ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চলে গেলেন কণ্ঠশিল্পী সুবীর নন্দী

প্রকাশিত: ১০:৫৫, ৮ মে ২০১৯

চলে গেলেন কণ্ঠশিল্পী সুবীর নন্দী

মনোয়ার হোসেন ॥ কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো সে কথা তুমি যদি জানতে ...। শিল্পীর গাওয়া সেই কালোত্তীর্ণ গানটি যেন বারবার অনুরণন তুললো তার অনুরাগীদের মাঝে। সেই গানের বাণীর মাঝে হয়ত প্রকাশিত হলো শিল্পীর হারিয়ে যাওয়ার বেদনার অনুভব। কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পীর এমন অনেক কালজয়ী সঙ্গীতের সুরে এদিন ভিজেছে শ্রোতার দুই নয়ন। সেসব ভক্তের শোকার্ত হৃদয় মনের অজান্তে বলে উঠেছেÑ ও আমার উড়াল পঙ্খীরে যা যা তুই উড়াল দিয়া যা...। আধুনিক বাংলা গানের কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী সুবীর নন্দীর প্রয়াণের সংবাদে এমন করেই কেঁদেছে অগণন ভক্তের অন্তর। বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার ভোর সাড়ে চারটায় সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। খবরটি নিশ্চিত করেছেন শিল্পীর মেয়ে ফাল্গুনী নন্দী। তার বয়স হয়েছিল ৬৬ বছর। সবাইকে শোকে ভাসিয়ে রেখে গেছেন স্ত্রী পূরবী নন্দী, মেয়ে ফাল্গুনী নন্দীসহ অসংখ্য আত্মীয়-স্বজন, প্রিয়জন, বন্ধুবান্ধব, লাখো লাখো ভক্ত, সুহৃদ ও শুভাকাক্সক্ষী। শিল্পীর পারিবারিক সূত্র জানায়, সিঙ্গাপুর থেকে সুবীর নন্দীর মরদেহ আজ বুধবার সকালে ঢাকায় আনা হবে। সকাল ৬টা ১০ মিনিটে রিজেন্ট এয়ারওয়েজের একটি উড়োজাহাজে শিল্পীর মরদেহ ঢাকায় এসে পৌঁছবে। বিমানবন্দর থেকে তার শবদেহ নেয়া হবে ২৫সি গ্রীন রোডের গ্রীন ভিউ এ্যাপার্টমেন্টে। সেখান থেকে সকাল ১১টায় সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য সুবীর নন্দীর মরদেহ নেয়া হবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন শেষে শবদেহ নেয়া হবে রামকৃষ্ণ মিশনে। দুপুরে সবুজবাগে বরদেশ্বরী কালীমন্দির ও শ্মশানে একুশে পদকজয়ী এই সঙ্গীত শিল্পীর শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে। সুবীর নন্দীর পারিবারিক বন্ধু জাতীয় বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের জাতীয় সমন্বয়ক অধ্যাপক সামন্ত লাল সেন জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার ভোর সাড়ে চারটায় সুবীর নন্দী মারা গেছেন। সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরপর তিনবার হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন সুবীর নন্দী। এর আগে ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায়ও একবার হার্ট এ্যাটাক হয়েছিল তার। বারবার হার্ট এ্যাটাক হওয়ার আগে চিকিৎসকেরা যে আশার আলো দেখেছিলেন, সেটাও ক্ষীণ হয়ে যায়। সুবীরের মাল্টিপল অরগান ফেইলিউর হয়েছে। সুবীর নন্দীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা, সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এছাড়াও শোক প্রকাশ করেছেন জাতীয় সংসদের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর প্রমুখ। এদিকে সুবীর নন্দীর মৃত্যুর সংবাদ শুনে মঙ্গলবার সকালে সঙ্গীতাঙ্গনের মানুষেরা ছুটে যান তার গ্রীন রোডের বাসায়। তাদের মধ্যে ছিলেন সঙ্গীতশিল্পী রফিকুল আলম, খুরশীদ আলম, গীতিকার কবির বকুল প্রমুখ। শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ বলেন, সুবীর নন্দীর মৃত্যু দেশের সঙ্গীত জগতের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। একুশে পদকপ্রাাপ্ত সঙ্গীতশিল্পী সুবীর নন্দীর মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শোকবার্তায় শেখ হাসিনা বলেন, পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত এই জনপ্রিয় শিল্পী তার কর্মের মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন। গত ১৪ এপ্রিল মৌলভীবাজার থেকে ঢাকায় ফেরার পথে অসুস্থ হয়ে পড়েন সুবীর নন্দী। হার্ট এ্যাটাক করার পর তিনি রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) লাইফ সাপোর্টে চিকিৎসাধীন ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে ৩০ এপ্রিল তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে নেয়া হয়। গত শনি, রবি ও সোমবার পর পর তিনদিন হার্ট এ্যাটাক করেন। ডাক্তারদের শত চেষ্টার পরও তার অর্গানগুলো কাজ করছিল না। মঙ্গলবার ভোর রাতে সবাইকে কাঁদিয়ে সুবীর নন্দী মৃত্যুকে আলিঙ্গন করলেন। এর আগে সুবীর নন্দী দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিসসহ নানা সমস্যায় ভুগছিলেন। তার মৃত্যুর মাধ্যমে সমাপ্তি হলো বাংলা আধুনিক গানের এক উজ্জ্বলতম অধ্যায়ের। চলে গেলেন শিল্পী, রেখে গেলে কালজয়ী গান। শিল্পী না থাকলেও সেই গানগুলো ফিরবে মানুষের মুখে মুখে। যতদিন বাংলা ভাষা থাকবে, বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন তার গান গাওয়া হবে। সুবীর নন্দী গত ১২ এপ্রিল পরিবারের সবাইকে নিয়ে মৌলভীবাজারে আত্মীয়ের বাড়িতে যান। সেখানে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। ১৪ এপ্রিল ঢাকায় ফেরার পথে ট্রেনে ওঠার জন্য বিকেলে মৌলভীবাজার থেকে পরিবারসহ শ্রীমঙ্গলে আসেন। পরে তিনি ট্রেনে অসুস্থ হয়ে পড়লে একজন চিকিৎসকের পরামর্শে সুবীর নন্দীকে নিয়ে পরিবারের সদস্যরা ঢাকার বিমানবন্দর স্টেশনে নেমে যান। ওই দিনই রাত ১১টার দিকে তাকে রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়। সিএমএইচে থাকাকালীন সময়ে তার চিকিৎসার খবরাখবর নিচ্ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার নির্দেশেই পরে গত ৩০ এপ্রিল (মঙ্গলবার) তাকে এয়ার এ্যাম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুরের জেনারেল হাসপাতালে নেয়া হয়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেখানেই তার চিকিৎসা চলছিল। একুশে পদকপ্রাপ্ত বরেণ্য সঙ্গীতশিল্পী দীর্ঘ ৪০ বছরের সঙ্গীত জীবনে গেয়েছেন আড়াই হাজারের বেশি গান। পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। সঙ্গীতশিল্পী পরিচয়ের পাশাপাশি কিছু গানের গীতিকার ও সুরকার তিনি। ১৯৫৩ সালের ১৯ নবেম্বর সুবীর নন্দী জন্মগ্রহণ করেন হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং থানায় নন্দীপাড়ার এক কায়স্থ সম্ভ্রান্ত পরিবারে। শিল্পীর বাবা সুধাংশু নন্দী তখনকার একজন মেডিক্যাল অফিসার ছিলেন। তার মা পুতুল রানী খুবই চমৎকার গান করতেন। বাবার চাকরি সূত্রে তার শৈশব কেটেছে চা বাগানেই। পাঁচ-ছয় বছর বয়স পর্যন্ত বাগানেই ছিলেন। সেখানের একটি স্কুলেই প্রথম হাতেখড়ি। তার গানের ওস্তাদ ছিলেন গুরু বাবর আলী খান। লোকগানে ছিলেন বিদিত লাল দাশ। ১৯৬৩ সালে তৃতীয় শ্রেণী থেকেই গান গাওয়া শুরু করেন সুবীর নন্দী। এরপর ১৯৬৭ সালে তিনি সিলেট বেতারে গান করেন। ভাই তপন কুমার নন্দীর কাছ থেকেও সুবীর নন্দী গানের তালিম নিয়েছেন। সুবীর নন্দীর স্কুল ও কলেজ জীবন দুটোই হবিগঞ্জে। সিলেট বেতারে তিনি প্রথম গান করেন ১৯৬৭ সালে। এরপর ঢাকা রেডিওতে সুযোগ পান ১৯৭০ সালে। সেই সময় তিনি নজরুল গীতি গেয়ে রেডিওর অডিশনে পাস করেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা পরিবারসহ আগরতলায় চলে যান। সুবীর নন্দীর প্রথম রেকর্ড করা গান ‘যদি কেউ ধুপ জ্বেলে দেয়’। গানটি লিখেছেন মোহাম্মদ মুজাক্কের। সুর করেন ওস্তাদ মীর কাসেম। এটি রেকর্ড করা হয় ১৯৭২ সালে। একই বছর তিনি জনতা ব্যাংকে চাকরি নেন। এবং ২০১০ সালে অবসর নেয়ার আগ পর্যন্ত জনতা ব্যাংকেই কর্মরত ছিলেন। চলচ্চিত্রে প্রথম প্লেব্যাক করেন ১৯৭৪ সালে আব্দুস সামাদ পরিচালিত ‘সূর্যগ্রহণ’ চলচ্চিত্রে। ১৯৮১ সালে পূরবী নন্দীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন সুবীর নন্দী। তাদের একমাত্র সন্তান ফাল্গুনী নন্দী। একই বছর তার একক এ্যালবাম ‘সুবীর নন্দীর গান’ ডিসকো রেকর্ডিংয়ের ব্যানারে বাজারে আসে। এখন পর্যন্ত ২৮টি একক এ্যালবাম প্রকাশ হয়েছে সুবীর নন্দীর। ২০০২ সালে তপন চৌধুরী গাওয়া একটি নাটকের গানে প্রথম সুর দেন সুবীর নন্দী। পরবর্তীতে শাকিলা জাফরের (বর্তমানের শাকিলা শর্মা) একটি এ্যালবামে অনেক গানের সুর করেন তিনি। ২০০৪ সালে প্রথম গান লেখেন। তারপর লিখেছেন আরও অনেক গান। বেতার, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র মিলিয়ে প্রায় আড়াই হাজার গান তিনি গেয়েছেন। সুবীর নন্দীর গাওয়া অসংখ্য শ্রোতানন্দিত গানের মধ্যে রয়েছে ‘আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়’, ‘পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই’, ‘পাহাড়ের কান্না দেখে’, ‘দিন যায় কথা থাকে’, ‘আশা ছিল মনে মনে’, ‘হাজার মনের কাছে প্রশ্ন রেখে’, ‘বন্ধু তোর বরাত নিয়া’, ‘তুমি এমনই জাল পেতেছ’, ‘বন্ধু হতে চেয়ে তোমার শত্রু বলে গণ্য হলাম’, ‘কতো যে তোমাকে বেসেছি ভালো’, ‘আমি বৃষ্টির কাছ থেকে কাঁদতে শিখেছি’, ‘কেন ভালোবাসা হারিয়ে যায়’, ‘একটা ছিল সোনার কইন্যা’ এবং ‘ও আমার উড়াল পঙ্খীরে’।
×