ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ঈশ্বরদী বিমানবন্দর চালু না হওয়ায় মাসে অর্ধকোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি

প্রকাশিত: ০৯:২৮, ৭ মে ২০১৯

 ঈশ্বরদী বিমানবন্দর চালু না হওয়ায় মাসে অর্ধকোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি

তৌহিদ আক্তার পান্না, ঈশ্বরদী ॥ পর্যাপ্ত সংখ্যক বিদেশীসহ প্রয়োজনের অতিরিক্ত যাত্রী থাকা সত্ত্বেও ঈশ্বরদীতে বিমানের ফ্লাইট চালু না থাকায় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ প্রতিমাসে প্রায় অর্ধকোটি টাকা রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্র, ঈশ্বরদী ইপিজেড, পাকশী রেলওয়ে বিভাগীয় অফিসসহ বিভিন্ন প্রকল্পে কর্মরত দেশী-বিদেশীরা বিমান ভ্রমণ করতে পারছেন না। একইভাবে ঈশ্বরদীসহ কাছের এলাকার বিভিন্ন পেশার প্রায় ১৫/২০ হাজার বিমানযাত্রীও বঞ্চিত হচ্ছেন বিমান ভ্রমণ থেকে। সংশ্লিষ্ট বিভাগের অযোগ্য, অদক্ষ ও দুর্নীতিপরায়ণ কতিপয় কর্মকর্তার স্বেচ্ছাচারিতার কারণেই ঈশ্বরদীতে বিমানের ফ্লাইট চালু করা হচ্ছে না। ঈশ্বরদী উপজেলা চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান বিশ্বাস, মান্নান সরদার প্রাইভেট কোম্পানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান সরদার, বাংলাদেশ অটো রাইস মিল ওনার্স এ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল আজিজ, ঈশ্বরদী চাল ও গম ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আলহাজ খাইরুল ইসলামসহ একাধিক রাজনৈতিক নেতা, আইনজীবী, বিদেশী যাত্রী, সংশ্লিষ্ট বিভাগের বিভিন্ন দায়িত্বশীল সূত্র, এলাকাবাসীর দেয়া অভিযোগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। সূত্রমতে, ঈশ্বরদীতে অবস্থানরত প্রায় আড়াই হাজার রুশসহ বিভিন্ন দেশের পাঁচ সহস্্রাধিক বিদেশী বিমানে ভ্রমণ করতে না পেরে প্রতিনিয়ত নানা অসুবিধার শিকার হচ্ছেন। তাদের কাজের গতি বৃদ্ধিতেও বাধার সৃষ্টি হচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে ক্ষতি হচ্ছে। এছাড়া ঈশ্বরদী, পাবনা, ভেড়ামারা, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, লালপুর, বাঘা, বড়াইগ্রাম, চাটমোহর, নাটোর অঞ্চলের হাজার হাজার যাত্রীও বিমানে চলাচল করতে না পেরে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানামুখী অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। একইসঙ্গে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ও প্রতিমাসে প্রায় অর্ধকোটি টাকা রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। পঞ্চান্ন বছর আগে পাকিস্তান আমলে নির্মিত ঈশ্বরদী বিমান বন্দরটিতে প্রতিদিন দু’টি করে ফ্লাইট চলাচল করত। স্বাধীনতার পরও বেশ কিছুদিন এটি চালু ছিল এবং যাত্রী সংখ্যাও ছিল বেশি। পার্শ্ববর্তী পাবনা, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর ও নাটোরের যাত্রীরা ঢাকাতে যাতায়াত করত ঈশ্বরদী বিমানবন্দর থেকে। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে এরশাদ সরকার আমলে হঠাৎ করে রাজশাহীতে নতুন একটি বিমানবন্দর চালু করার পর থেকে যাত্রী সঙ্কটের অজুহাত দেখানো শুরু হয়। নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় কর্মকর্তারা এ ষড়যন্ত্র শুরু করেন। এরই অংশ হিসেবে ১৯৮৭ সালে এই রুটে ফ্লাইট বন্ধ করে দেয়া হয়। বর্তমানেও শুধুমাত্র রানওয়ে প্রশস্ত না থাকার অজুহাত দেখিয়ে বেসরকারী বিমান সংস্থাগুলোও এ বিমান বন্দরটি ব্যবহারে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। সূত্রমতে, ঈশ্বরদীসহ কাছের এলাকার যাত্রীদের দাবির প্রেক্ষিতে ১৯৯৪ সালের ১৭ জুলাই থেকে বিমান চলাচল শুরু হয়। একইভাবে সিভিল এভিয়েশনের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী নিজেদের সুবিধার্থে নানা অপকৌশলের আশ্রয় নিতে থাকে। এরই অংশ হিসেবে তিন বছর পর ১৯৯৬ সালের ৩ নবেম্বর লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে পুনরায় বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ঈশ্বরদী অঞ্চলের মানুষের দাবির প্রেক্ষিতে ১৯৯৮ সালের ১০ মে বেসরকারী এয়ারলাইন্স এয়ার পারাবতের ফ্লাইট চালু করা হয়। মাত্র ৩৮ দিন চলার পর ২৮ জুন এই সার্ভিস বন্ধ করা হয়। দীর্ঘ ১৭ বছর বন্ধ থাকার পর জনগণের দাবির প্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের ১৮ নবেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে আবারও বিমানের ফ্লাইট উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনের পর থেকে আবারও ওই চক্রটি ষড়যন্ত্র শুরু করে বিমানবন্দর বন্ধ করার জন্য। শেষ পর্যন্ত ষড়যন্ত্রকারীরা ৬ মাস ১১ দিন পর আবার বিমানবন্দরটি বন্ধ করে দিতে সক্ষম হয়। দেশের উন্নয়ন অব্যাহত রাখা এবং রূপপুর পারমাণবিক মেগা প্রকল্প ও রেলওয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নসহ নানা প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ কারণেই বর্তমানে ঈশ্বরদীর এই বিমানবন্দরটি আবারও চালু হওয়ার বিশেষ প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এখানে নির্মিতব্য দেশের একমাত্র এবং বিশ্বের বত্রিশতম পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদন প্রকল্পসহ এখানে রয়েছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশ সুগারক্রপস গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঈশ্বরদী ইপিজেড, ডাল গবেষণা কেন্দ্র, রেলওয়ের পাকশী বিভাগীয় অফিস, আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, পাবনা চিনিকল, আলহাজ টেক্সটাইল মিল, পাকশী নর্থবেঙ্গল পেপার মিল (বর্তমানে বন্ধ), বেনারসি পল্লীসহ সাত শতাধিক চাল কল, অটো রাইস মিল, অয়েল মিলসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান । পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদন প্রকল্প, রেলওয়ে ও ইপিজেডকে ঘিরে পাঁচ সহস্রাধিক বিদেশী অবস্থান করছে। জরুরী প্রয়োজনে ঢাকা যাতায়াত করতে চাইলেও সেই সুযোগ তাঁরা পাচ্ছেন না। বর্তমানে ঈশ্বরদীতে অবস্থানরত রুশসহ অন্যান্য বিদেশী বিমানে ভ্রমণ করতে না পেরে প্রতিনিয়ত অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন। ঈশ্বরদী উপজেলা চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান বিশ্বাস বলেন, বিমানের ফ্লাইট চালু না থাকায় দেশী বিদেশী ব্যবসায়ী এবং সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। মান্নান সরদার প্রাইভেট কোম্পানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান সরদার বলেন, বিমানের ফ্লাইট চালু এখন সময়ের দাবি। দেশের ও জন স্বার্থে এটি চালু না করার কোন কারণ থাকতে পারে বলে মনে করি না। বাংলাদেশ অটো রাইস মিল ওনার্স এ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল আজিজ জানান, যখন দেশের অর্থনীতির চাকা সচল করতে সরকার ব্যস্ত তখন ঈশ্বরদী বিমানবন্দর কোনভাবেই বন্ধ থাকতে পারে না। এটি চালু করা জরুরী। ঈশ্বরদী চাল ও গম ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আলহাজ খাইরুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন,পর্যাপ্ত সংখ্যক যাত্রী থাকা সত্ত্বেও ঈশ্বরদীতে বিমানের ফ্লাইট চালু না করা খুবই দুঃখজনক। আমরা নিজেরাই ভুক্তভোগী। তাছাড়া উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যের বড় শিল্প এলাকা হিসেবে জরুরীভাবে ঈশ্বরদীতে বিমানের ফ্লাইট চালু করা প্রয়োজন। তিনি প্রতিদিন বিমানের ফ্লাইটে যাতায়াত করারও অঙ্গিকার ব্যক্ত করেন। ঈশ্বরদী বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক আব্দুর রশিদ আকন্দ জানান, ঈশ্বরদী বিমানবন্দরটি ৪৩৫ একর জায়গা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত। রানওয়ের দৈর্ঘ্য ৪ হাজার ৭শ’ ফুট ও প্রস্থ ৭৫ ফুট। এখানে যাত্রীবাহী ফ্লাইট বন্ধ থাকলেও সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও প্রাইভেট কোম্পানির হেলিকপ্টার প্রায় প্রতিদিনই অপারেট করে। সোমবার সকালেও (০৬.০৫.২০১৯ তারিখ) এখানে সেনাবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার অবতরণ করে।
×