উদয়দিগন্তে শঙ্খ বাজে, মোর চিত্তমাঝে-চিরনূতনেরে দিল ডাক পঁচিশে বৈশাখ। বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সঙ্গীতের কিংবদন্তি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৮তম জন্মবার্ষিকী আগামীকাল বুধবার। দিনটিকে যথাযথ মর্যাদায় উদ্যাপন করবে বাঙালী জাতি। দিনটির তাৎপর্য নিয়ে কথা হয় রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী তপন মাহমুদের সঙ্গে। যিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের অমিয় ধারায় নিজেকে সিক্ত করার পাশাপাশি শিক্ষার্থীর মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছেন তার সঙ্গীতলব্ধ জ্ঞান।
রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে আপনার অনুভূতি কী?
তপন মাহমুদ : রবীন্দ্রনাথের জন্ম হয়েছিল যদিও ১৫৮ বছর আগে, তথাপি সারা বিশ্বে রবীন্দ্র দর্শন বা চিন্তা-ভাবনা আজও সমভাবে প্রযোজ্য। সে জন্য আমি রবীন্দ্রনাথকে সব সময়ের কবি বলব। তিনি সর্বকালীন সমসাময়িক।
রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন কিসের বারতা নিয়ে আসে?
তপন মাহমুদ : রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন অহিংসা, শান্তি ও সুন্দরের বার্তা নিয়ে আসে। মানুষ যেন সব ভেদাভেদ ও সাম্প্রদায়িকতা দূর করে, একটা শান্তির পৃথিবী গড়তে পারে, বার বার রবীন্দ্রজয়ন্তী আমাদের সে কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
আমাদের দেশে রবীন্দ্রচর্চা প্রসঙ্গে বলুন।
তপন মাহমুদ : রবীন্দ্রচর্চা ও রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চা দুটোই আলাদা। তার পরেও আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে স্বাধীনতা লাভের পর রবীন্দ্রচর্চা এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চা সার্বিকভাবে অনেক বেড়েছে। মানের দিক দিয়েও খুব খারাপ না। তবে রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চা আগের তুলনায় এখন পরিমাণে অনেক কিন্তু এর মান আগের মতো দেখা যায় না। কারণ, বর্তমান যুগ হচ্ছে প্রচার সর্বস্ব। আমরা শুধু নিজেকে জাহির করতে আগ্রহী। আমাকে বাদ দিয়ে বলছি না। আমরা শিখে বা না শিখে প্রচার করতে অনেক বেশি ব্যস্ত। শিখে যদি কেউ নিজেকে প্রচার করে সেটা সহনীয়। আত্ম প্রচার কখনও ভাল না। রবীন্দ্রনাথ আত্মপ্রচারকে ঘৃণা করতেন। এখন মিডিয়া অথবা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রভাব বা ইন্টারনেটের যুগে সবাই চায় প্রচাররূপী তারকা হতে। এ কারণে শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীতই নয়, সব সঙ্গীত, আমাদের ললিতকলা, সাহিত্য সর্বক্ষেত্রেই একটা নৈরাজ্য বিরাজ করছে। ফলে মানটা কমে যাচ্ছে।
রবীন্দ্রনাথের গানে আমরা কিভাবে সমৃদ্ধ হচ্ছি?
তপন মাহমুদ : রবীন্দ্রনাথের গান হচ্ছে প্রেমের। সে প্রেমের মধ্যে আছে ঈশ্বর, স্বদেশ, প্রকৃতি, মানব ও দেশপ্রেম। যা ভালবেসেই জয় করা যায়।
নতুনরা রবীন্দ্রনাথের গানকে কিভাবে গ্রহণ করছে?
তপন মাহমুদ : যুগের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশনার ঢংও পাল্টায়। এটা আমাদের মেনে নিতে হয়। আমরা আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে যেভাবে কথা বলতাম, আজ কিন্তু কথার ধরন পরিবর্তন হয়েছে। এভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনার ঢংটাও চেঞ্জ হয়েছে কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে বিকৃত করে নয়। আমাদের নতুন প্রজন্মের কিছু ছেলে-মেয়ে হয়ত না জেনে অজ্ঞানতাবসত রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ভুল এক্সপেরিমেন্ট করছে। গানের ক্ষেত্রে ভিডিও সংস্কৃতি চালু হয়েছে। তাতেও গানটা না বুঝে, গানের মর্মার্থ না বুঝে তারা একটা ভিডিও তৈরি করে প্রকাশ করছে। যার সঙ্গে রবীন্দ্রসঙ্গীত যায় না। এটার জন্য দায়ী আমরাও কম নয়। কর্পোরেট পুঁজির প্রয়োজনেই এইভাবে বিকৃত হচ্ছে। তবে একটা আশার কথা আমি এখনও বলব, রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেও রবীন্দ্রসঙ্গীত বিকৃতি হয়েছে এবং রেকর্ডও হয়েছে কিন্তু কোন লাভ হয় নাই। বেঁচে ছিল আদি রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং এখনও আছে। এক এক জনের গায়কী হয় এক এক রকম হবে, এতে অন্য রকম শোনায় কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীতকে বিকৃত করে নয়। আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা আছে। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান রবীন্দ্রসঙ্গীতচর্চা শুদ্ধভাবে করে যাচ্ছে। কিছু প্রচার পাব আবার পয়সাও পাব এই আশাও কেউ কেই করছেন, সেটাকে রবীন্দ্রচর্চা বলা চলে না।
রবীন্দ্রনাথের গানকে এগিয়ে নিতে করণীয় কী?
তপন মাহমুদ : রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে যারা কাজ করছেন, তাদের প্রতি অনুরোধ আপনারা আরও এগিয়ে আসেন। আমাদের যুগ শেষ, আমরা এখন পড়ন্ত বেলায় রয়েছি। যারা এখন নবীন বা মধ্য গগনে তাদের উচিত রবীন্দ্রনাথকে অবিকৃত রাখা, আমাদেরই স্বার্থে। রবীন্দ্রনাথ নি:শ্বাসের মতো আমাদের মধ্যে প্রবাহিত। নিশ্বাস বন্ধ হলে যেমন মানুষ বাঁচতে পারে না, রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে আমরা বাঙালী বরে দাবি করতে পারব না। তার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তার সৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখা আমাদের সবার উচিত।
-গৌতম পান্ডে
শীর্ষ সংবাদ: