠীর প্রায় ৭৬ হাজার ৮৫টি পরিবার বেঁচে থাকার ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত দীর্ঘকাল থেকে। নাগরিকদের মৌলিক সেবা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, আশ্রয়সহ জীবনধারণের প্রয়োজনীয় সব সেবা থেকেই তারা বঞ্চিত হচ্ছে। কৃষি ও আর্থ-সামাজিক অবস্থা ॥ চরাঞ্চলের পলিপড়া উর্বর মাটিতে ধান, পাট, তামাক, সবজি, ভুট্টা, মিষ্টি কুমড়া এবং বালু মাটিতে বাদাম, ডাল ও মিষ্টি আলুর ফলন বেশি। চরে বসবাসকারী ৬৫ ভাগ পরিবার কৃষিজীবী হলেও অধিকাংশ ক্ষুদ্র ও বর্গাচাষী। এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, সদর উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন মোল্লার চরের ৬ গ্রামের ২ হাজার ৩শ’ ৮৮ পরিবারের মধ্যে ধনী লোকের সংখ্যা মাত্র ২ ভাগ এবং এরাই সিংহভাগ জমির মালিক। বাকি ১৮ ভাগ ক্ষুদ্র প্রান্তিক চাষী ও অন্য পেশার মানুষ, আর ৮০ ভাগ হচ্ছে বর্গাচাষী ও শ্রমজীবী। এই অবস্থা সব চরাঞ্চলেই। চরাঞ্চলের দরিদ্র কৃষকরা আর্থিক কারণেই ঠিকমতো জমি চাষ করতে পারে না। এ বিষয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ প্রাপ্তিও বিশেষ করে বর্গাচাষীদের দেয়া হয় না বলেও কৃষিজীবী চরবাসীদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে না। আগে চরাঞ্চলে ব্যাংকগুলোর কৃষি ঋণ প্রদান বন্ধ থাকলেও বর্তমানে চরাঞ্চলে ফসলভিত্তিক যেমন- ভুট্টা, মিষ্টি কুমড়া, বাদাম, মরিচসহ শতকরা ৪ ভাগ সুদে ফসলি ঋণ দেয়ার বিধান রয়েছে। নদী ভাঙ্গন ॥ বন্যা ও নদী ভাঙ্গন চরাঞ্চলের হতদরিদ্র পরিবারগুলোর জীবনজীবিকার প্রধানতম সমস্যা। প্রতিনিয়তই নদী ভাঙ্গনে আবাদি জমি, গাছপালা হারিয়ে নিঃস্ব ভূমিহীন হচ্ছে কৃষক পরিবারগুলো। বন্যায় বাড়িঘর ভেঙ্গে নিরাশ্রয় হচ্ছে চরের মানুষ। এছাড়া জমিতে বালুর স্তর জমে উর্বরা ফসলি জমি অনাবাদী হয়ে পড়ছে। কিন্তু এসব সর্বহারা মানুষের সরকারী পর্যায়ে কোন পরিসংখ্যান নেই। নদী ভাঙ্গনে দুর্দশাকবলিত এসব পরিবারের পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের কোন ব্যবস্থাও করা হয় না। ফলে চরাঞ্চলের এসব কৃষক পরিবার বাধ্য হয়ে ভিন্ন জেলায় দিনমজুর হিসেবে কাজ করে বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে কোন রকমে একবেলা আধাপেটা খেয়ে বেঁচে থাকার নিন্তর প্রয়াস চালাচ্ছে। এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, এই জেলায় গত ১০ বছরে চরাঞ্চলের প্রায় ৫০ হাজার পরিবার গৃহহারা হয়েছে এবং ৮ হাজার হেক্টর আবাদি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ফলে ভূমিহীন হয়েছে ২৫ হাজার পরিবার। এছাড়াও ভাঙ্গনের শিকার কত পরিবার যে দুর্বিসহ জীবনযাপন করছে যার কোন সঠিক হিসাব নেই। উল্লেখ্য, সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা, ফুলছড়ি ও গাইবান্ধা সদর উপজেলার এখন ১৬৫টি চর হলেও ১৫ বছর আগেও চর ছিল মাত্র ৮৬টি। এছাড়া এক দশকে ৭০টি মেইন ল্যান্ডের অনেক গ্রাম নদী ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে গেছে। আবার তিস্তা-ব্রহ্মপুত্র-যমুনায় জেগে উঠেছে নতুন নতুন চর। চিকিৎসা সঙ্কট ॥ নদী বেষ্টিত চরাঞ্চলের মানুষ চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। এসব দুর্গম এলাকায় চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং প্রয়োজনীয় ওষুধের দোকান না থাকায় দুরারোগ্য ব্যাধিতে হঠাৎ করে আক্রান্ত রোগীরা যোগাযোগ সমস্যার কারণে জরুরী চিকিৎসার সুযোগ না পেয়ে হাসপাতালে পৌঁছার আগেই মারাত্মক জটিলতায় পড়েছে। এছাড়া দরিদ্র রোগীরা অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় অকালেই ধুঁকে ধুঁকে মরছে। মারাত্মক রোগে আক্রান্ত ও গর্ভবতী মা’দের উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র নয় তো জেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে এনে চিকিৎসা দিতে হয়। চরাঞ্চলে যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা সঙ্কটের কারণে রোগীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। সিভিল সার্জন ডাঃ এবিএম আবু হানিফ জানান, ২২টি নদীবেষ্টিত চরাঞ্চলভুক্ত ইউনিয়নে গ্রামগুলোর জন্য বর্তমানে কোন ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র নেই। এর আগে শুধুমাত্র সদর উপজেলার মোল্লারচরে একটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র থাকলেও তা নদী ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে গেছে। এরপর আর ওই ইউনিয়নে কোন স্বাস্থ্য ক্লিনিক নির্মাণ করা হয়নি। তবে ফুলছড়ির এরেন্ডাবাড়িতে একটি পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র রয়েছে। সেখানে মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হয়ে থাকে। উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ফুলছড়ি উপজেলার ৫ ইউনিয়নের চরাঞ্চলে কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে ১০টি। শিক্ষা সুযোগ বঞ্চিত মানুষ ॥ শিক্ষার অব্যবস্থা এ জেলার চরাঞ্চলে বসবাসকারী বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে জীবনধারণের সার্বিক অগ্রগতি থেকে অনেক পিছিয়ে রেখেছে। নিরক্ষরতার কারণে কুসংস্কার, অসচেতনতা চরাঞ্চলের মানুষদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। এসব এলাকায় ৭৬ হাজার শিশুর জন্য উচ্চ ও নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে মাত্র ৬টি এবং মাদ্রাসা রয়েছে ২টি। এছাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ১১৬টি। প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ জানিয়েছে, চরাঞ্চলের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ২৯ হাজার ১৫ ছাত্রছাত্রী লেখাপড়া শিখছে। কিন্তু প্রকৃত চিত্র ভিন্ন। চরাঞ্চলের ২০ ভাগ শিশু এখনও লেখাপড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এছাড়া বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেখা শিশুদের অধিকাংশই ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর আর লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছে না। এর কারণ হচ্ছে পিতামাতার অসচেতনতা, দারিদ্র্য, যোগাযোগের ক্ষেত্রে অব্যবস্থা এবং বিদ্যালয় সঙ্কট। প্রত্যন্ত চরাঞ্চলের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক উপজেলা বা জেলা শহর থেকে চরাঞ্চলে গিয়ে শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করে থাকে। ফলে এসব বিদ্যালয়ে শিক্ষকরা যথাসময়ে পৌঁছতে পারেন না এবং তাদের তাড়াতাড়িও চলে আসতে হয়। কর্মসংস্থানের অভাব ॥ চরে কোন কলকারখানা না থাকায় এবং কৃষি সেক্টরেও শ্রমজীবী সারা বছরের কাজ না থাকায় এখানকার ৮০ ভাগ শ্রমজীবী মানুষকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। বিশেষ করে চরের দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষদের কাজের সন্ধানে এই জেলা থেকে অন্য জেলায় যেতে হয়। এজন্য নানা সামাজিক সমস্যারও সৃষ্টি হয়েছে। অভাবের তাড়নায় বউ ছেলেমেয়ে ফেলে রেখে কাজে গিয়ে আর ঘরে ফেরে না অনেকেই। ু সামাজিক সমস্যা ॥ চরাঞ্চলগুলোতে বাল্যবিবাহ ও বহু বিবাহের প্রবণতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। জানা গেছে, চরাঞ্চলের শতকরা ৯৮ ভাগ মেয়ের বিয়ে হয় ৯ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে। চরাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ এখনও মনে করে ১৪ বছর বয়সী মেয়েদের অবশ্যই বিয়ে দেয়া উচিত। শুধু মেয়েদের ক্ষেত্রে নয়, চরাঞ্চলের পুত্র সন্তানের অভিভাবকেও তাদের সন্তানদের কম বয়সে বিয়ে দিচ্ছেন এবং তাদের অল্প বয়সী মেয়েদের পুত্রবধূ করে ঘরে তোলার প্রবণতাও বেশি লক্ষ্য করা যায়। উল্লেখ্য যে, বাল্যবিয়ের প্রবণতা বেশি হওয়ায় জেলায় পারিবারিক পর্যায়ে নারী নির্যাতনও ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এ কারণে নারী নির্যাতন এবং যৌতুক নিয়ে মামলা করার প্রবণতাও বেড়েছে। বাল্যবিয়ের প্রবণতা বৃদ্ধির কারণে গাইবান্ধা জেলার পল্লী অঞ্চলে মা ও শিশুদের অপুষ্টি, রক্তস্বল্পতা, আয়োডিন ঘাটতিসহ নানা রোগব্যাধি বাড়ছে। এ কারণেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী অর্থাভাবে মা ও শিশুদের সঠিক চিকিৎসা সহায়তা প্রদান করতে পারছে না বলে প্রসবজনিত মা ও শিশু মৃত্যু এবং মেয়েদের গড় আয়ুও হ্রাস পাচ্ছে। নদীর নাব্য সঙ্কটে যোগাযোগে অব্যবস্থা ॥ জলবায়ু ও পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতা জেলার নদীগুলোতে নাব্য সঙ্কট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বছরে প্রায় ৬ মাসের বেশি সময় নদীগুলো পানি শূন্য হয়ে পড়ায় জেলার চরাঞ্চলগুলো ৪১টি নৌরুটের মধ্যে ১৫টি রুটে শুকনো মৌসুমে ৯ মাসেই নদী পথে নৌ চলাচল বন্ধ থাকে। ফলে নৌকা নির্ভর চরাঞ্চলবাসীদের যাতায়াতে মারাত্মক দুর্ভোগের কবলে পড়তে হয়। হাঁটা পথে বালু পেরিয়ে এবং কিছু এলাকা নৌকায় এসে দীর্ঘ সময় ব্যয়ে তাদের মেইন ল্যান্ডে পৌঁছতে হয়। বিশেষ করে স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা এতে চরম দুর্ভোগের কবলে পড়ে। আইনশৃঙ্খলাসহ অন্যান্য সমস্যা ॥ শুধু তাই নয়, পানি, বিদ্যুত, স্যানিটেশন সমস্যাসহ চরাঞ্চলে কোন পুলিশ ফাঁড়ি না থাকায় সেখানে সাধারণ মানুষ জিম্মি হয়ে থাকে প্রভাবশালী সন্ত্রাসী ও চেয়ারম্যান, মেম্বার, গ্রাম্য টাউট দেওয়ানিদের কাছে। সুতরাং চরের মানুষ একশ্রেণীর সামন্ত প্রভুদের খপ্পরে চরম নিরাপত্তাহীনতায় দিনাতিপাত করে। বর্ষা মৌসুমে নৌ-ডাকাতরা নির্বিঘেœ গরু, ছাগল এমনকি ঘরের চালের টিন পর্যন্ত খুলে নিয়ে যায় শ্যালো নৌকায় করে। এত সমস্যা সঙ্কট সত্ত্বেও নদী ভাঙ্গনে সর্বহারা মানুষ চরাঞ্চলের নদীর পলিবাহিত সোনা ফলা জমিকে আঁকড়ে এবং নদীর এই সুনির্মল প্রাকৃতিক পরিবেশে সারাবছর মাছ ধরে ও একবেলা আধপেটা খেয়েও বেঁচে থাকতে চায়। নদী যেন মোহবিষ্ট করে আঁকড়ে ধরে রাখে চরের এই পরিশ্রমী মানুষদের।
×