ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

এই সেই কৃষ্ণচূড়া যার তলে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ হাতে হাত কথা যেত হারিয়ে

প্রকাশিত: ১০:৫৭, ৭ মে ২০১৯

এই সেই কৃষ্ণচূড়া যার তলে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ হাতে হাত কথা যেত হারিয়ে

সমুদ্র হক ॥ নীরবে-নিভৃতে লোকচক্ষুর অগোচরে বেড়ে উঠেছে নীলকণ্ঠ বৃক্ষটি। গাছটি নীল কৃষ্ণচূড়া নামেও পরিচিতি পেয়েছে। কৃষ্ণচূড়া গাছ ও ফুলের আকৃতির সঙ্গে এর এতটাই মিল যে মনে হবে যমজ। শুধু ফুলের রঙের পার্থক্য। একটি লাল, আরেকটি নীলের প্রলেপে বেগুনী। দূর থেকে নীল মনে হয়। লাল কৃষ্ণচূড়ার মতো এ গাছটিও উষ্ণমন্ডলীয়। পাতা ও ফুল দেখতে একই রকম। দেশে গ্রীষ্মকালীন ফুলের রাজত্ব করে আগুনরাঙা লাল কৃষ্ণচূড়া। শান্ত, নীল কৃষ্ণচূড়া এখনও রাজআসনে বসেনি। তবে নেপালে রাজপ্রাসাদের ভেতরে বড় আসন করে নিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার একটি নগরীকে নীল কৃষ্ণচূড়ার রাজধানী বলা হয়। ওরা পথের দুই ধার ছেয়ে দেয় নীলরঙে। ও দেশের মানুষ এই গাছ ছাড়া জীবনকে কল্পনাও করতে পারে না। বাংলাদেশে এই নীলকণ্ঠের সৌন্দর্য অনেকের চোখে পড়েনি। এমনকি উত্তরাঞ্চলের যে জেলা শহরে ফুলটি ফুটে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য বাড়িয়ে স¦প্নীল ভুবন তৈরি করেছে তা জানে না ওই শহরেরই বেশিরভাগ মানুষ। প্রতিদিন কত মানুষ দিলালপুরের আব্দুল হামিদ রোডের পশ্চিমের পথ দিয়ে চলাচল করে। দৈনিক কত মানুষ যায় বনমালী ইনস্টিটিউটে (বর্তমান নাম পাবনা বনমালী শিল্পকলা কেন্দ্র)। হ্যাঁ, বলছি পাবনা জেলা শহরের নীলকণ্ঠ গাছটির কথা। অনেক ইতিহাসখ্যাত ব্যক্তিত্ব, সাহিত্যিক, বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তী নায়িকা সুচিত্রা সেনের জন্মভূমি এই পাবনা শহরকে নীল কৃষ্ণচূড়া বা নীলকণ্ঠ প্রকৃতির রূপকে অপরূপ করেছে। পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান ও বনমালী শিল্পকলা কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক ড. মোঃ হাবিবুরহ জানান, কেন্দ্রের চত্বরে যখন গাছটি রোপণ করা হয় তখন অনেকের ধারণা ছিল না এটি বিরল এক বৃক্ষ। যখন অসাধারণ সুন্দর ফুল ফুটে শোভিত করে তোলে তখন মন ভরে যায়। এই বৃক্ষের চারা বছরপাঁচেক আগে নেপাল থেকে এনেছিলেন কেন্দ্রের শুভাকাক্সক্ষী রবিউল ইসলাম চৌবে ডাবলু। তিনি জানালেন, নেপাল ভ্রমণের সময় রাজপ্রাসাদ দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। তখন এই গাছটি দেখে আমার মনে ধরে যায়। ফেরার পথে চারা সংগ্রহ করি। দেশে ফিরে নিজ জেলা পাবনার বনমালী শিল্পকলা কেন্দ্রে ’১৩ সালের ১৩ আগস্ট সভাপতি অঞ্জন চৌধুরীর হাতে রোপণ করানো হয়। গাছটি দ্রুত প্রায় ২৫ মিটার দীর্ঘ হয়ে শাখা-প্রশাখার বিস্তার ঘটিয়ে ফুল ফুটেছে। এই গাছের পরিচর্যা এবং তত্ত্বাবধান করেন বনমালী শিল্পকলা কেন্দ্রের সভাপতি প্রকৃতিপ্রেমী অঞ্জন চৌধুরী। গাছটিকে কি করে টিকিয়ে রেখে চারা রোপণ করা যায় এ নিয়ে কথা হয় সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংরক্ষণের সহসভাপতি ডাঃ রামদুলাল ভৌমিকের সঙ্গে। বললেন, সংরক্ষণের খাতায় যুক্ত হলো নীলকণ্ঠ (নীল কৃষ্ণচূড়া) বৃক্ষ। তিনি সংরক্ষণ ও চারা তৈরির উদ্যোগ নেবেন। পাবনার বিশিষ্ট সাংবাদিক ও লেখক হাবিবুর রহমান স্বপন বলেন, প্রতিদিনই ও পথ দিয়ে চলি। একদিন হঠাৎ দৃষ্টি কেড়ে নিল নীল কৃষ্ণচূড়া। সুন্দর এই ফুল কবিতার ছন্দে হৃদয়ে বেজে উঠল রবীন্দ্রনাথের সুর ‘গন্ধে উদাস হওয়ার মত উড়ে/ তোমার উত্তরী কর্ণে তোমার কৃষ্ণচূড়ার মঞ্জরি...’। প্রকৃতি গ্রীষ্মের ফুল কৃষ্ণচূড়া ফুটিয়ে বাঙালী সংস্কৃতি এবং কাব্যচর্চাকে রাঙিয়ে দিয়েছে। কৃষ্ণচূড়ার কলি অনেকটা মোহরের মতো। তাই বুঝি এর আরেক নাম গুলমোহর। নীল কৃষ্ণচূড়ার পাপড়ি পাঁচটি, লম্বা ৮ সেন্টিমিটার। নীলকণ্ঠের বৈজ্ঞানিক নাম জ্যাকারান্ডা। এটি লাতিন শব্দ। ৪৯ প্রজাতি নিয়ে গঠিত বিগ্নোনিয়াসি পরিবারের একটি। আদিনিবাস মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা। কিউবা, হিস্পানিওয়ালা জ্যামাইকা, বাহামার উষ্ণ ও উপউষ্ণাঞ্চল হয়ে কবে এশিয়ায় এসেছে কে জানে! নেপালের আরেক পরিচয় নীলকণ্ঠের নগরী। আমাদের কাব্যে, সাহিত্যে জীবনের চলার পথে ভাব বিনিময়ে প্রণয়ে কৃষ্ণচূড়া অনেক বড় আসন করে নিয়েছে। গ্রীষ্মের দাহজ্বালা ভরদুপুরে প্রণয় মধুর জীবনে কপোত-কপোতি কৃষ্ণচূড়া গাছের শীতল ছায়ায় কী অপার মধুময়তার ভুবন তৈরি করে। কৃষ্ণচূড়াকে আমরা লাল রঙেই দেখতে অভ্যস্ত। উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা বলছেন, কৃষ্ণচূড়া তিন রঙের হয়- লাল, হলুদ ও সাদা। পাবনায় নীলকণ্ঠ ফুল ফুটে নীল কৃষ্ণচূড়া নাম নিয়ে আবির্ভূত হয়ে কৃষ্ণচূড়া পরিবারে নতুন অধ্যায় রচনা করেছে। নীল কৃষ্ণচূড়া প্রকৃতির সৌন্দর্যে মানবহৃদয় ভরিয়ে দিয়েছে। এমনই ক্ষণে কেউ নস্টালজিক হয়ে স্মৃতির পাতা মেলে ধরতে পারেন। মনে পড়তে পারে পুরনো দিনের ছায়াছবি হারানো সুরের সেই দৃশ্য- কৃষ্ণচূড়ার তলে সুচিত্রার কোলে উত্তম। সুচিত্রার ঠোঁটে বাজছে গীতা দত্তের গাওয়া সেই অমর গান ‘তুমি যে আমার ওগো তুমি যে আমার, কানে কানে শুধু একবার বলো তুমি যে আমার...’। নীলকণ্ঠের সুরে নীল কৃষ্ণচূড়া হয়ে সেই সুরই তুলেছে পাবনার বনমালী ইনস্টিটিউটে...।
×