ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ফণীতে ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত বেশি ॥ কয়েক শ’ একর ফসলের ক্ষতি

প্রকাশিত: ১০:৪৭, ৬ মে ২০১৯

 ফণীতে ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত বেশি ॥ কয়েক শ’ একর ফসলের ক্ষতি

শাহীন রহমান ॥ ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’ দুর্বল হয়ে আঘাত হানলেও আবহাওয়া বিশেষজ্ঞদের হিসাব অনুযায়ী ফণী ছিল ২০০৯ সালে বয়ে যাওয়া আইলার শক্তির প্রায় সমান। কিন্তু ক্ষয়ক্ষতির বিবেচনায় ‘ফণী’তে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি নেই বললেই চলে। যেখানে আজও আইলার ক্ষত শুকায়নি। আইলায় মানুষের পাশাপাশি পশু প্রাণীর অনেক ক্ষতি হয়েছিল। সেই তুলনায় প্রায় একই গতিবেগের ঝড়ে এবারে ফণীতে ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে বেশি। এর বাইরে গাছপালা উপড়ে পড়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া কয়েকশ’ একর ফসলের আংশিক ক্ষতি হয়েছে বলে জানা গেছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় বলছে, এই ঝড়ে ক্ষতি বলতে উপকূলীয় এলাকায় প্রায় ৩শ’ একর ফসলের আংশিক ক্ষতি হয়েছে। এছাড়াও এসব এলাকায় ২ হাজারের বেশি ঘরবাড়ির আংশিক ক্ষতি হয়েছে। এর বাইরে উপকূলীয় এলাকায় গাছপালার ক্ষতি হয়েছে অনেক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়ার কারণে এই ঝড়ে বড় ধরনের জীবনহানির ঘটনা ঘটেনি। ঝড় উপকূলে আঘাত হানার আগেই প্রায় ১২ লাখ জনগণকে আশ্রয় কেন্দ্রে নেয়া হয়। ফলে জীবনহানি নেই বললেই চলে। ঝড়ে গাছপালা এবং বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়ে মাত্র ৮ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে। তবে এ সংখ্যার সামান্য কমবেশি হতে পারে। উপকূলীয় এলাকার লোকজন বলছে ঝড়ে তেমন কোন বিপদ হয়নি। তবে ঘরবাড়ি এবং গাছপালার ক্ষতি হয়েছে। কোথাও কোথাও রাস্তায় গাছপালা পড়ে যাওয়ায় সড়ক যোগাযোগ ব্যাহত হয়েছে। এছাড়া বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন হওয়ার মতোও ঘটনা ঘটেছে। দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন বিভিন্ন জায়গায় গাছ এবং ঘরবাড়ির কিছু ক্ষতি হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির সঠিক তথ্য নিরূপণ করে দ্রুত পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়া হবে। মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব শাহ কামাল জনকণ্ঠকে বলেন, এই ঝড়ের ক্ষতি বলতে উপকূলীয় এলাকায় ২ হাজার ২৪৩ ঘরবাড়ির আংশিক ক্ষতির পরিমাণ জানা গেছে। এছাড়া তিনি বলেন, এই ঝড়ের কারণে এসব এলাকায় তিনশ’ একরের ফসলের আংশিক ক্ষতি হয়েছে। তিনি বলেন, টাকার অংকে এই ক্ষতির পরিমাণ এখনও নিরূপণ করা হয়নি। তবে ঝড়ে যেসব এলাকায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সেসব এলাকায় লোকজন এখন বেশ মানবেতর জীবন যাপন করছে বলে জানা গেছে। বিশেষ করে দ্বীপ জেলা ভোলার তেঁতুয়া নদীর তীরে কোড়ালিয়া গ্রামে মানুষের ঘরবাড়ি এখন এক ধ্বংসস্তূপ। আর ধ্বংসস্তূপের মাঝেই গৃহহারা শতাধিক পরিবার খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন যাপন করছে। তবে শেষ সহায় সম্বল যা আছে তা নিয়ে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু তাদের জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত ত্রাণ ও পুনর্বাসন। কোড়ালিয়া গ্রামটিতে শুধু বাড়িঘরই বিধ্বস্ত হয়নি। গ্রামের গাছপালা, পানের বরজ, কলার বাগানসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ওই এলাকায় এখনও বিদ্যুতের ভেঙ্গে যাওয়া খুঁটি স্থাপন না করায় বিদ্যুত সরবরাহ শুরু হয়নি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে টিন, চাল ও নগদ অর্থ বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আবহাওয়াবিদদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী ফণী ছিল অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়। যা অতীতে বয়ে যাওয়া সব ঝড়ের চেয়ে অনেক বেশি গতিপথ অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। কিন্তু এটি যখন বাংলাদেশে প্রবেশ করে তখন অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়ে। তার আগে ওড়িশা উপকূলে প্রায় ২শ’ কিলোমিটার বেগে আঘাত হানে। এরপর পশ্চিমবঙ্গ হয়ে খুলনার সাতক্ষীরা অঞ্চল দিয়ে শনিবার সকালে বাংলাদেশের উপকূলে প্রবেশ করে। এরপর মধ্যাঞ্চল হয়ে ভারতের ভূখন্ডে চলে যায়। আবহাওয়া অফিসের হিসেবে ফণী সর্বোচ্চ ৮১ কিলোমিটার বেগে বাংলাদেশের ভূখন্ডে আঘাত হেনেছে। আবহাওয়া অধিদফতরের পরিচালক সামছুদ্দিন আহমেদ বলেন, ফণীর সর্বোচ্চ এই গতিবেগ ছিল কুমিল্লার কাছে অবস্থানের সময়। বরিশালে অবস্থানের সময় এর গতিবেগ ছিল ৭৪ কিলোমিটার। তিনি বলেন, এই ঝড়ের মোট বাতাসের গতি ছিল ৬২ থেকে ৮১ কিলোমিটার পর্যন্ত। ফণীর সঙ্গে ঘূর্ণিঝড় আইলার তুলনা করলে দেখা যায় দুটি ঝড়ের গতিবেগ প্রায় একই ছিল। ২০০৯ সালে আয়লা দেশের উপকূল আঘাত হানে। আবহাওয়া অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী ওই ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ ছিল ৭০ থেকে ৯০ কিলোমিটারের মধ্যে। হিসাব অনুযায়ী আইলা এবং ফণীর গতিবেগ প্রায় কাছাকাছি। কিন্তু উপকূলীয় এলাকায় আইলার ক্ষত এখনও শুকায়নি। আইলায় শুধু মানুষ না, পশু প্রাণীরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। সেই তুলনায় ফণীর বেলায় ক্ষয়ক্ষতি নেই বললেই চলে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভয় বা আশঙ্কা থাকলেও ঘূর্ণিঝড়টি আগেই দুর্বল হয়ে যাওয়ায় এর প্রবেশ এলাকায় বড় ধরনের কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তবে ঘূর্ণিঝড়টি দেশে প্রবেশের আগে দক্ষিণ পশ্চিমের সাতক্ষীরা জেলায় গাবুরা ইউনিয়নকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তবে ঝড়ে সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে থাকা এই ইউনিয়নে ঝড়ে কোন বিপদ হয়নি। তবে গাছপালা এবং ঘরবাড়ির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে এলাকার লোকজন জানায়। জানা গেছে, উপকূল অতিক্রম করার সময় এই এলাকার ৬শ’ কাঁচা ঘরবাড়ি আংশিক ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া ফসলের আংশিক ক্ষতি হয়েছে। ফণী ব্যাপক ধংসযজ্ঞ চালাতে পারে জেলাজুড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে এমন আতঙ্ক থাকলেও শনিবার সকালে আবহাওয়া স্বাভাবিক হতে থাকায় আশ্রয় কেন্দ্রগুলো থেকে গ্রামবাসী বাড়ি ফিরতে শুরু করে। আবহাওয়া অফিসের হিসাব অনুযায়ী ৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছিল। প্রায় ৫ লাখ লোকের প্রাণহানি হয়েছিল ওই ঝড়ে। এরপর ’৯১ সালে ঘূর্ণিঝড়ে ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। ২০০৭ সালে সিডরের আঘাতেও মারা যায় প্রায় ৭ হাজার মানুষ। কিন্তু ফণী অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়ার পর থেকেই ঘূর্ণিঝড়টি মোকাবেলায় সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রস্তুতি শুরু হয়। উপকূলীয় ১৯ জেলায় মানুষজনকে আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য মাইকিং করা হয়। শেষ পর্যন্ত ১২ লাখ লোক আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়। এর পরেই ঝড়ে ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়ে ৮ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ভোলায় ২ জন, নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ২ জন, বরগুনার পাথরঘাটায় ২ জন এবং পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় ১ জন, লক্ষ্মীপুরে ১ জন। এছাড়া এসব এলাকায় বিভিন্ন জেলায় আহত হয়েছে শতাধিক লোক। ফণীর প্রভাবে খুলনায় ব্যাপক ঝড় বৃষ্টি হয়। বহু ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। নদীতে স্বাভাবিকের চেয়ে ৩ থেকে চার ফুট উচ্চতায় জোয়ারের পানি প্রবাহিত হয়। হাজার হাজার গাছ উপড়ে পড়েছে। জোয়ারের পানিতে পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। অনেক এলাকায় জোয়ারের পানি ঢুকে গ্রাম প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ভোলা প্রতিনিধি হাসিব রহমান উপকূলীয় দ্বীপ জেলায় ক্ষয়ক্ষতি সরেজমিন পরিদর্শন করে জানান, ভোলা সদর উপজেলা দক্ষিণ দিঘলদী ইউনিয়নে শুক্রবার রাতে ঘূর্ণিঝড় ফণী আঘাত হানে। এতে করে ওই এলাকার প্রায় দেড় শতাধিক বাড়িঘর ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। প্রাকৃতিক মনোরম পরিবেশে সাজানো গ্রামটির চিত্রই এখন পাল্টে গেছে। ভোলা শহর থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে কোড়ালিয়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ঝড়ে লন্ডভন্ড অবস্থায় পড়ে রয়েছে বহু ঘরবাড়ি। খোলা আকাশের নিচে অসহায় পরিবারগুলো এখন চরম দুর্ভোগে রয়েছেন। তারপরও তারা ধ্বংসযজ্ঞ থেকে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছেন। কেউ কেউ বসতভিটির ওপর থাকা ধংসস্তূপ সরিয়ে নিচ্ছে। আবার কিছু পরিবার টংঘর তুলছে রোদ বৃষ্টিতে আশ্রয় নেয়ার জন্য। কেউ আবার বিছানা কাপড় রোদে শুকাচ্ছেন। ক্ষতিগ্রস্ত কিছু ঘরবাড়ি আগের অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। এসব পরিবারের মধ্যে রয়েছে খাবার সঙ্কটও। ক্ষতিগ্রস্ত হানিফ শিয়ালী, ফারুক, জামাল, আকবর, হারুন খাঁ, নীরব, নুরুসহ বহু লোক জানান, তাদের ঘরবাড়ি সব কিছু ফণী কেড়ে নিয়েছে। ঘরে আসবাবপত্র, খাবার পর্যন্ত নেই। এমনকি শিশুদের বই পর্যন্ত নষ্ট হয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো দ্রুত পুনর্বাসনের দাবি জানায়।
×