ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আনন্দের জোয়ার সর্বত্র

প্রকাশিত: ১১:১৭, ৭ মে ২০১৯

 আনন্দের জোয়ার সর্বত্র

ওয়াজেদ হীরা ॥ সোমবার দুপুর সাড়ে বারোটা। ভিকারুননিসা স্কুলের ভেতর থেকে শিক্ষার্থীদের আনন্দ, হৈ হুল্লোড় আর বাদ্যযন্ত্রের শব্দ ভেসে আসছিল। জানা গেল এসএসসি পরীক্ষার্থীদের পরিশ্রমের প্রত্যাশিত প্রাপ্তিতে উত্তীর্ণদের এই আনন্দ। শুধু ভিকারুননিসাই নয় দেশের সব স্কুলে আনন্দের বন্যা ছিল এ রকমই। উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের চোখে মুখে হাসির ঝিলিক। স্কুল প্রাঙ্গণ থেকে সেই আনন্দ ছড়িয়ে যায় বাড়িতেও। ইট পাথরের রাজধানী থেকে আনন্দের ঢেউ পৌঁছে প্রত্যন্ত গ্রামেও। উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশে। এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর আনন্দ ছিল দিনভর। উত্তীর্ণদের সাফল্যে আনন্দের ঢেউ লাগে সারাদেশে। পরীক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক কিংবা স্বজন সবাই উচ্ছ্বসিত কাক্সিক্ষত ফলে। পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকের পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরও ছিল ফল জানার আগ্রহ। এসএসসির ফল জানতে সকাল থেকেই স্ব স্ব স্কুল ও কলেজের সামনে ভিড় করে পরীক্ষার্থী-অভিভাবকরা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সবার মধ্যেই একটা চাপা উৎকণ্ঠা দেখা যায়। সকাল দশটায় সংবাদ সম্মেলন করে গণ্যমাধ্যমকর্মীদের সার্বিক ফল অবহিত করেন শিক্ষামন্ত্রী। দুপুরের পর থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ফল জানা শুরু হয়। আর তখনই বাঁধভাঙা আনন্দ-উচ্ছ্বাসের ঢেউ নামে স্কুলে স্কুলে। কারও কারও কপোল বেয়ে নামে আনন্দ অশ্রু। গত বছরের চেয়ে এ বছর পাসের হার যেমন বেড়েছে তেমনি পাস করা শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বেড়েছে। আর পাস করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে আনন্দ করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা একটু বেশি। এ বছর সাধারণ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ড মিলিয়ে মোট পাস করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৭ লাখ ৪৯ হাজার ১৬৫। যা গত বছর ছিল ১৫ লাখ ৭৬ হাজার ১০৪। অর্থাৎ গত বছরের চেয়ে পাস করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা এবার ১ লাখ ৭৩ হাজার ৬১ জন বেশি। পাসের হার বেড়েছে গত বারের চেয়ে ৪.৪৩ শতাংশ। গতবার যেখানে ৭৭.৭৭ শতাংশ এবার হয়েছে ৮২.২০ শতাংশ। গতবারের চেয়ে শতভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও বেড়েছে এবার। গত বছর যেখানে ছিল ১৫৭৪টি এবার তা হয়েছে ২৫৮৩টি। সব মিলিয়ে আনন্দের জয় জয়কার সবদিকে। দুপুরের পর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এ্যান্ড কলেজ প্রাঙ্গণে দেখা যায় ঢাক ঢোল বাধ্যযন্ত্র নিয়ে উচ্ছ্বাসে মাতোয়ারা শিক্ষার্থী অভিভাবকরা। শিক্ষকরা অপলক দৃষ্টিতে শিক্ষার্থীদের আনন্দ উপভোগ করছেন। দল বেঁধে উল্লাস আর ‘আইডিয়াল, আইডিয়াল’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণ। কেউ কেউ বিজয় চিহ্ন দেখিয়ে সেলফি তুলে আনন্দ প্রকাশে ব্যস্ত হয়। সিদরাতুল আলম স্কুলে এসে রেজাল্ট শিট থেকে ফলাফল জানতে পেরে প্রথমেই পাশে থাকা মাকে জড়িয়ে ধরে। নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে সিদরাতুল আলম বলেন, আমার পরিশ্রম, বাবা-মায়ের সর্বক্ষণিক তদারকি আর শিক্ষকদের প্রচেষ্টায় আমি কাক্সিক্ষত ফল পেয়েছি। আকাশ নামের শিক্ষার্থী বলেন, এমন দিনগুলো প্রতিদিন আসে না। আমরা কয়েক বছর অপেক্ষা করেছি পরিশ্রম করেছি একটা ভাল ফলের। এখন থেকে আবার নতুনভাবে কলেজ জীবন শুরু করব। স্কুল জীবনের প্রতিটি সময় খুব মিস করব। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে ৯৯.৪ শতাংশ পাস করেছে। ভিকারুননিসা স্কুলের জিপিএ-৫ পাওয়া এক শিক্ষার্থীর মা বলেন, সন্তান যখন ভাল রেজাল্ট করে তখন অভিভাবক হিসেবে সেই অনুভূতি সর্বোচ্চ আনন্দের। আমার মেয়ে ভাল রেজাল্ট করতে পেরেছে তার চেষ্টা, পরিশ্রম আর শিক্ষকদের আন্তরিকতায়। ভিকারুননিসায় দেখা গেল দুই বান্ধবী জড়িয়ে ধরে আনন্দ ভাগাভাগি করছে। পাশের বন্ধুরা এসে সেলফিতে মেতে উঠল। ছবি থেকে বাদ যায়নি উপস্থিত কতিপয় অভিভাবকও। শিক্ষার্থীরা বলেন, জেএসসির পর এসএসসি নিয়ে যে প্রস্তুতি উচ্চ শিক্ষার ভিত্তি গড়তে এই প্রস্তুতি সামনে আশা করি অনেক কাজে দেবে। আমাদের শিক্ষক অভিভাবক সেই ভাবেই আমাদের নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটি থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে জিপিএ-৫ পেয়েছেন মারছিয়া আহম্মেদ। তিনি বলেন, পরীক্ষার আগে অনেক কষ্ট করেছি। এখন জিপিএ-৫’র রেজাল্ট পেয়ে অনেক ভাল লাগছে। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ফেরদৌসী বেগম বলেন, সার্বিক ফলাফলে আমি সন্তুষ্ট। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের প্রচেষ্টায় বরাবরের মতো এবারও ভাল ফল হয়েছে। এদিকে, রাজধানীর উত্তরার রাজউক মডেল স্কুল এ্যান্ড কলেজে এ বছর এসএসসিতে পাসের হার ৯৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ। জিপিএ ৫ পেয়েছে ৬৯৭ জন শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে উচ্ছ্বসিত শিক্ষার্থীরা আগামীর জন্য দোয়া চান। মাহমুদুল নামের শিক্ষার্থী বলেন, আমরা চাই ভাল কিছু করতে। বাবা-মা আমাদের নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেন তার বাস্তবায়ন যেন করতে পারি। রাজধানীর অন্যান্য স্কুলের চিত্রও ছিল অভিন্ন। দল বেঁধে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প আড্ডা আর খুশির ভাগাভাগি। সন্তানদের এমন খুশিতে অভিভাবকরা ছুটেছেন মিষ্টির দোকানগুলোতে। রাজধানীর মিস্টির দোকানগুলোতে উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে। বেইলি রোডে মিষ্টি কেনার সময় সাজ্জাতুল আলম বলেন, মিষ্টির দাম মনে হয় একটু বেড়ে গেছে। সন্তান ভাল ফল করেছে বাসার সবার জন্য মিষ্টি কিনেছি আধা ঘণ্টার লাইনে দাঁড়িয়ে। তাতে অবশ্য বিরক্ত নন তিনি। সন্তানের খুশির সামনে এটি তুচ্ছ! এদিকে, রাজধানীর ইট পাথরের শহরে স্কুলে স্কুলে যখন আনন্দের মিছিল চলছে তখন বাদ যায়নি বিভিন্ন জেলা শহর কিংবা গ্রামের স্কুলের আনন্দও। বিভাগীয়, জেলা ও গ্রামের স্কুলের আনন্দটাও ছিল নিজেদের মতো করেই। কুড়িগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে পাস করা এক শিক্ষার্থী এসএসসি উত্তীর্ণ হয়ে বিজয়ের চিহ্ন দেখিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি পোস্ট করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার আশীর্বাদ চেয়েছেন। এ রকম অসংখ্য আনন্দের ছবি ঘুরে বেড়াচ্ছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে। জেলা বিভাগীয় শহরের শিক্ষার্থীরা ঢাক-ঢোল পিটিয়ে মেতে ওঠে আনন্দ উৎসবে। জানা গেছে, এবারের মাধ্যমিক পরীক্ষায় বগুড়ার নামী-দামী স্কুলগুলোর ফল আশান্বিত নয়। এরই মধ্যে শিবগঞ্জ উপজেলার আমতলি মডেল স্কুলের ফল প্রত্যাশা পূরণ করে এগিয়ে গেছে। এই স্কুলের এবারের মাধ্যমিকের ২৩ জন পরীক্ষার্থীর সকলেই জিপিএ-৫ পেয়ে স্কুলকে এগিয়ে নিয়েছে। এখানে জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যা শতভাগ। বগুড়া জিলা স্কুলের বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগে পরীক্ষার্থী ছিল ২৩৯ জন। শতভাগ পাস করেছে। তবে জিপিএ-৫ পেয়েছে ২৩১ জন। সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে পরীক্ষার্থী ছিল ২৭০ জন। শতভাগ উত্তীর্ণ। জিপিএ-৫ পেয়েছে ২৪৬ জন। বগুড়া ক্যান্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজের মোট পরীক্ষার্থী ২৮০ জনের মধ্যে সকলেই উত্তীর্ণ। জিপিএ-৫ পেয়েছে ২৬৬ জন। বিয়াম মডেল স্কুলের মোট পরীক্ষার্থী ছিল ৪৩৩ জন। উত্তীর্ণ হয়েছে ৪৩২ জন। জিপিএ-৫ পেয়েছে ২৬১ জন। পুলিশ লাইন্স স্কুল ও কলেজের পরীক্ষার্থী ছিল ১৯৭ জন। শতভাগ উত্তীর্ণ। জিপিএ-৫ পেয়েছে ১৭৫ জন। জিপিএ-৫ প্রাপ্তিতে এই স্কুল দিনে দিনে ভাল করছে। আর্মড পুলিশ ব্যাটিলিয়ন পাবলিক স্কুল এ্যান্ড কলেজের বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের পরীক্ষার্থী ছিল ২৮৬ জন। শতভাগ উত্তীর্ণ তবে জিপিএ-৫ পেয়েছে ২০২ জন। এছাড়াও চট্টগ্রাম খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে এবার পাসের হার বেড়েছে। বোর্ডের অধীনে এবার উত্তীর্ণ হয়েছে ৭৮ দশমিক ১১ শতাংশ শিক্ষার্থী, যা গত বছরের চেয়ে ২ দশমিক ৬১ শতাংশ বেশি। চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মোঃ মাহবুব হাসান বলেন, বিশেষ নজরদারির পাশাপাশি প্রশ্নপত্র ফাঁসজনিত কোন সমস্যা না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা নির্বিঘ্নে পরীক্ষা দিতে পেরেছে। সে জন্য ফলও ভাল হয়েছে। চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এসএসসি পরীক্ষার ফলে এবারও ভাল ফল সেই নামী স্কুলগুলোর দখলে। এর অধিকাংশই চট্টগ্রাম মহানগরীতে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী জিপিএ-৫ অর্জনের ভিত্তিতে সেরা প্রতিষ্ঠান হলো- কলেজিয়েট স্কুল, সরকারী মুসলিম হাইস্কুল, নাসিরাবাদ সরকারী বালক উচ্চ বিদ্যালয়, ডাঃ খাস্তগীর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়সহ অন্যান্য। ফল প্রকাশের পর এসব স্কুলে বাধভাঙা আনন্দ উচ্ছ্বাস চলে বলেও জানা যায়। একাধিক শিক্ষাবিদ জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের এই সন্তানরা আগামীর জন্য আরও ভালভাবে প্রস্তুত হোক এটাই চাই। এদের হাতেই তো আগামীর বাংলাদেশ। মানসম্মত শিক্ষা ও ভাল ফল দিয়ে সামনের শিক্ষা জীবন আরও সুন্দর হোক সে কথা বলেন। আর শিক্ষার্থীরা উচ্ছ্বাস নিয়ে স্বপ্ন বুনছেন স্কুল জীবনের স্মৃতি ও শিক্ষা নিয়ে সামনে ভাল এবং উন্নত প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার যেখান থেকে নিজেকে আরও পূর্ণাঙ্গরূপে তৈরি করতে পারবে আগামীর জন্য।
×