ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

হঠাৎ ওলট পালট, বদলে যাওয়া ছবি

প্রকাশিত: ১১:০৮, ৮ মে ২০১৯

হঠাৎ ওলট পালট,  বদলে যাওয়া ছবি

এতদিন যা হয়েছে, এখন তার উল্টো। হঠাৎই বদলে গেছে রোজনামচা। খাওয়া দাওয়া, ঘুম, জেগে ওঠা সবই হচ্ছে নতুন নিয়মে। প্রতিদিনের জীবন থেকে কিছু জিনিস বাদ পড়েছে। আবার যোগ হয়েছে বেশ কিছু। হ্যাঁ, রোজার প্রভাবে এমন পরিবর্তন । মঙ্গলবার থেকে শুরু হয়েছে মাহে রমজান। দীর্ঘ এক মাস দিনের বেলায় পানাহার থেকে বিরত থাকবেন মুমিন মুসলমানরা। এই সাধনার মধ্য দিয়ে তারা সংযমের শিক্ষা গ্রহণ করবেন। নিজের চারপাশে থাকা অভুক্ত গরিব মানুষের কষ্ট উপলব্ধির চেষ্টা করবেন। সে লক্ষ্যে আগে থেকেই এক ধরনের প্রস্তুতি চলছিল। রোজা শুরুর পর স্পষ্ট হয়েছে আরও কিছু পরিবর্তন। সরকারী, আধা-সরকারী ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের অফিস এতদিন চলেছে সকাল ৯টা থেকে ৫টা পর্যন্ত। এখন শুরুর সময় ঠিক থাকলেও, শেষ হয়ে যাচ্ছে সাড়ে ৩টায়। এ ছাড়া সুপ্রীমকোর্ট, ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স, বাংলাদেশ রেলওয়ে, পোস্ট অফিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিজেদের সুবিধামতো সময়সূচী নির্ধারণ করে নিয়েছে। বেসরকারী অফিসের সময়ও বদলেছে। রোজার কথা ভেবেই এইসব পরিবর্তন। অফিসের কর্মঘণ্টা কমায় ব্যস্ততা অনেক বেড়ে গেছে। অল্প সময়ের মধ্যে দিনের পুরো কাজ শেষ করতে হচ্ছে। আর তাই মঙ্গলবার মতিঝিলের অফিস পাড়া ঘুরে মনে হয়েছে, অন্য সময়ের চেয়ে ছোটাছুটি অনেক বেশি। রাস্তা ঘাটের দৌড় ঝাঁপও বেড়েছে। সেহরি খেয়ে আবার ঘুমোতে যাওয়া মানুষজন দেরি করে বিছানা ছাড়ছেন। ফলে সাধারণ সময়ের অনেক পরে সচল হচ্ছে শহরের রাস্তাঘাট। আর বেলা বাড়তেই দেখা দিচ্ছে অস্বাভাবিক যানজট। গাড়ি যেন নড়তে চায় না। তবুও দিনের সব কাজ শেষ করার তাড়া। কাজ শেষ করে আগে আগে বাসায় ফেরার দারুণ সুযোগ অধিকাংশ মানুষ কাজে লাগাচ্ছেন। দুপুরের পর থেকেই শুরু হয়ে যাচ্ছে বাসায় ফেরার প্রস্তুতি। অন্য সময় এটি ভাবা যায় না। এখন বাস্তবতা। সন্ধ্যায় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ইফতার করার সুযোগ কেউ মিস করতে চাইছেন না। প্রেসক্লাবের সামনের রাস্তায় বাস ধরার জন্য ছোটাছুটি করছিলেন আমিনুল হক। সচিবালয়ের এই কর্মচারী বললেন, প্রথম রোজায় বাসায় ইফতার করা বলতে পারেন বাধ্যতামূলক। ছেলে-মেয়েরা চায়। তার চেয়ে বড় কথা, মা বেঁচে আছেন। আশা করে থাকেন। সবার সঙ্গে বসে ইফতার করতে নিজেরও ভাল লাগে। তাই যে কোন মূল্যে বাসায় ফেরার চেষ্টা করেন বলে জানান তিনি। অবশ্য বাসায় ফেরা হয়ে গেলে বেশ ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে ঢাকার রাস্তা। ইফতারের সময় গাড়ি তেমন চোখে পড়ছে না। প্রধান প্রধান সড়কে বরং রিক্সা ঢুকে পড়ছে। বুদ্ধিমানেরা জরুরী কাজ থাকলে এ সময়ের মধ্যে সেরে ফেলছেন। শহরের হোটেল রেস্তরাঁগুলোতে রোজার প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সারা বছর এসব রেস্তরাঁয় মানুষের ভিড় লেগে থাকে। দুপুর বেলায় খাবার খেতে লাইন ধরতে হয়। অথচ এখন উল্টো চিত্র। অধিকাংশ রেস্তরাঁ দিনের বেলায় বন্ধ রাখা হচ্ছে। প্রথম রোজার দিন দুপুরে ফার্মগেটের কস্তুরি রেস্তরাঁয় গিয়ে কথা বলার জন্য কাউকে পাওয়া যায়নি। বাইরে থেকে তালা লাগানো ছিল। পান্থপথের কুটুম বাড়ি নামের একটি রেস্তরাঁয় গিয়ে দেখা যায়, অধিকাংশ টেবিল ফাঁকা পড়ে আছে। সামনে খাবার নিয়ে বসেছেন মাত্র পাঁচ ছয়জন মানুষ। ম্যানেজার বললেন, রোজার দুপুরে কাস্টমার কমে যায়। ভিড় হয় সন্ধ্যায়। ইফতার করতে বহু মানুষ এখানে আসবেন। সেভাবেই প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। ফুটপাথের চায়ের দোকানেও অন্য ছবি। দোকানগুলো চালু আছে বটে। চারপাশে কালো কাপড় দিয়ে অভিনব আড়াল তৈরি করা হয়েছে। চেনা আড্ডাটি আর চোখে পড়ে না। কোন কোন চায়ের দোকানে বিক্রি হচ্ছে ইফতারসামগ্রী। মানুষের চলাচল আছে এমন ফুটপাথগুলোতে মৌসুমি বিক্রেতারা মুড়ি ছোলা পেঁয়াজু নিয়ে বসেছেন। পথচারীদের চোখের সামনে ভাজা হচ্ছে জিলেপি। শসা লেবু ইত্যাদিরও আলাদা কদর। বাসা বাড়িতেও অনুসরণ করা হচ্ছে নতুন রুটিন। মধ্যরাতে জ্বলে উঠছে ঘরের বাতি। পরিবারের বড়রা একে অন্যকে ডেকে তুলছেন। অসময়ে চোখ মুখ ধুয়ে একসঙ্গে বসে সেহরি খাচ্ছেন তারা। কোন কোন পাড়া মহল্লায় বাইরে থেকে ডাকাডাকি করার রীতি চালু আছে। অপেক্ষাকৃত তরুণরা উদ্যোগী হয়ে সেহরি খাওয়ার জন্য ডাকাডাকি করছেন। এ প্রসঙ্গে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী কাশিদা দলের কথা বলতে হয়। এই দলের সদস্যরা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে রাস্তায় নামেন। মহল্লার ভেতর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে সুরেলা কণ্ঠে রোজদারদের ডাকেন। ঘুম থেকে ওঠার আহ্বান জানান। পার্শ্ববর্তী মসজিদ থেকেও ক্ষণে ক্ষণে ঘোষণা আসছে। এভাবে রাতেই তৈরি হচ্ছে দিনের আবহ। এবারও রমজান উপলক্ষে বেড়েছে ধর্মীয় চর্চা। শহরের প্রায় সব মসজিদে খতমে তারাবির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিভিন্ন বাড়িতে, এ্যাপার্টমেন্ট হাউসের ছাদে গ্যারেজে দীর্ঘ নামাজ আদায় করছেন মুসল্লিরা। ইফতারের পর এ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন সবাই। সন্ধ্যার পর হতেই চেনা পোশাক বদলে পাঞ্জাবি-পাজামা-টুপি পরে দল বেঁধে মসজিদের দিকে হেঁটে যাওয়া। আসা যাওয়াটিকে অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় বেশি আন্তরিক বলে মনে হয়। মনে হচ্ছে এবারও। এদিকে, মাত্র প্রথম রোজাটি পালন করা হলেও, দেখতে দেখতে শুরু হয়ে যাবে ঈদের কেনাকাটা। ইতোমধ্যে মার্কেট শপিংমলগুলোতে নতুন পোশাক উঠতে শুরু করেছে। ক্রেতারাও ঢুঁ মারবেন। অচিরেই জমে উঠবে কেনাকাটা। উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়বে। সব মিলিয়ে অন্যরকম সময়। আমূল বদলে যাওয়া। এই বদলে যাওয়া কল্যাণের হোক। রোজার মধ্য দিয়ে প্রকৃত যে চাওয়া, সেটি অর্জিত হোক। ঈদ হোক সবার।
×