ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনের কিছু কথা

প্রকাশিত: ১০:৫৪, ৮ মে ২০১৯

রবীন্দ্রনাথের  জন্মদিনের  কিছু কথা

মনোয়ার হোসেন ॥ পুরনো সেই দিনের কথা। ইংরেজী ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দ, বাংলা পঞ্জিকায় ১২৯৩ বঙ্গাব্দ। সে বছরের পঁচিশে বৈশাখ পঁচিশ পেরিয়ে ছাব্বিশ বছরে পদার্পণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তখনও এ অঞ্চলে প্রচলিত হয়নি জন্মদিন উদ্যাপনের রীতি। জন্মের সেই বিশেষ দিনটিতে কবির যৌবনকালের বন্ধু সাহিত্যিক শ্রীশ চন্দ্র মজুমদারকে চিঠি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সে চিঠির ভাষাটি ছিল এরকমÑ আজ আমার জন্মদিন পঁচিশে বৈশাখÑপঁচিশ বছর পূর্বে এই পঁচিশ বৈশাখে আমি ধরণীকে বাধিত করতে অবতীর্ণ হয়েছিলুমÑএমন আরও অনেক পঁচিশে বৈশাখ আসে এই আশীর্বাদ করুন। সেই প্রথম নিজের জন্মদিন নিয়ে কাউকে কিছু বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৮৮৭ সাল কিংবা ১২৯৪ বঙ্গাব্দে প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্যাপিত হয়েছিল বিশ্বকবির জন্মদিন। কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে উদ্্যাপিত হয়েছিল সে জন্মদিন। এই উদ্্যাপনের প্রচলন ঘটিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিলেত ফেরত স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী। সাতাশ বছর বয়সে সেই প্রথম শুরু হলো কবিগুরুর জন্মদিন উদ্্যাপনের আনুষ্ঠানিকতা। সে জন্মদিনের বিবরণে কবির ভাগ্নি সরলাদেবী লিখেছিলেনÑ ‘রবিমামার প্রথম জন্মদিন উৎসব আমি করাই। অতি ভোরে উল্টাডিঙির কাশিয়া বাগানবাড়ি থেকে পার্ক স্ট্রিটে নিঃশব্দে তাঁর ঘরে তাঁর বিছানার কাছে গিয়ে বাড়ির বকুল ফুলের নিজের হাতে গাঁথা মালা ও বাজার থেকে আনা বেলফুলের মালার সঙ্গে অন্যান্য ফুল ও একজোড়া ধূতি-চাদর তাঁর পায়ের কাছে রেখে প্রণাম করে তাঁকে জাগিয়ে দিলুম। তখন আর সবাই জেগে উঠলেন। ‘রবির জন্মদিন’ বলে একটি সাড়া পড়ে গেল। সেই বছর থেকে পরিজনদের মধ্যে তাঁর জন্মদিনের উৎসব আরম্ভ হলো।’ সেই সাতাশ থেকে একাশি বছর পর্যন্ত কবির প্রিয় তীর্থস্থান ভারতের শান্তি নিকেতনসহ বাংলাদেশের শিলাইদহ, চীন, ইরান, ফ্রান্সসহ নানা দেশে কিংবা স্থানে উদ্যাপিত হয়েছে কবির জন্মদিন। কবির তেমন কিছু জন্মদিনের কথা মেলে ধরা হলো এ লেখায়। প্রতিবেদনটি রচনায় ভারতের ত্রিপুরার তরুণ রবীন্দ্র গবেষক শুভ্রজিত ভট্টাচার্যের সহযোগিতা নেয়া হয়েছে। বঙ্গাব্দ ১৩৪৮ কিংবা ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ পদার্পণ করেন ৮১ বছরে। সে বছর উদ্্যাপিত হয়েছিল কবির শেষ জন্মদিন। জন্মদিনের দু’দিন আগে তেইশে বৈশাখ কবি লিখেছিলেন ‘হে নূতন, দেখা দিক আর আর-বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ’। সে বছর পয়লা বৈশাখ বাংলা নববর্ষে শান্তি নিকেতনে হয়েছিল কবির জন্মদিন উদ্্যাপন। কারণ, সেই সময় ওই অঞ্চলে প্রচ- গরমের কারণে পঁচিশে বৈশাখের আগেই বন্ধ হয়ে যেত শান্তি নিকেতন। ভোর থেকে সূচনা হওয়া করির শেষতম জন্মদিনের আয়োজনে আশ্রমের বালক-বালিকারা সম্মেলক কণ্ঠে গেয়েছিল বৈতালিক গান। মুখরিত হয়েছিল আশ্রম। আশ্রমের প্রধান পথ পেরিয়ে সেই দলটি সমবেত হয় গ্রন্থাগারের সামনে। সূর্যোদয়ের পর মন্দিরে হয়েছিল উপাসনা। সে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক ক্ষিতিমোহন সেন। ‘সাম্প্রদায়িকতার অনিষ্টকারিতা’ বিষয়ক বক্তৃতা দিয়েছিলেন তিনি। কয়েকটি গান গাওয়া হয়েছিল সে অনুষ্ঠানে। সেগুলোর মধ্যে ওই অনুষ্ঠানকে উপলক্ষ করে দুটো গান লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। একটি ‘হে পুরুষোত্তম’ এবং অপরটি ‘এসো হে মহামানব (ঐ মহামানব আসে)’। প্রভাতী সে অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের ভাষণের শিরোনাম ছিল ‘সভ্যতার সংকট’। ভাষণটি সেদিন গ্রন্থরূপে বিতরণ করা হয়েছিল সকলকে। কবির উপস্থিতিতে সেই ভাষণ পাঠ করেছিলেন ক্ষিতিমোহন সেন। সেদিন ভোর বেলায় রানী চন্দ কচি শালপাতার ঠোঙ্গায় কিছু বেলি, জুঁই, কামিনী ফুল তুলে কবির হাতে দিয়ে তাকে প্রণাম করেছিলেন। সেই ফুলের ঠোঙাটি শুকেছিলেন কবি। জন্মদিনে প্রাপ্ত প্রচুর উপহারের মধ্যে ফুলে ফুলে ভরে গিয়েছিল ঘর। সঙ্গে ছিল আমের-সাজিতে সাজানো দেশ-দেশান্তরের প্রচুর আম। সন্ধ্যায় কবির নাতনি তাকে শুভ্র গরদের ধূতি ও উত্তরীয় পরিয়ে দিয়েছিলেন। সন্ধ্যাবেলায় বাসন্তি রঙের পোশাক পরে আশ্রমের মেয়েরা তাদের নিবেদনের ডালা সাজিয়ে নিয়ে এসেছিল কবির জন্য। পরিবেশিত হয়েছিল নৃত্যগীত। জন্মদিন উপলক্ষে রাতে খাওয়ানো হয়েছিল সকলকে। ৮১তম জন্মদিনে টেলিগ্রামের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথকে শুভেচ্ছা জানিয়ে মহাত্মা গান্ধী লিখেছিলেন, ‘আপনার জীবনের অশীতিতম বর্ষই যথেষ্ট নহে। আপনি শতায়ু হোন। আমার শ্রদ্ধা গ্রহণ করুন।’ শততম বছর বেঁচে থাকাটা রবীন্দ্রনাথের কাছে যৌক্তিক মনে হয়নি। তাই গান্ধীর শুভেচ্ছা বাণীর জবাবে লিখেছিলেন, ‘আপনার বাণীর জন্য ধন্যবাদ। অশীতিপর বৎসর বাঁচিয়া থাকাটাই বেয়াদপি। একশত বৎসর অসহনীয় হইবে।’ কবির ওই জন্মদিনে জাপানের রাষ্ট্রদূত, পারস্যের শাহ, সোভিয়েত রাশিয়ার পাইওনিয়ারসহ অনেক বিশিষ্টজন শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছিলেন। বৈশাখে উদ্যাপিত সেই জন্মদিনটির কিছুদিন পর বাইশে শ্রাবণ পৃথিবীকে বিদায় জানান রবীন্দ্রনাথ। ১৩১৭ বঙ্গাব্দে ৫০ বছরে পদার্পণ করেন রবীন্দ্রনাথ। সে বছরের শ্রাবণ মাসে ‘গীতাঞ্জলি’ ছাপতে দিয়েছিলেন কবি। শান্তি নিকেতনের আশ্রমবাসী অধ্যাপক ও ছাত্ররা মিলে জন্মোৎসবের আয়োজনে করেছিল। সেই পরিকল্পনার কথা জানতেন না কবি। বৈশাখের মাঝামাঝি কবি কলকাতায় গিয়েছিলেন, সেই সময়ই পরিকল্পনাটি করা হয়। দিনটি ছিল রবিবার। সকালবেলায় ছিল জন্মোৎসবের আয়োজন। ছেলেরা ফুল তুলে ঘর সাজিয়েছিল। ছাত্র-শিক্ষক-আশ্রমবাসী মিলে অভিনয় করেছিল একটি নাটকে। অভিনীত হয়েছিল প্রায়শ্চিত্ত নামের নাটক। সেই নাটকে রবীন্দ্রনাথ নিজেই ছিলেন মেকআপ আর্টিস্ট। সে নাটকে পরিবেশিত হয়েছিল বৈঠকী গান। ছিল দড়ি টানাটানি খেলার আয়োজন। এমন উৎসবের প্রত্যুত্তরে আপ্লুত রবীন্দ্রনাথ দিয়েছিলেন একটি ভাষণ। সেই ভাষণের কয়েকটি লাইন ছিল এমনÑ ‘মানুষের মধ্যে দ্বিজত্ব আছে; মানুষ একবার জন্মায় গর্ভের মধ্যে আবার জন্মায় মুক্ত পৃথিবীতে। তেমনি আর একদিকে মানুষের জন্ম আপনাকে নিয়ে, আর এক জন্ম সকলকে নিয়ে। একদিন আমি আমার পিতামাতার ঘরে জন্ম নিয়েছিলুম... সেখানকার সুখ-দুঃখ ও ¯েœহপ্রেমের পরিবেষ্ট থেকে আজ জীবনের নতুন ক্ষেত্রে জন্মলাভ করেছি। ...পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয়ে তবে মানুষের জন্মের সমাপ্তি, তেমনি স্বার্থের আবরণ থেকে মুক্ত হয়ে মঙ্গলের মধ্যে উত্তীর্ণ হওয়া মনুষ্যত্বের সমাপ্তি। ... আমি আজ তোমাদের মধ্যে যেখানে এসেছি, এখানে আমার পূর্বজীবনের অনুবৃত্তি নেই। বস্তুত, সে জীবনকে ভেদ করেই এখানে আমাকে ভূমিষ্ঠ হতে হয়েছে। এই জন্যেই আমার জীবনের উৎসব সেখানে বিলুপ্ত হয়ে এখানেই প্রকাশ পেয়েছে।’ ১৩৩৫ বঙ্গাব্দের পঁচিশে বৈশাখ ছিল কবিগুরুর ৬৮তম জন্মদিন। সে বছর জন্মদিনের দিন কবিকে একটি তুলাদ-ের একদিকে বসিয়ে অন্যদিকে বিশ্বভারতী প্রকাশিত সম-ওজনের গ্রন্থ রাখা হয়েছিল। সেই মাপামাপিতে কবির প্রকৃত ওজন না জানা গেলেও বইগুলো বিতরণ করা হয়েছিল বিভিন্ন পাবলিক লাইব্রেরি ও প্রতিষ্ঠানে। কলকাতার বিচিত্রা ভবনে উদ্যাপিত হয়েছিল সে জন্মদিন। আয়োজনটি করেছিল বিশ্বভারতীর সম্মিলনীর সদস্যরা। প্রাচ্যরীতি মেনে পুষ্পবৃষ্টির সঙ্গে ধূপ-ধুনা, শঙ্খবাদন ও সঙ্গীত পরিবেশনার মাধ্যমে ভালবাসা জানানো হয়েছিল কবিকে। ১৩৩৭ বঙ্গাব্দে সত্তরতম জন্মদিনে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন প্যারিসে। জন্মদিনের কয়েকদিন আগে সেখান থেকে ভাতিজি ইন্দিরা দেবীকে লেখা চিঠিতে কবি বলেন, ‘ধরাতলে যে রবিঠাকুর বিগত শতাব্দীর ২৫ শে বৈশাখ অবতীর্ণ হয়েছেন তাঁর কবিত্ব সম্প্রতি আচ্ছন্ন। তিনি এখন চিত্রকর রূপে প্রকাশমান’। প্রকৃত অর্থেই কবি তখন চিত্রশিল্পী হিসেবে প্রকাশ করেছেন নিজেকে। প্যারিসে সেই জন্মদিনের ছয়দিন আগে গ্যালারি পিজালিতে কবির প্রথম চিত্রকর্ম প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। ১২৫ ছবি ছিল সেই প্রদর্শনীতে। এই প্রদর্শনীর মধ্যেই ভারতীয় সমিতির উদ্যোগে কবির জন্মোৎসব উদ্্যাপিত হয়। রবীন্দ্র অনুরাগী স্প্যানিশ লেখিকা ভিক্টোরিয়া সেই প্রদর্শনীর জন্য ব্যাপক অর্থ ব্যয় করেছিলেন। বাংলাদেশের জল-হাওয়ার সঙ্গে মিশে আছে কবিগুরুর ৩৩তম জন্মদিনটি। ১৩০০ বঙ্গাব্দের পঁচিশে বৈশাখের সেই দিনটি ছিল শনিবার। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন শিলাইদহে। পদ্মাবোটে চেপে নদীতে ভেসে ভেসে কেটেছিল কবির সুন্দরতম সময়। বিকেলের পর নৌকা থেকে নেমে নদীর ধারে চরের মাঝে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন কবি। বোট থেকে সেবার দেবেন্দ্রনাথের তৃতীয় সন্তান সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেয়ে ইন্দিরা দেবীকে লেখা চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেনÑ ‘এখন আমি বোটে। এই যেন আমার বাড়ি .. আমি যখন শিলাইদহে বোটে থাকি তখন পদ্মা আমার পক্ষে সত্যিকার একটি স্বতন্ত্র মানুষের মতো।’ সেই জন্মদিন উপলক্ষে পরিবারের পক্ষ থেকে কবির জন্য কেনা হয়েছিল ৩০ টাকার কাপড়।
×